ইউসুফ কামাল : অনগ্রসর জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার এক মহান ব্রত নিয়ে ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ্সহ কয়েকজন শিক্ষানুরাগী এগিয়ে আসেন। তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন জাতীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলার কোনো বিকল্প নাই, তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিন্জ বাংলার এই অনগ্রসর অঞ্চলে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জন্য বৃটিশ সরকারের উচ্চ মহলে প্রস্তাব পাঠান। দীর্ঘ আলোচনার পর নওয়াব স্যার সলিমুলিলাহ্ নিজে তার এস্টেটের ৬০০ একরের মতো জমি এই বিদ্যাপীঠের জন্য দান করেন। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর ১৯২১ সালে কার্জন হল প্রতিষ্ঠা হয় আর ঐ বছরের ১লা জুলাই কলা, বিজ্ঞান আর আইন বিভাগ- এই তিন বিভাগ নিয়ে প্রথম পাঠ্যকার্যক্রম শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়রে প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম ভাইস চ্যাঞ্চেলর ছিলেন ফিলিপ যোশেফ হার্টগ। হাইকোর্টের বিপরীতের লাল রংয়ের ঐ উঁচু ভবনটিই হলো (নীচে ছবি) কার্জন হল। তৎকালে উচ্চ শিক্ষার প্রতীক হিসেবে সবাই এটার মূল্যায়ন করতেন। ঐ ভবনের নীচ তলার হল রুমে বসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দেবার সৌভাগ্য হয়েছিল বলে এখনো গর্বিত বোধ করি। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার নিমিত্তে প্রাথমিক স্তরে নবাব সলিমুল্লাহ্ এর নামে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল, ঢাকা হল ও হিন্দু ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল তৈরী করা হয়। অত্র এলাকাধীন মেডিকেল কলেজ, আহ্সানউল্লাহ্ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পরবর্তি কালের বুয়েট, হোটেল শাহবাগ পরবর্তিকালে পিজি হাসপাতালের সমস্ত জায়গায়ই নওয়াব পরিবারের দান করা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও কোন প্রস্তর খন্ডেও লেখা নেই এই দানবীর মহান পুরুষের নাম। কৃতজ্ঞতাবোধের এত অভাব আমাদের মধ্যে। জাতি হিসেবে কেনো যেনো বড়ই অকৃতজ্ঞ আমরা। বড়কে কোনো দিনই সন্মান দিতে শিখলাম না। অন্যকে সন্মান না দিলে যে নিজেও সন্মান পাওয়া যায় না সেটাও জানলাম না।

তিন/চার দিন হলো ছুটি হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়। সমস্ত ছাত্রাবাস, ছাত্রী বাস মোটামুটি শূন্য হয়ে গেছে দু’তিন দিনেই। চারদিকের ব্যস্ততা হুই হুল্লোড় যেন ভোজবাজির মতোই উড়ে গেছে। কিছু রিক্সা যাত্রী নিয়ে এপার ওপার করা ছাড়া আর কোনও খালি রিক্সাও সহজে এখানে পাওয়া যায় না। দিন দুই পর শাহবাগ থেকে বাসায় ফেরার পথে অজান্তেই চোখ চলে গেল ডানের শামসুন্নাহার হলের দিকে।

মনে হলো গেটের সামনে সুন্দর একটা মানুষ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার ভালো করে তাকালাম না কেউ তো ওখানে নেই। বড় লোহার গেটটা তো বন্ধই তবে আমি কি ভুল দেখলাম… আমি কি অবচেতন মনে সর্বক্ষণ বুলার উপস্থিতি অনুভব করে যাচ্ছি? এটা একধরনের হ্যালুসিনেশান বা মতিভ্রম যা চোখের ভ্রম বলে মনে হয়। হঠাৎ করে মনে হয় কিন্তু বাস্তবে সেটা নাই। বাস্তব ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশন বা মতিভ্রম কোনো অসুখ নয়, এটাকে একটা উপসর্গ হিসাবে ধরা যেতে পারে। একজন ব্যাক্তি কোনো উদ্দীপক ছাড়াই অন্য ব্যাক্তির শব্দ, স্পর্শ বা উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। অবচেতন মনে সার্বক্ষণিক কারো কথা মনের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকলে এটা হয়ে থাকে।

মস্তিস্কের মধ্যে সারাক্ষণ যদি ঘুরতে থাকে তাহলে এটার বলয়ের বাইরে তার আসা তো রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার। এটি ডিমেনশিয়া বা ডিলিরিয়ামসহ একাধিক মানসিক এবং তৎসম্পর্কিত চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত। অনেক রকম হ্যালুশিনেসনের মধ্যে অন্য মানুষের উপস্থিতি, স্পর্শ বা আলোর ঝলক দেখতে পাওয়া যায় যা বাস্তবে অনুপস্থিত। বয়সবৃদ্ধির সাথে এটার উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। সেটার বিষয় অবশ্য স্নায়ুবিক দুর্বলতার কারণ। হ্যালুশিনেসনের কারণে – শব্দ বা পরিচিত কারো ডাক, পরিচিত কোনো দৃশ্যের বা ইপ্সিত ব্যাক্তির কাল্পনিক উপস্থিতি, পরিচিত কোনো ঘ্রাণ বা কারো কাল্পনিক স্পর্শ অনুভব করা ।
টিকিট নিয়ে মতিঝিল বিমান অপিস থেকে বের হতেই দুপুর হয়ে গেলো। খাওয়ার ব্যাপারটা মতিঝিলের এক হোটেলে সেরেই রিক্সা নিয়ে চলে এলাম আলমের হলে। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে স্বাভাবিকভাবেই হলের ডাইনিং বন্ধ হয়ে যায়, যারা তখনও হলে থাকে খাওয়ার ব্যাপারটা তারা নিজেরা বাইরের হোটেলেই সেরে নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকাকালীন অবস্থায় কর্তৃপক্ষ প্রতিটা হলের আবাসিক ছাত্র হিসাব করে সেই হিসাবে ভর্তুকি দরে চাল ডাল তেল সরবরাহ করে। আর এই ভর্তুকির টাকাটা হিসেব করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই বহন করে। আর এই কারণেই খাবারের মূল্য কম হয়, তাতে আবাসিক ছাত্ররা কম মূল্যে খাবার পায়। ভিসা টিকিট এর ঝামেলা শেষে সাত রোজায় আমাদের রওয়ানার দিন ঠিক হলো। কথা হলো সকাল ১০টায় বিমান ছেড়ে যাবে, দুই ঘন্টা আগে রিপোর্টিং টাইম। সবাই যার যার মতো বিমানবন্দরে চলে যাবে। তখনো তেজগাঁও বিমানবন্দরই ঢাকার সাথে সমস্ত বহির্বিশ্বের আকাশপথে যাগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। সেকান্দরকে বলে রাখলাম আলমের হলে এসে দুজন এক সাথে রওয়ানা দিতে। ওঁকে নিয়েই সব সময় দুশ্চিন্তা, ঢিমে তালে চলা মানুষ তাছাড়া কোনো কাজ কেই সে কখনোই সিরিয়াসলি নেয় না। বকশীবাজার বাসা থেকে একটু আগেই বেরোলাম। বড় বোন আগের দিন ড্রাইভার করিম মিয়াকে বলে দিয়েছিলেন আমাকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে আসতে। তখনো ঢাকার রাস্তাঘাট যথেষ্ট ফাঁকা। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা খুবই কম, কিছু মুড়ির টিনের মতো বাস আর প্রগতির সুপিরয় নামে স্বল্প সংখ্যক বাসও রাস্তায় দেখা যেতো। প্রচুর রিক্সার সাথে স্বল্প সংখ্যক বেবী ট্যাক্সিও পাল্লা দিয়ে চলাচল করতো। ওরা কেউই তখনও আসেনি, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পায়চারী করতে করতে মিনিট দশেকের মধ্যেই সবাই চলে আসলো। সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বিদেশ সফর তার উপর প্রথম বিমান যাত্রা, মুখে হাসি ভাব থাকলেও ভিতরে একটা শংকা তো আছেই।

ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে যেয়ে বসলাম। যাত্রীদের মধ্যে কয়েকটি পরিবার আর বয়স্ক লোকজনই বেশি। অল্প বয়স্কের ভিতরে আমরাই চারজন। জনা চল্লিশ এর মত যাত্রী নিয়ে সঠিক সময়েই বিমান যাত্রা শুরু করলো। স্বল্প পাল্লার ভ্রমণে হাল্কা নাস্তা আর চা কফি দিয়ে আপ্যায়ন শেষ করে দিলো। ওঠা নামা মিলিয়ে প্রায় একঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কোলকাতায়। বিমানের বোর্ডিংপাসে সিট নাম্বারে সেকান্দার আর আলম পাশাপাশি। কোলকাতা নিউমার্কেট এলাকার হোটেলগুলোতেই বাংলাদেশীদের আনাগোনা বেশি ছিলো। ওখানের হোটেল ব্রাইটনে পাশাপাশি দুইটা রুম নিয়ে উঠে পড়লাম। বিমানের পাশাপাশি সীটের মতোই রুম মেট হিসেবে সেকেন্দারের পছন্দ ছিলো আলম, সে ভাবেই দুই জন করে দুই রুমে উঠে পড়লাম। হোটেলের সামনের রাস্তার উল্টোদিকেই খাবার হোটেল ‘কস্তুরী’। বাংলাদেশীদের প্রিয় রেস্টুরেন্ট, ভোজন রসিক সেকান্দর তো মহাখুশী এই খাবার হোটেল দেখে, মনে হয় ওর ক্ষিধে টাও বেড়ে গেলো। (চলবে)
হিউষ্টন, টেক্সাস