ইউসুফ কামাল : চার.
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ছুটির দিনের কারণেই ঘুমের পরিমাণটা কেনো জানি অকারণেই বেড়ে যায়। আকাশটাও মেঘলা মনে হোল। কাছে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস আসছে। হেমন্তের ঢাকা শহর। কেন যেন মনে হলো এবার শীতটা বোধ হয় একটু তাড়াতাড়িই আসবে। কালকে রাতে বাসায় ফেরার সময় রিক্সাতে ভালোই ঠান্ডা লাগছিলো। কত বাজে? ঘড়িটা টেনে নিলাম… সোয়া দশ। দরোজা খুলে বারান্দায় এলাম, হাল্কা ঠান্ডার একটা পরশ সারা শরীরে বুলিয়ে দিলো।
যা ভেবেছিলাম তাই। সামনের বাড়ীর দোতালার এ দিকের রুমের জানালার ভারী পর্দাটা দুলছে। মনে হলো কেউ একজন আশেপাশে হাঁটাহাটি করছে। বাড়ীর মালিক পুরোনো ঢাকার নামকরা এক হোটেল ব্যাবসায়ী। বেশ কিছু দিন ধরেই লক্ষ করছি বিষয়টা। প্রথম দিকে লক্ষ্য করিনি কিন্তু একসময় ঠিকই বুঝলাম।
সেদিন সকাল ন’টার ক্লাশ ধরবো বলে তাড়াহুড়ো করে বেরুচ্ছি। দেখি জানালায় নীল ছায়া, তাকিয়ে আছে এ দিকেই। পূর্ণ অবয়বে দেখলাম যথারিতি সেই নীল ওড়না। সরে যাওয়ার কথা হলেও গেলো না, বরং তাকিয়েই থাকলো বুঝলাম সরতে চাচ্ছে না। বিষয়টা একটু ভাবালো, ভাবলাম বিষয়টা কি একটু দেখতে হয়।
রাতে বাসায় ফিরলাম বড় বোন ডেকে পাঠালো। দেখি ডাইনিং টেবিলে অনেক অনেক খাবার। মোরগ পোলাও, মিষ্টি। আপা হাস্যজ্জল মুখে বললো, সামনের বাসা থেকে। নাও তোমার জন্য পাঠালো। আপা আমার মনের ভাষা পড়তে চেষ্টা করলো। পুরোন ঢাকার নাম করা হোটেলের মালিক ওরা। বুঝে ফেললাম ঢাকার নিয়ম নীতি এই। বললাম তোমরা খাও, আমি খেয়ে এসেছি হল থেকে। আপা যা বোঝার বুঝে ফেললেন মনে হলো , উনি আর কথা বাড়ালেন না। নীলাম্বরীর দেখা পরবর্তিতে একবার হয়েছিলো সেটাও জীবনের একটা মাইল ফলকই বলা যায়।
ধীরে ধীরে ক্লাশের সবার সাথেই সখ্যতা গড়ে উঠছে। মেহেরপুরের সামাদ (পরাগ), ঢাকার নাসিম, নাসির (মোরগ মার্কা ), মুসা, বাবু, টাংগাইলের লিটন, সাভারের প্রভাবশালী দেওয়ান পরিবারের সন্তান মান্নান, নারায়ণগঞ্জের মামুন, গোপালগঞ্জের আলম, ভুরুংগামারীর সেকান্দর এমনি আরো অনেক। বন্ধুত্ব্র্রের মাপকাঠিতে কারো সাথে অন্তরঙ্গতা বেশী বা কারো সাথে গভীর হয়। তবু সবাই বন্ধু। কিছু দিনের মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম সময়ের সাথ সাথে যেন সম্পর্কের ছোট ছোট বলয় সৃষ্টি হতে চললো মধুর সম্পর্কের দিকে। ক্লাশের বিরতিতে আগে সবাই যেমন এক সাথে গল্পে মেতে উঠতাম ২/৩ মাস পর থেকেই তার সংখ্যা কমতে শুরু করলো। কুশলী কেউ আবার ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের দিকেও চলা ফেরা শুরু করলো। বন্ধু আলম যাতায়াত শুরু করলো জুয়োলজী ডিপার্টমেন্টের দিকে।
প্রথম প্রথম দুপুরে এক সাথে টিএসসি’তে লাঞ্চ করতাম আমরা ১০/১২ জন যারা হলের বাইরে থাকতাম। কিছুদিন পর দেখলাম আমরা ৩/৪ ছাড়া অন্যরা অন্য টেবিলে যাওয়া শুরু করলো। ঘটনাটা বুঝতে দেরী হলো না। পারস্পরিক আকর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। সবাই যোগ ফল অন্বেষণে ব্যাস্ত। জীবনের বাস্তবতা খুঁজতেই ব্যস্ত যেনো!
বন্ধু লিটন দুইদিন সময় পেলেই টাংগাইল চলে যেতো তার মনের মানুষের সান্নিধ্যের আশায়। আমি, বিদ্যুৎ আর লিটন মোটামুটি তিনজন দীর্ঘদিন এক সাথেই থাকতাম। লিটন হলে সিট না পাওয়া পর্যন্ত দুপুরে আমাদের সাথেই থাকতো। আমি বক্শী বাজার আর বিদ্যুৎ আসতো বাসাবো থেকে। দেড়টার ক্লাশ শেষে লিটন প্রায়ই দুপুরে বাসে গুলিস্থান যেতো। আমরা টিএসসি’তে বসে থাকতাম স্লিপ কেটে ওর অপেক্ষায়। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসতো রিক্সায়। মুখের হাসির পরিধি দেখে বোঝা যেতো মামার সাথে কেমন দেখা হয়েছে। বলতো চলো খেয়ে আসি। খুবই দিল খোলা ছিলো সেই দিনগুলোয়। সেই মানুষই কালের আবর্তে আমেরিকার এক শহরে বাস করেও সামান্য ২০ মিনিটের ড্রাইভেও দেখা করতে ভুলে যায়। সময় কি মানুষের মনের সুকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট করে দেয়? সেই লিটন এখন আমেরিকার বাফেলো তে একাকী অবসর জীবন যাপন করছে।
রাত্রিকালীন শেষ জমজমাট গল্পের আসরটা হতো নীলক্ষেতের বিউটি রেষ্টুরেন্টের শেষের দুইটা টেবিল একত্র করে। হলের ছাত্র তাই সব হাল্কা কষ্ট মালিক সহ্য করে নিতো, তবে বিলের টাকা যথাযত ভাবে দিয়ে দিতাম বলে কখনো ই মুখটা কালো করতো না। গল্প শেষে যখন বেরোতাম তখন নিউমার্কেটের ভীড় শেষ। রিক্সা নিয়ে বুয়েটের ভিতর দিয়ে বক্শীবাজারের পথ ধরতাম। বিদ্যুৎ বাসাবোর পথে রওনা দিতো।
নাসিম-সায়মা চলে গেল আইইআর এ, সামাদ-লাকী চলে গেলো ভিন্ন টেবিলে, মধু চলে গেল বেলাকে নিয়ে অন্যত্র আর মান্নান – মমতা যে কোথায় চলে যেত মটর বাইকে কোন সময় জানতেও চাইনি। এমনি করেই যেন বৃহত্তর পরিবারে ভাংগনের শব্দ পরিস্কার হয়ে উঠলো। কিছুদিন আগে জানলাম মান্নান বিদায় নিয়ে চলে গেছে পৃথিবী থেকে।
ভর্তির ২ মাস পর ক্লাশের পর বিদ্যুৎ বললো, লিটন এলাকার এক বড় ভাইয়ের রুমে থাকতো এখন তাকে রুম ছাড়তে হবে। তুমি কি কিছুদিন ওকে রাখতে পারবে তোমার বাসায়? দেরী না করেই লিটনকে বললাম, তুমি আমার সাথে থাকতে পারো। দুদিন পরে লিটনের অন্যত্র ব্যবস্হা হওয়াতে লিটনের অনুরোধেই ম, সামাদ চলে আসলো আমার বাসায়। মেনে নিলাম সহজে। বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে কোনো ভিন্ন স্বার্থ থাকে না এটাই বিশ্বাস করতাম দীর্ঘ দিন, কিন্তু সেটার মধ্যে কোন অংশীদারের আগমনে সেটাতে যে ঘুণ ধরে বুঝলাম সামাদকে দিয়েই। ক্লাশ ছাড়া সারাক্ষণই কাটাতো বেছে নেওয়া সাথীর সাথে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন বন্ধুত্ব। শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেও সময় দিতো না সামাদ। বন্ধুত্ব কি এতই ভংগুর? সেই ম. সামাদ পরবর্তি জীবনে প্রশাসন ক্যাডারে চাকুরী শেষ করে অবসরে আছে।
একটা গানের অনুষ্ঠানে গিয়ছিলাম কার্জন হলে। হেঁটে ফিরছিলাম দোয়েল চত্বর পার হয়ে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে। কি একটা বিষয় নিতে আলাপ চারিতায় ব্যাস্ত ছিলো আলম আর সেকান্দার। আলম সবসময়েই একটু বেশী কথা বলতে ভালবাসতো। এলাকার প্রভাবের কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সে একটু বেশী প্রাধান্য আশা করতো সব সময়। আমরা ২/৩জন একটু এগিয়ে গেছি হঠাৎ কি একটা শব্দে পিছন ফিরে দেখি রাস্তার পাশের তার কাটা বেড়ার উপর আলমকে ফেলে দিল সেকান্দার। প্রচন্ড রেগে মারতে উদ্যতও। দৌড়ে এলাম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম ওঁকে। পাগল হয়ে গেল নাকি? বুঝলাম তেমন কিছুই না সামান্য কথা কাটাকাটি। লম্বা চওড়া সেকান্দার চালচলনে ধীরস্থির হলেও ভিতরে ভিতরে একটু গোয়ার্তুমী ভাব ছিলো। মাসের প্রথম দিকে বাড়ী থেকে টাকা আসলেই ওরে আর হলে খুঁজে পাওয়া যেতো না যতক্ষণ টাকা শেষ না হয়। এখন নাকি রংপুরেই স্থিতি হয়েছে।
ফিরে এলাম কলাভবনে, শাফায়েত ভাইয়ের উপর বিচারে ভার দিলাম। বরিশালের মানুষ রাশভারী কন্ঠে অনেকক্ষণ জ্ঞানগর্ভ কথার পর বিচারের রায় হলো-পাঁচ জনকে রাতে চাইনিজ খাওয়াবে সেকান্দার। দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরলো, দুজনের চোখেই পানি। পরবর্তি জীবনে দুজনই আয়কর বিভাগের উচ্চ পদে চাকরী করে অবসরে চলে গেছে।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা