অনলাইন ডেস্ক: তরুণ বয়সে বিদেশের মাটিতে পা রাখা অশিথের বয়সও হয়েছে এখন ঢের। নানা অসুখ দানা বেঁধেছে শরীরে। সম্প্রতি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন বাহরাইনের হাসপাতালে। দীর্ঘ পাঁচ মাস চিকিৎসা শেষে শূন্য হাতে গত মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) দেশে ফেরেন তিনি।

দীর্ঘ ৩৬ বছর বাহরাইনে কাটিয়ে শূন্য হাতে দেশে ফেরা অশিথকে প্রথমে গ্রহণ করতে চায়নি পরিবার। পরিবার বলতে, শুধু বড় ভাই আছেন। অশিথ যখন বাহরাইন যান তখন তার বাবা বেঁচে ছিলেন। তিনিও পরপারে পাড়ি জমান গত বছর। বড় ভাইয়েরও টানাটানির সংসার। ছোট পান-সুপারির দোকানের আয় দিয়ে চালাতে হয় চারজনের সংসার। এ অবস্থায় অসুস্থ অশিথকে দেখভালের দায়িত্ব নিতে চাননি তিনি। অবশেষে রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরামর্শে বড় ভাইয়ের ঘরেই ঠাঁই হয় অশিথের।

বাহরাইনের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, টানা ৩৬ বছর বাহরাইন অবস্থান করেছেন অশিথ। দেশটিতে দীর্ঘ অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তবে এ সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও বাংলাদেশে ফেরা হয়নি তার। এ কারণে পরিবার কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি। গত ২৪ মার্চ তিনি স্ট্রোক করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাহরাইনের সালমানিয়া হাসপাতালে ভর্তি হন এবং হাসপাতালে প্রায় পাঁচ মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে বাহরাইনে তার কোন মালিক/স্পন্সর ও আত্মীয়স্বজন না থাকায় দূতাবাস তার সার্বিক বিষয়ে তদারকি করে এবং সহযোগিতা প্রদান করে।

চিকিৎসা শেষে সালমানিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে দেশে পাঠানোর পরামর্শ দেয়। দূতাবাস থেকে অশিথকে দেশে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশে তার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু প্রথমে তিনি তাকে গ্রহণ করতে রাজি হননি। পরবর্তীতে দূতাবাস ও রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা পালের অনুরোধে তিনি তাকে গ্রহণ করতে রাজি হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অশিথকে দূতাবাসের একজন প্রতিনিধিসহ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, বাহরাইনের বাংলাদেশ কমিউনিটির সহায়তায় গত মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) দেশে পাঠানো হয়। বুধবার (১০ আগস্ট) রাজনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা পালের উপস্থিতিতে তাকে পরিবারের কাছে পৌঁছে হস্তান্তর করা হয়।

অশিথের বড় ভাই উমা দে বলেন, আমরা দুই ভাই। অশিথ আমার ছোট। আমারা যখন ছোট তখন আমাদের মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর অশিথ অধিকাংশ সময়ই মামা বাড়ি থাকত। তার বয়স যখন ২০-২২ তখন সে বাহরাইন যায়। তাকে বিদেশ পাঠানোর জন্য আমাদের জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পরই সে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ৩৬ বছর হয়ে কেটে গেছে। বাবার সঙ্গেও কথা বলত না। মাঝে মাঝে ফোন করত। আমার সঙ্গে কথা বলত না। আমার দুই মেয়ের সঙ্গে কথা বলত, তাও দুই-এক বছর পর পর।

বাহরাইন যাওয়ার পর থেকে অশিথ পরিবারে কোনো টাকা দেননি দাবি করে তিনি বলেন, বিদেশ যাওয়ার পর এ পর্যন্ত ১০ টাকাও দেয়নি। ঠিক মতো কাজ করত না। নিজে খাইত, খরচ করত। এতো বছর ছিল বাহরাইনে। অথচ শূন্য হাতে ফিরল দেশে।

দূতাবাস থেকে প্রথমে যোগাযোগ করা হলে ছোট ভাইকে গ্রহণ না করার কারণ হিসেবে উমা বলেন, আমি রাজি থাকলেও পরিবারকে রাজি করাতে পারছিলাম না। আমরা গরিব মানুষ। পরিবার চিন্তা করছে, নিজেদের চলতে কষ্ট হয়; এ অসুস্থ অশিথকে আবার কে দেখবে। আসলে ৩৬ বছর কোনো মানুষ যদি যোগাযোগ না করে, তার ওপর তো সবার রাগ থাকা স্বাভাবিক। তাছাড়া তার থাকার জন্য তো একটা ঘরও দরকার। দুই রুমের ঘর নিয়ে কোনো রকম দিন পার করছি।

উমা বলেন, রাজনগর বাজারে ছোট একটা পান-সুপারির দোকান আমার। সেখান থেকে মাসে ছয় হাজার টাকার মতো আয় হয়। তা দিয়ে কোনো রকম সংসার চালাই। এ অবস্থায় ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার খরচ চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাকে যদি দেখভাল না করি তাহলে সমাজের লোকজন খারাপ বলবে। আবার আমার যে আয় তা দিয়ে সংসার চালিয়ে তার চিকিৎসা ব্যয় বহন করাও কঠিন।

অশিথের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বড় ভাই উমা বলেন, খুব বেশি কথা বলে না, কিছু জানতে চাইলে উত্তরও দেয় না। কথা বলার চেষ্টা করলে রেগে যায়।

রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, দূতাবাস থেকে অশিথকে দেশে ফেরার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আমরা তার ভাই উমা দের সঙ্গে কথা বলি। প্রথমে তিনি তাকে নিতে রাজি ছিলেন না। ৩৬ বছর আগে বিদেশে গেলেও অশিথ কখনও দেশে টাকা পাঠায়নি। এ নিয়ে তাদের চাপা ক্ষোভ ছিল। বড় ভাইয়েরও আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। একটা মাটির ঘর, কক্ষ মাত্র দুটি। পরে আমি বললাম, আমরা না হয় আর্থিক সহায়তা করব, যাতে একটা রুম করে নিতে পারেন। পরে তিনি রাজি হন।

প্রিয়াংকা পাল বলেন, আমরা ভেবেছিলাম কিছু টাকা ম্যানেজ করে দেব। দূতাবাস থেকে বলেছে, প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার টাকা দেবে। পরে ৬১ হাজার টাকা পাঠায়। এ টাকা অশিথের ভাইয়ের হাতে দিই। এ কারণে তারা বিশ্বাস করল যে আমরা তাদের সঙ্গে আছি।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় অশিথকে কোনো সহযোগিতা করা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি নিঃস্ব অবস্থায় দেশে এসেছেন। কোনো টাকা পয়সা নিয়ে আসেননি। তার ওপর পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী। এরকম মানুষের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দ আছে। সেটার জন্য আমরা দ্রুতই আবেদন করব।

মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা একটা চমৎকার উদ্যোগ। এটা ডিল করেছেন রাজনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার। দূতাবাস এবং রাজনগরের স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে আমরা ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারা একটা অনন্য উদ্যোগ নিয়েছে। যার কারণে দুই ভাইয়ের বহুদিন পরে মিলন হয়েছে। তার হাসপাতালের খরচ দূতাবাস দিয়েছে। দূতাবাসের উদ্যোগের ফলে তিনি দেশে ফিরেছেন।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় অশিথকে সহযোগিতা করা হবে কি না, জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক জানান, উপজেলা প্রশাসন আমাদের জানালে বিষয়টা আমরা দেখব। সূত্র : ঢাকা পোস্ট