ইউসুফ কামাল : সারাজীবনই পার হয়ে যায় মানুষের জীবন সাজাতে সাজাতে। প্রতিটা ক্ষন ধরেই সচেষ্ট থাকে নিজেকে আরো সুন্দর করে রাখার জন্য, সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠিত করে তুলে ধরতে সেই সাথে নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজের পছন্দ মতো করে সাজিয়ে রাখতে। সবাই যেন রবার্ট ব্রুস এর দেখানো পথেই জীবন সংগ্রামের অনুশীলন চালায়, সবার ধৈর্যের বাধ-তে এক রকম থাকে না, তাই তো সব শেষে সংগ্রামে পর্যুদস্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারে! নিয়তির বিধান মেনেই এক সময় সব কিছুকে মেনে নিতে হয়। সেই শালনা ঘটনার প্রথম দিন থেকে বুলা’র সাথে যে সম্পর্কটা দানা বেধে উঠেছিলো, সেটা যে এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবে তা কি বোঝা গিয়েছিলো? সূত্রপাতটা খুবই সামান্য একটা বিষয় ছিলো, এটাই হয়তো নিয়তি যা ঠেকানোর সাধ্য কারোই নাই। চলতি পথে এমন ঘটনা তো মানুষের জীবনে হাজারোই ঘটে তার বেশির ভাগই অজান্তে হারিয়ে যায়, সেটা মনেও থাকে না।

সেদিনও দুপুরে ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরির সামনে অপেক্ষা করছিলো টিএসসিতে যাবে বলে। ক্লাশ থেকে বের হয়ে ওখানেই ওঁকে দেখি রোজ। চোখে চোখ পড়লেই বোঝা যায় অপেক্ষা করছে, এটা একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কোন ক্রমেই এর ব্যাত্যয় ঘটতো না। টিএসসি’তে ঢোকার সময় বল্লো, ব্যাংকে যেতে হবে যে। ভুলেই গিয়েছিলাম বল্লাম, তাইতো চলো। করিত্কর্মা আফজাল ভাই বসতে দিয়ে বল্লেন, কত টাকা জমা দিবেন? বুলা সে দিনের ওর বাবার দেয়া টাকার এনভেলাপটা বের করে আমার হাতে দিলো। হলের খাওয়া ও অন্যান্য খরচের জন্য মোটামুটি কিছু টাকা হাতে রেখে বাকীটা একাউন্টে জমা দিতে দিয়ে দিলাম। অফিসার টাকা জমা নিয়ে চেক বই ইস্যু করে ওর হাতে ধরিয়ে দিলেন। কাজ শেষ। বুলা চেক বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ওর মত আমিও একটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম টাকাগুলোর নিরাপদ স্থানান্তরে। হল জীবনের অনেক বিড়ম্বনাও আছে। কিছু অঘটন ঘটে গেলে কিছুই করার থাকবে না মধ্যের থেকে ঐ বেচারীরই কষ্ট হবে। এটাতেও নিজেও যে খুব খুশী হলো সেটা ওর মুখ চোখই বলে দিচ্ছে। বল্লাম, একাউন্ট নাম্বারটা তোমার বাবাকে পাঠিয়ে দিও। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দুপুরের খাওয়ার পর টিএসসি’র লনে বসে ঘন্টা খানেক আলাপচারিতা প্রায় প্রাত্যাহিক রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এই সময়টা কোনো কাজও থাকতো না। অনেক দিন বন্ধুদের কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে গেলে আড্ডাটাও দীর্ঘায়িত হয়ে পড়তো। সংখ্যা ৫/৭ জনের বেশি হয়ে গেলে উচ্চ কন্ঠের গল্পের সাথে উচ্চ কন্ঠের হাসি চার পাশে ছড়িয়ে পড়তো। আর সেটা দীর্ঘায়িত হয়ে ওর হলে ঢোকার সময়ও হাতের নাগালে চলে আসতো।

বাঁধা ধরা কোন নিয়ম ছিলো না কোন দিন কার্জনহলের অভিমুখে হাঁটতে হাঁটতে আণবিক শক্তি কমিশন, বাংলা একাডেমি, দোয়েল চত্বর ঘুরে আবার ফিরে আসা। উপলক্ষ কিছুই না, সংগ দেওয়া আর প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় কথার শব্দ মালা তৈরী করা। এ ছাড়াও মাঝে মাঝেই ওকে নিয়ে হাঁটতাম রেসকোর্সের সবুজ ঘাসে, সাথে দু’একজন থাকলে একটু দূরেও যাওয়া যেতো আর তাতে আর উটকো ঝামেলার কোনো আশংকাও থাকতো না। হাল্কা সবুজ সালোয়ারে সবুজ ঘাস ছুয়ে মিতালী করে হেঁটে যাওয়া, মনে হতো সবুজের সাথে অপরিসীম সখ্যতা, যেন জন্ম জন্মান্তরের বিকল্পহীন সাথী। পাশাপাশি হাঁটার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে। যৌথভাবে পথ চলা, তা পথ যত বন্ধুরই হোক না কেনো সমস্যা হয় না। একটা দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর মন, যা সময়ের সাথে মনকেও সাহসী করে তোলে।
শাহবাগের সিনেরিটায় ঢুকতে যেয়ে বুলা কি যেন একটা কিছু মনে করে পিছিয়ে এসে ‘গ্যানজেস’ এ ঢুকলো। এটা তখনকার ঢাকার অভিজাত ষ্টোরের একটা। ঢুকেই মনে হলো আমার নিজের জন্য তো একটা বেল্ট কেনা দরকার। পছন্দ করে দাম দিতে ক্যাশে যেয়ে দেখি ও অনেকক্ষন ধরে কি যেন খুঁজছে, একটু এগিয়ে একজন সেল্সম্যানকে কি যেন বল্লো। বুঝলাম কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনে মনে, দেখা যাক।

আমার বেল্ট কেনা শেষে ওর কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম কাউন্টার থেকে সেলস্ম্যান একটা প্যাকেট ক্যাশে রাখতে গেলো, পিছনে বুলা। কিছু একটা কিনলো মনে হয়, বল্লাম, কি কিনলে? মনে হলো বিরাট কিছু একটা জয় করতে পেরেছে, সন্তুষ্টির ভাব চোখে মুখে। ব্যাগ খুলে ক্যাশে টাকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। হেসে বল্লো, পরে বলবো। মৃদু হেসে সদ্য কেনা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। সিনোরিটায় ঢুকতেই বাসু’দার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। মৃদু হাসি বিনিময়ে কুশল আদান প্রদান শেষে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। বুলাকে উনি চিনেন একই এলাকার মানুষ হিসাবে। আর ওর মায়ের মৃত্যু সংবাদও জানেন বোঝা গেল ওদের কথায়।

বিকালের দিকে পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষ ঘুরতে বের হওয়ায় ভীড়টা এখানে একটু বেশি। সিনোরিটার দোতলাটা এ জায়গাটা পারিবারিক খাওয়া দাওয়ার জন্য খুবই উপযোগী একটা স্থান। বুলা মায়ের মৃত্যুর পর আর বরিশাল যায়নি, বাড়ির খবরাখবর জানতে চাইলাম। ঠাণ্ডা গলায় বল্লো, ভাইয়ের সাথে দুই দিন আগে কথা হয়েছে, সময় করে বরিশাল থেকে ঘুরে আসতে বলেছে। আর যদি কিছু লাগে জানাতে বলেছে। ওর কথার ধরনে আমার কাছে কেন যেন মনে হলো ওদের মধ্যে সম্পর্কের একটা শীতল ধারা বয়ে চলেছে। একমাত্র ছোট বোন, বাবা বিদেশে তার উপর স¤প্রতি মা’র মৃত্যু অবস্থাদৃষ্টে উভয়ের মধ্যে আরো বেশি যোগাযোগ থাকার কথা। কিন্তু সেটা তো দেখতে পাচ্ছি না। ভাবলাম এখানে আবার স্বার্থপরতা কাজ শুরু করলো নাকি? কথাচ্ছলে এক সময় বলেই ফেল্লো, বাবা লন্ডন ফিরে যাবার সময় আমাকে যে কিছু পাউন্ড দিয়ে গেছেন সেটা তাকে বলিনি। এতদিন তো মা’য়ের অধীনেই সব কিছু চলেছে, এখন তো পরিস্থিতি বদলে গেছে, সব কিছুই তো ভাই ভাবীর আয়ত্বে। আমাকে দুই দিনের জন্য হলেও একবার বাড়িতে যেতে হবে, বাড়ির অবস্থা আমাকে দেখতে হবে। মায়ের অবর্তমানে সব কিছুই এখন ওদের নিয়ন্ত্রণে।

সব পরিবারের মতো এখানেও কর্তৃত্ব দখলের আলামত টের পাচ্ছি। মূল অভিভাবকের বিদায়ের সাথে সাথেই দাবার সব ছকই যেন পাল্টে যায়। ভাবলাম এখানেও তেমন কিছু হচ্ছে নাকি? সন্ধ্যা হয়ে আসছে, গেট বন্ধ হওয়ার আগেই হলে ফিরতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম ওর হলের গেটের সামনে। হাতের প্যাকেটেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বল্লো, তোমার জন্য আমি পছন্দ করে একটা জামা নিয়েছি সাথে একটা ‘কাপলিংস’ আছে, বাসায় যেয়ে দেখো। আমি তো তোমাকে কিছু দিতে পারিনি, ভালো লেগেছে কিনা সরাসরি বলবে। ওর কথার মধ্যে কেমন একটা হৃদয় ছোঁয়া আকুতির ছোঁয়া পেলাম। মন থেকে কেউ যখন কাউকে কিছু দিতে চায় সেটার কোনো মূল্য কি পরিমাপ করা যায় বা করা কি সম্ভব? পরীক্ষার প্রস্তুতি সবাইকে সাময়িকভাবে হলেও স্বাভাবিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। লেখাপড়ার চাপে একটু অনিয়মিত হয়ে গেলাম সবাই। বুলা বাড়িতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছে বল্লাম, তুমি কয়েকদিন বাড়ি ঘুরে সমস্ত পরিবেশ দেখে আসো, জানি তোমার যেতে ইচ্ছে করছে। আর তাহলে আমিও এই ফাঁকে কয়েকদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দুই দিন পর এক বিকেলে বুলাকে সদরঘাটের লঞ্চে তুলে দিয়ে পরদিন সকালে পুনুর সাথে আমিও রাজবাড়ী রওয়ানা দিলাম। উদ্দেশ্য কয়েকটা দিন একটু ঘুরে আসি। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র