ইউসুফ কামাল : বেশ কিছুদিন বন্ধুদের সাথে ঠিকমতো বসা হয় না, ক্লাসে সিকান্দরের সাথে দেখা হয় কিন্তু তেমন কথা হয় না। মনে হলো কেমন যেন একটা দূরত্ব হয়ে যাচ্ছে, রাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম পরদিন ছুটি, ওর সাথে দেখা হলে মন্দ হয় না। জহুরুল হক হলের সকালের নাস্তাটাও ভালো হয়, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম সলিমুল্লাহ্ হল থেকে সিকান্দরকে নিয়ে জহুরুল হক হলে নাস্তা করে আলমের সাথে কিছুটা সময় কাটানো যায় কিনা। শংকা ছিলো সিকান্দারকে হলে পাবো কিনা, দেখলাম ও তখনো ঘুমাচ্ছে। ও তো এত বেলা হলে থাকে না, তাহলে কি পকেটের অবস্থা ভালো নয় বললাম, ওঠ চল। নাস্তা করতে হবে। হেলেদুলে রেডি হতে ওর আধাঘন্টা লেগে গেলো, সলিমুল্লাহ্ হলের পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে জহুরুল হক হলের কেন্টিনে চলে আসলাম। ওকে বসতে বলে আলম’কে নিতে ওর রুমে আসলাম। আলমকে নিয়ে কেন্টিনে ঢুকে দেখি সিকান্দর চুপ চাপ বসেই আছে, বল্লাম কিরে অর্ডার দেওয়া হয়েছে? মুখটা শুকনো করে উত্তর দিলো, দোস্ত পকেটের অবস্থা ভালো না। তোরা খা, আমি দেখি। আমি হেসে ফেল্লাম বল্লাম, তোর মতো একা চলার লোক আমরা নাকি? খেলে সবাই খাবো। ওর কথায় আলম রেগে গেলো। বল্লো গত সপ্তাহে যে টাকা পাঠালো তোর বাবা আমাদের বল্লি, সেটা কই। ও নিরুত্তর। বুঝলাম খরচ করে ফেলেছে নিশ্চয়ই। ও এমনই, যতক্ষন পকেটে টাকা থাকে ওঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। হলে পাওয়া মানেই পকেট শূন্য। পরোটা আলু ভাজি ওখানকার নাম করা, খুবই স্বাদের। সাথে ডিম পোজ্ আর চা শেষ করে আলমের রুমে ঢুকতেই শুরু হয়ে গেল দুইজনের খুনসুটি। আলম বল্লো, সত্যি তোর কাছে টাকা আছে কিনা দেখতে হবে? এ দিকে আয় তোর পকেট সার্চ করি। এমনি করেই দুজনে সারাক্ষন লেগে থাকে দুই জনের পিছনে। অনেকদিন পর ভালোই লাগলো। বন্ধু সাহচর্য সর্বোত্তম, যা মানসিক অবসাদ কাটানোর মহাঔষধ। আয়ু বর্দ্ধকও কিছুটা। আলম আবার লাগলো সিকান্দরের পিছনে, কিরে সালেহার খবর কি? বুঝলাম ওর নাস্তার টাকা দেওয়ার কষ্টটা এখনো ভুলতে পারছে না, এই সব প্রসংগ নিয়ে এখন চলবে কিছুক্ষন। বল্লাম, চলো নিউ মার্কেটে যাই নিজাম থাকতে পারে, সময় ভালোই কাটবে। সকাল বেলা বাইরের খদ্দেরের আনাগোনা খুবই কম। বই এর দোকানের দিকে কিছু ছেলে মেয়ে ঘুরছে এক সাথে। ৪/৫ জন ছাত্রী এক সাথে, ওদের দু’একজনের ঘুরে তাকানো দেখে মনে হলে বুলা নয়তো, তাই বা কেনো? ও হলে তো আমাকে দেখলেই এ দিকে চলে আসতো, আবার তাকাতেই দেখলাম একজন এগিয়ে আসছে, চিনলাম বুলার রুমমেট সীমা।
ওর কথায় বুঝলাম খাতা কলম কিনতে এসেছে। হেসে নিজে থেকেই বল্লো, ভাই, বুলা লাইব্রেরিতে, আমি কিছুটা জোর করে পাঠিয়েছি কয়েকদিন পড়াশুনা করতে পারে নাই। আপনি আসবেন জানলে সাথে নিয়ে আসতাম। পাচ’টায় হলের সামনে আসবেন আমি ওকে বলবো। নিজামের দাদা ষ্টাইলের ভিতরেই বসলাম তিনজন। ও বল্লো শুক্রবারে এখানে ভালো বিরিয়ানী রান্না হয়। তোরা খাবি নাকি? বিরিয়ানীর কথায় সিকান্দর নড়ে চড়ে বসলো, আলম খেয়াল করে জোরে হেসে উঠলো। সিকান্দার আবার খাবারের বিষয়ে খুবই দুর্বল সেটা কোলকাতা ভ্রমণের সময় থেকেই আমরা সবাই জানি। ভোজন রসিক মানুষ ভালো খাবারের কথা শুনলেই নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। ওর বেলাতেও ঠিক তাই। দুপুরের খাওয়ার পর্বের শেষ হওয়ায় আপাতত: আর বাসায় ফেরার তাগাদা থাকলো না। ভালোই হলো, ভাবলাম আলমের হলেই দুপুরটা কাটিয়ে দেবো। সিকান্দর ওর হলে চলে গেলো।
পাঁচ’টার দিকে আলমকে নিয়ে বুলার হলের সামনে এসে দেখি রোজীকে নিয়ে বুলা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। রোজীর চোখ মুখে রাগ, হয়তো বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেছে। আলমকে বল্লাম, চলো রেসকোর্সে যাই। পরিবেশটা ঠান্ডা হওয়া দরকার ওখানে বসে বাদাম চা খাই ঠিক হয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা সামান্য একটু দূরত্ব নিয়েই বসি। রেসকোর্সের গেটের মাথা থেকে বাদাম কিনে বাদামওয়ালাকে বল্লাম চা’র ফ্লাস্ক ওয়ালা আসলেই ওখানে পাঠিয়ে দিও। এই সমস্ত হকারদের সাথে এখানে আসা সবার সাথেই একটা বিশেষ সখ্যতা হয়ে যায়। বুলাকে আজকে দেখে একটু ফুরফুরে মেজাজে আছে মনে হলো। বাদামের খোসা ছড়িয়ে নিজে না খেয়ে আগে আমাকে দেয়, ওর পুরনো অভ্যাস আগেও দেখেছি। গুন গুন করছে বল্লাম, গাইবে নাকি? তাকালো আমার দিকে বল্লো, অনেকদিন তো শোনো না, শুনবে? সম্মতি বুঝে নিলো আমার মাথা নাড়ানোতেই। ও অধিকাংশ সময়েই গানের অন্তরাটা আগে গেয়ে পরে প্রথম থেকে শুরু করে। আজো তাই করলো-
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে কে মোরে ডাকিবে কাছে
কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে।
এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি না যুছিতে আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে।
যে ছিলো আমার স্বপন চারিণী তারে বুঝিতে পারিনি ওগো বুঝিতে পারিনি
দিন চলে গেছে খুজিতে খুজিতে হায়। ওগো যে ছিলো আমার স্বপন চারিণী।।
আমার বাদাম খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, বুলার হাত থেমে গেছে। উজ্জল মুখটা থম থমে হয়ে গেলো, হঠাৎ কি যেন হয়ে গেলো। কতক্ষন চুপ করে থাকলো পরে ধরা গলায় বল্লো, জীবনের ধারাটা আমার ঘুরে গেলো। মা’টা চলে গেলো, আমাকে একা ফেলে। কত আশা ছিলো, তোমাকে নিয়ে মায়ের সাথে কত গল্প করেছি সব ওলোটপালোট হয়ে গেলো। আমার জীবনটা কোন দিকে যে হয়ে যাবে বুঝছি না। বল্লাম, এ সব কি ভাবেছো, জীবন জীবনের মতোই চলবে, তুমি খামোখাই চিন্তা করছো। এমন করলে কিন্তু গানের কথা আর বলবোই না। ওর কথায় বুঝলাম মন খারাপের কারণ, হয়তো সাথে আরো অনেক কিছুই ভাবছে। যে ভয় আমার মনের ভিতর বসে আছে সেই আশংকাটাই কি সত্য হলো? একলা হলেই মা’য়ের স্মৃতিটা যে ওকে পেয়ে বসে বুঝলাম।
পরীক্ষার আগে এমন হলে তো সমস্যা হবে। ভাবলাম কালকে সীমাকে বলতে হবে ও যেন একা একা মন খারাপ করে থাকতে না পারে। যতটুকু পারো সংগ দিও। প্রসংগটা বদলাতে বল্লাম, তোমার পাসপোর্টের কাগজ জমা দেওয়ার স্লিপটা দেখো তো ডেলিভারীর তারিখ কবে? ওটা আনতে হবে, কত দিন হলো? হঠাত করেই যেনো মুখটা ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, মনে হয় আমার মনের ভিতরটা পড়তে চাইলো। ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠলাম, ও কি ভাবছে আমি ওকে সরিয়ে দিতে চাইছি? ও কি ভাবছে ঐ একটা বই ই আমাদের দু’জনকে আলাদা করে দেবে? আর ভাবতে চাইছি না। মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো।
খুবই বুদ্ধি ওর বুঝি, আর অসম্ভব চাপা স্বভাবের, দেখে বোঝার উপায় নাই। চিন্তা করলাম এই সময় পাসপোর্টের কথাটা বলা বোধ হয় ঠিক হলো না। ও বিষয়টা কি ভিন্নভাবে নিলো? দেখলাম ফর্সা মুখটা থমথমে, শ্রাবণ মেঘের আভাস সারা মুখে। আকাশের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে খুব ক্ষীন স্বরে গাইছে,
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দু:খ সুখের গানে
সুর দিয়েছো তুমি আমি তোমার গান তো গাইনি
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি আমার হ্রদয় পানে চাইনি।
চমকে উঠলাম হঠাত এ গান কেনো, মনের ভিতর তো অশান্ত হয়ে উঠেছে। শুনতে শুনতে আমিও তখন কোথায় যেনো হারিয়ে গেছি, ও চলে গেলে আমার কি হবে? কেনো এমন হতে চল্লো? আর ভিন্ন পরিবেশে ওই বা কি ভাবে থাকবে? এ অবস্থায় আমি কতটুকু কি করতে পারি। ঠিক তখনই চা’ওয়ালা এসে দাঁড়ালো বল্লো, স্যার চা নাকি লাগবে, কালু পাঠালো। বুঝলাম বাদাম ওয়ালা পাঠিয়েছে। বল্লাম এ খানে দিয়ে আলমদের দেখিয়ে বল্লাম, ও খানে দিয়ে আসো। মনে মনে ভাবলাম চা ওয়ালা এই সময় এসে ভালো হলো। হয়তো ওর মনে একটু ভিন্নতা আসবে। খুব আস্তে প্রায় নি:শব্দে চা খেলো, ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। খুব করুণ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। মনে হলো যেনো আমাকে একটু আশ্বস্ত করতে চাইলো।
চা শেষ করে আলম রোজী চলে এসেছে। ততক্ষনে বুলাও নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাদাম এখনো প্রায় ধরাই আছে ওর হাতে, ঠিক মতো শেষও হয় নাই। বল্লাম, তুমি কিন্তু খাও নাই, আমাকেই শুধু দিয়েছো। চলো আরো কিছুটা দিয়ে দিই, রুমে যেয়ে খেয়ো সীমার সাথে। লক্ষ করলাম রোজীর সাথে কথা বলে একটু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে। একটু ভালো লাগলো। গেট থেকে আরো বাদাম নিয়ে ওর হাতে দিয়ে বল্লাম, হলে যেয়ে খাবে কিন্তু। কালকের জন্যে আবার রেখে দিও না। তাকিয়ে একটু হাসলো বল্লো, আমাকে হাসাতে চাচ্ছো মন ভালো করার জন্য তো বুঝেছি। তোমার এই সব আমি এখন বুঝি। হলের সামনে যেয়ে গেটের কাছ থেকে একটু সরে যেয়ে দাঁড়ালো, বল্লো কালকে বিকালে তোমার সাথে বেড়াবো। সাড়ে চার’টায় এসো আবার আজকের মতো দেরী করো না। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ