ইউসুফ কামাল : নষ্টালজিয়া এমন একটা বিষয় যা সময় বিশেষ এমন করে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে যা সহজে বোঝা যায় না। আর একবার যখন এর প্রভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ে তখন আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণই রাখা যায় না। নিমিষে নিয়ে যায় পিছনের দিনগুলোতে, তবে বেশির ভাগই সুখের স্মৃতিতে। দু:খের দিনগুলোও স্মৃতিতে আসে বৈকি যা মনকে ভারাক্রান্তও করে তোলে। সম্পর্কের গভীরতা ও পারস্পরিক সমীহতার উপরেই সম্পর্কের স্থায়ীত্বটা নির্ভর করে। মনের টানের সাথে দুজনের চাওয়াটার একটা সামঞ্জস্যতা থাকাটা খুবই জরুরি। পারস্পরিক নির্মল সম্পর্কটা টিকে থাকে পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। কয়েক যুগ পার হওয়ার পরও ভালো লাগার মানুষটার দেখা পাওয়া অথবা নিদেন পক্ষে কন্ঠস্বর শুনে হৃদয়ে ঝড় উঠার অনেক নমুনা আছে। স্বপ্ন ভেংগে গেলেও সেটা সুপ্তভাবেই মনের আসনে বসে থাকে, যাতে বোঝা যায় সাময়িক দূরত্ব সৃষ্টি হলেও মনের দূরত্ব কখনোই কমে না। বুলার মায়ের অসুস্থতা কমলো না, আগে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে হতো এখন মাঝে মাঝেই অসুস্থতার খবর আসা শুরু করলো। ছুটির পরে ক্লাশ শুরু হওয়ার পনেরো দিন পর আবার খবর আসলো অসুস্থতার। সকালে হলের প্রোভোস্টের টেলিফোনে খবর পেয়েছে। ডিপার্টমেন্টে দেখা, ডেকে নিয়ে বল্লো, সন্ধ্যার লঞ্চে ওকে তুলে দিতে হবে। একা সন্ধ্যায় সদরঘাট যেতে ভয় পায়। বল্লাম, এটা কোন বিষয়ই না, অবশ্যই যাবো। মায়ের অসুস্থতায় দারুনভাবে ভেংগে পড়েছে। মন খারাপ, সান্তনা দিলাম। মায়ের অসুস্থতার সংবাদে সব সন্তানেরেই মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। মায়ের একাকীত্ব মুহূর্তে সেই ছিলো সার্বক্ষণিক সাথী। মায়ের কষ্ট, মনোবেদনার মুহূর্তগুলোতে সেই যেন ছিলো অন্ধেরযষ্ঠি। ছুটিতে দেশে থাকলে নিজের রুমে না ঘুমিয়ে মা’র সাথেই ঘুমাতো। ফর্সা মানুষটার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে মনে হলো কিছুক্ষণ আগেও বোধ হয় কান্না কাটিও করেছে। পরিবারে ভাইয়ের বউ বাচ্চা নিয়ে ভাই যতটা পারে সংগ দেয়। কিন্তু মুলত: বুলাই মা’কে সার্বক্ষণিক সংগ দিতো।
সন্ধ্যা সাতটায় ওর মামার মালিকানাধীন বরিশালগামী লঞ্চে তুলে দিলাম। লঞ্চের সব কর্মচারী ওদের পারিবারিকভাবে পরিচিত, প্রচন্ড খাতির যতœও করে। ওর মনটা খুবই ভারাক্রান্ত, যাবার সময় সারাটা রাস্তা প্রায় নির্জীব হয়ে রিক্সায় পাশে বসে থাকলো। খুব একটা কথাও হলো না আর এ মুহূর্তে বলার মতো কোনো কথাও তো নাই, মাথার মধ্যে শুধুই মায়ের চিন্তা। সান্তনা বাক্য শুনে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন আস্থার জায়গা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। বিশ্বস্ততার পরিমানটা নিরুপন করার চেষ্টা করলো হয়তো। মনে হয় সত্যি সত্যিই প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আমার উপর, আমার নিয়ে এখন আর কোনো শংকাই ওর মধ্যে এখন কাজ করে না। পরিপূর্ণ আস্থা ও শংকাহীনতার কারণেই কেনো যেনো কখনোই ওর প্রতি আমার ভিন্ন কিছু চাওয়ার আকাংখাও গড়ে ওঠে নাই। সম্পর্কটা খুব সহজ পর্যায়ে চলে এসেছে। একমাত্র পারস্পরিক বিশ্বাসের কারণেই সম্পর্কটা এই রকম ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে গেছে। অসম্ভব রুচিবান সুন্দর একটা মানুষ যাকে মন দিয়ে, পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করা যায়। আর এই বিশ্বাসী মানুষটাকে বিশ্বাস না করাটাই যেন গর্হিত অপরাধ। বিদায় নিয়ে আসার সময় বল্লো, সাবধানে যেও, ভালো থেকো আর কাল বিকালে ফোন দিও। বল্লাম, সাবধানে থেকো আমি কাল ফোন দিবো।
মনটা খারাপ হয়ে আছে ভাবলাম পুনুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলে হয়তো মনটা ভালো হবে, ভেবে সোজা রিক্সা নিয়ে জহুরুল হক হলে চলে গেলাম। পুনু আমার এমন একটা বন্ধু ছিলো যার সাথে থাকলে সব রকমের ভরসা পাওয়া যেতো। লম্বা চওড়া মানুষটার বুক ভর্তি সাহসে ভরপুর থাকতো সব সময়। যে কোনো রকমের সমস্যায় এগিয়ে এসেছে বন্ধুদের জন্যে, বন্ধুদের জন্য আশ্চর্য রকমের সহানুভূতি ও ছিলো ওর। প্রচন্ড একগুয়ে স্বভাবের একটা মানুষ ছিলো যার জন্য তার নিজেকে অনেক সময় অনেক কষ্ট ও সহ্য করতে হয়েছে। পরিবারের জন্য বাবার মৃত্যুর পর যা করেছে শেষ সময়ে দু:খ করে বলেছে, অতীত কর্মের কোনো প্রতিদান পরিবারের কারো কাছ থেকেই পেলাম না। আমি অসুস্থ, এখনো বেঁচে আছি কিন্তু যখন থাকব না তখন যে কি হবে ভাবতেই পারছি না। জিজ্ঞেস করলো, কোথাও গিয়েছিলে নাকি? খুলে বল্লাম সব ঘটনা। বুলাকে চিনতো, আমার সাথে ঘুরতে দেখেছে অনেক দিন, ওকে অনেক পছন্দও করতো। বোন সম্পর্ক বানিয়ে ফেলেছিলো, মনে আছে দেখা হলেই বলতো, ‘বুন্ডি কেমন আছো? ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে কয়েক জনের মধ্যে ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো সব চেয়ে বেশি। এলাকার বন্ধু, জীবনের অনেক ঘটনার সাক্ষী-সাথী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও সহপাঠী, সোশিওলজী তে পড়তো আর আমি সাইকেলজীতে। ছাত্রজীবন থেকেই খুব ঘনিষ্ঠভাবেই রাজনীতির সাথে জড়িত থাকতো। চারিত্রিকভাবেও অনেক গুন ছিলো ওর মধ্যে বিশেষ করে মনের দিক দিয়ে। বল্লাম, চলো আমার বাসায় – আজকে সারারাত গল্প করবো। আমার ওখানেই খাবো সবাই মিলে। ওকে নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে রিক্সা নিয়ে চক্বাজারের ‘খাওয়াদাওয়া’ থেকে তিন প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে চলে আসলাম বকশীবাজার উমেশ দত্ত রোডের বাসায়। জিলু তো পনু কে দেখেই বুঝে ফেলেছে, রাতে ম্যারাথন আড্ডা হবে। ঝটপট তিনটা প্লেট, গøাস রেডি করে ফেল্লো। সাথে ২/৩ প্যাকেট সিগারেট।
হায়, আমার খুব কাছের ঐ দুজন মানুষই আজ আর নাই, বড় অসময়ে চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে সৃষ্টিকর্তার ডাকে। আমার অনেক কাছের মানুষ ছিলো ওরা, ওদের সাথে আমার এত স্মৃতি যে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ওদেরকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না। পরদিন ক্লাশে যেতে একটু দেরী হয়ে গেলো, যেতেই বিদ্যুৎ বল্লো, সাফায়েত ভাই আমাকে খুঁজে গেছে। বিদ্যুৎকে সাথে নিয়ে বুলাকে টেলিফোন করতে গেলাম। নিউমার্কেটের পিছন দিকে ও টেলিফোনের একটা অফিস ছিলো, ওখান থেকে দ্রুততর সময়ে বিভিন্ন স্থানে কল করা যেতো। ওর বাসায় কল করে জানলাম বুলা তার মায়ের কাছে মেডিকেল হাসপাতালে, কথা হলো না, ফিরে আসলাম কলা ভবনে। দেখি সাফায়েত ভাই নীচে দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল ষ্ট্যান্ডে। বল্লেন বুলার মার অবস্থা খুব খারাপ, ওর ভাই ফোন করেছিলো। গ্রীন রোডে তখন ‘কেয়ার’ এর অফিস, ওখানে যেয়ে বল্লে ওরা লন্ডন অফিসে খবর পাঠিয়ে দেবে, সম্ভবত বুলার বাবার আসা দরকার। বরিশাল মেডিকেলে ভর্তি, অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে। মনে হয় চরম দু:সংবাদই হয়তো অপেক্ষা করছে ওদের পরিবারের জন্য। সাফায়েত ভাই বল্লেন, চলো আমার সাথে। গ্রীন রোড যেতে হবে। কেয়ার’ অফিসে যেয়ে ওর বাবার এক বন্ধুর সাথে কথা বল্লেন সাফায়েত ভাই। বল্লেন সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন উনি চলে আসেন। অবস্থা ভালো না।
ওর বাবা লন্ডন থেকে আসার চার দিনের মাথায় বুলার মা চলে গেলেন। সাফায়েত ভাই মারফত খবরটা পেলাম। ভাবলাম এখন কি হবে? পরদিন সাফায়েত ভাইয়ের সাথে ডিপার্টমেন্টে দেখা বল্লাম, শেষ খবর কি? বল্লেন, এখনো কারো সাথে কথা হয়নি, দু’একদিন যাক। মায়ের মিলাদের পরে বোঝা যাবে পরিবারের সিদ্ধান্ত কি হয় …. (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র