ইউসুফ কামাল : সাড়ে ন’টার দিকে বাসা থেকে বেরোলাম। আজকে ছুটির আগের শেষ দিন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, কাল থেকেই সবার সবরকম কোলাহল থেমে যাবে ক্যাম্পাস জুড়ে। শুনশান নিরবতা নেমে আসবে সারা এলাকায়, আস্তে আস্তে হলগুলো খালি হয়ে আসবে, রাতের আলোয় পুরো এলাকা রূপ নেবে এক ভুতুড়ে চেহারায়। টিএসসি’র গেটে বিদ্যুত দাঁড়িয়ে আছে একা, আমার আসার অপেক্ষায়। কাছে যেয়ে বল্লাম, ওঠো। রিক্সা রোকেয়া হল বামে রেখে নীলক্ষেত পার হয়ে ধানমন্ডি ২ নং সড়কে যেয়ে পৌঁছালো। চার/পাঁচটা বাড়ির পরেই ডান দিকে তখন ভারতীয় দুতাবাসের অফিস। গেট দিয়ে ঢুকলেই রিসেপশন, অমিত চক্রবর্তীকে দরকার বলতেই স্মার্ট মহিলা বসতে বলে ইন্টারকমের বোতাম টিপে মনে হয় আমাদের কথা বল্লেন। সোফায় অপেক্ষা করার কয়েক মিনিটের মাথায় অমিত’দা চলে এলেন, হাতে একটা এনভেলাপ, বুঝলাম ভিসা ফর্ম। প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে পাশের বড় একটা রুমে নিয়ে গেলেন চা খাওয়ানোর জন্য, বল্লেন, ২/৩ দিনের মধ্যে সব রেডী করে দিও, ভিসা হয়ে যাবে। আমার কাছ থেকে ৪/৫ দিন পর পাসপোর্ট নিয়ে যেয়ো। অমায়িক ভদ্রলোক, এত উচ্ছল আর প্রাণবন্ত মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি জীবনে। মাঝে মাঝেই আই ই আর এর ক্যান্টিনে নিছক আমাদের সাথে আড্ডা মারতেই চলে আসতেন। ফর্ম নিয়ে চলে এলাম। বিদ্যুত, আলম আর সেকান্দারকে ফর্ম বুঝিয়ে দিলো কিন্তু বোঝা গেল সেকান্দর-এর ফর্মটা আমাদেরকেই ফিলাপ করে দিতে হবে। আলমকে বল্লাম বন্ধু সেকান্দর-এর ফর্মটা ফিলাপ-এর ব্যাপারে সাহায্য করো পরশুর মধ্যে। সব রেডী করে অমিত’দার হাতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। তা হলেই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যাবে যে এই সপ্তাহেই ভিসা হবে। পরবর্তি কাজ হলো, প্লেনের টিকিট বুক করা।
ডিপার্টমেন্টে ছুটির আগের দিন তেমন ক্লাশ হয় না, পড়াশুনার যা সাজেশান থাকে তা আগেই বলে দেওয়া হয়। ডিপার্টমেন্ট লাইব্রেরিতে দেখলাম ভীড়টা বেশি। পিছন দিকটায় সাফায়েত ভাই কয়েকজনকে নিয়ে বসে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই হাত নাড়লো। এগিয়ে গেলাম বল্লেন, দেশে যাচ্ছো কবে? বল্লাম, রোজার মাঝামাঝি হয়তো যাবো। বল্লেন, বেড়াতে যাচ্ছো শুনলাম, কোথায় যাচ্ছো? বল্লাম, ইচ্ছা আছে ইন্ডিয়া যাবো। আপনি যাবেন নাকি? চলেন যাই। সাফায়েত ভাই বল্লেন, আমার তো সময়েরই সমস্যা। তুমি তো জানো, আমাকে ব্যবসার ঢাকার অংশগুলো দেখতে হয়। আমি জানি উনাদের কার্গোর ব্যবসা, বরিশালের অফিস বড় ভাই দেখেন। ঢাকার কাজগুলো উনাদের নর্থব্রুক হল রোডের অফিস থেকে সাফায়েত ভাই-ই দেখেন। বল্লাম, ভাই আপনার জন্য কিছু আনতে হবে? জোরে হেসে উঠলেন বল্লেন, তোমরা সাবধানে যেও, ভালো মতো ফিরে এসো। পারলে কথা বলো ওখান থেকে তাতেই চলবে। হঠাত করে কি যেনো মনে করে উঠে এলেন, হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গেলেন আস্তে আস্তে বল্লেন, কোনো সমস্যা নাই তো? সমস্যা থাকলে বলো। কি বলতে চাইলেন বুঝে ফেল্লাম। বল্লাম, না সমস্যা নাই। সমস্যা হবে কেনো? সত্যিই আশ্চর্য মানুষটা। যে কারণে সারা জীবনে মানুষটারে ভুলতে পারিনি। কোনো চাহিদা নাই, কোনো প্রাপ্তির আশা নাই। বন্ধু না কিন্তু তার চেয়েও বড়। পরিচ্ছন্ন সাদা মনের মানুষটা আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক ঘটনার সাথী তাই তো স্মৃতির অনেক খানি জায়গা জুড়েই উনি আছেন। সেটা কেউ না জানলেও একমাত্র আমিই জানি।
আশেপাশে তাকালাম কোথাও বুলাকে দেখা যাচ্ছে না। একটু দূরে দেখলাম ওর সহপাঠী রুমমেট সীমা এ দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মনে হলো আমাকে কিছু বলতে চায়। আমার এগিয়ে যাওয়া দেখে সীমাও এগিয়ে আসলো বল্লাম, বুলা কই? সীমার কথায় বুঝলাম ওর বড় ভাই সকালে হল থেকে ওঁকে নিয়ে গেছে বাড়ির সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। বল্লো, আপনাকে বলতে বলেছে, কাজ শেষ হলেই ও ডিপার্টমেন্টে চলে আসবে। মনটা একটু বিষন্ন হয়ে গেলো? যদি দেখা না হয়? হয়তো সময় করে উঠতে পারলো না। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা মাথার মধ্যে ভীড় করে থাকলো। দীর্ঘ দিনের ছুটিতে বন্ধুরা সব চলে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে। লম্বা দিনের জন্য দেখা হবে না তাই তো বিদায়ের পর্বও প্রায় সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। কেউ আবার ঈদের দু’এক দিন আগে হয়তো যাবে। হলের সবাই চলে গেলেও কেউ কেউ কিন্তু থেকেই যায়। এমনকি দু’এক জন কপালপোড়া ঈদের দিনেও হলে থাকে যাদের সত্যিই কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। ভাগ্যহীনা এদের দেখলে খুবই খারাপ লাগে। দুই’টা বেজে চল্লো বিদ্যুত বল্লো, চলো খেতে যাই। মানেই টি এস সি-তে, ঘাড় নেড়ে সম্বতি জানালাম। হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর গেট দিয়ে বেরিয়ে টি এস সি-তে ঢুকবো, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের সামনে এসে মনে হলো সিগারেট তো শেষ।
শরীফ ভাই সিগারেট দেন তো দশ’টা- বলে মানিব্যাগ বের করতে পকেটে হাত দিতেই মনে হলো কে যেন গা ঘেসে এসে দাঁড়ালো। ঘুড়ে দাঁড়াতে একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেলো। বুলা। বল্লো, চলে যাচ্ছিলে? আমি কাজ শেষ করেই চলে আসবো, সীমাকে বলতে বলেছিলাম, ও বলেনি? কেনো যেনো কথা বলতে পারছিলাম না, গলা থেকে যেন স্বর বেরোচ্ছে না। আস্তে বল্লাম, এতক্ষণই তো ছিলাম। তুমি কোথায় ছিলে বলো তো! আমি তো ভেবেছি তোমার সাথে যাওয়ার আগে দেখা হয় কিনা! আমার কথার মধ্যে কি কিছু প্রকাশ পেলো! খুব নিবিড়ভাবে আমার দিকে তাকালো, বোধ হয় মনের কথা পড়তে চেষ্টা করলো। বল্লো, ভাইয়াকে বলে তাড়াহুড়ো করেই চলে এসেছি, বলেছি ডিপার্টমেন্টের কাজ আছে। বল্লাম চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু খাওনি। খাবে চলো। সুন্দর মুখটায় যেনো আষাঢ়ে মেঘের ছায়া। অস্ফুট স্বরে শুধু বল্লো, চলো। আমি তো তোমার জন্যেই তাড়াতাড়ি করে চলে এসেছি। বিদ্যুত একটু এগিয়ে গেলো খাওয়ার স্লিপ কাটার জন্য। ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকার মুখে আলম রোজীর সাথে দেখা, ওরা খেয়ে বেরোচ্ছে। রোজী এর মধ্যেই জেনে গেছে বিষয়টা, আমাকে বল্লো, অপেক্ষা করছি দোতালায় আপনারা খেয়ে আসেন, গল্প করবো। বুলা রোজী দুজনেই শামসুন্নাহার এ থাকে, আগে থেকেই মুখচেনা ছিলো তবে একটু জুনিয়র বলে একটু দূরত্ব রেখেই চলতো। বুলার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লো, কি হয়েছে? গম্ভীর কেনো? মন খারাপ? রোজীর কথায় কিছুটা মমতা মাখানো সহমর্মিতা। মনে হলো বুলা তাতে আরো একটু বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলো, লক্ষ্য করলাম মুখটা ঘুরিয়ে শূন্যে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
শূন্যতার মাঝে যেন নিজের মনের শূন্যতাকে খুঁজে ফেরা। এও যেন কষ্টের কাছে আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। বেচারার জন্য মায়াই লাগলো, সত্যিই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে আমার প্রতি। সম্পর্কের গভীরতা তখনই বোঝা যায় যখন বাইরের কারো উপস্থিতিতেও সে সাবলিল থাকতে পারে না। বুঝতে পারলাম ও প্রচন্ড আবেগ প্রবণ একটা মানুষ। কাল চলে যাবে এটাও দারুণভাবে মনের মধ্যে কাজ করছে। কিছু বলতেও পারছে না আবার যেতেও হবে সেটাও ঠেকাতে পারছে না। ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেড়িয়ে বল্লো, দোতলায় তোমার বন্ধু অপেক্ষা করছে যাবে না? বল্লাম, চলো। আলম রোজী আমাদের অপেক্ষা করছে। দোতলা মোটামুটি ফাঁকা আজকে, গান গাওয়ার কেউই নাই, এক পাশে কার্পেটের উপর হারমেনিয়াম আর তবলা, বিদ্যুত আমার দিকে তাকালো বল্লো, হবে নাকি? জোরে হেসে বল্লাম, আমি কি গান গাইতে পারি? আমার কথায় বুলা হয়তো কিছু বুঝে ফেল্লো কাছে এসে খুব আস্তে বল্লো, গান শুনতে চাও তুমি? বল্লাম, অসুবিধা না হলে গাও। রোজী ওর গান শুনেছে সে দিন উত্সাহ দিয়ে বল্লো, ভালোই হবে। বিদ্যুত বসে গেলো তবলায়।
আমি তোমার প্রেমে হবে সবার কলংক ভাগী
আমি সকল দাগে হবো দাগী কলংক ভাগী
তোমার পথের কাটা করবো চয়ন সেথায় তোমার ধুলায় শয়ন
সেথায় আচঁল পাতবো আমার তোমার রাগে অনুরাগে কলংকভাগী
আমি সূচী আসন টেনে টেনে বেড়াবো না বিধান মেনে
যে পংকে ঐ চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বুকে মাগী
কলংকভাগী।
কেনো যে কষ্টের গানগুলো ও গায় বুঝি না। সবার সাথে টি এস সি থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর হলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওর গাওয়া গানের লাইনগুলো যেন মনের মধ্যে বেজেই চলেছে, সেথায় আচঁল পাতবো আমার। তোমার রাগে অনুরাগে কলংকভাগী। বিদায়ের মূহূর্তে সবারই মনে হয় আবেগটা চোখের মধ্যে এসে ভর করে। বিদায়ের মূহূর্তে একটা বিরতি নিয়ে গভীরভাবে আমার দিকে তাকালো, বল্লো, ভালো থেকো।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : হিউষ্টন, টেক্সাস, আমেরিকা