ইউসুফ কামাল : প্রস্তাবটি বিদ্যুৎ-এর। বিশ্ববিদ্যালয় রোজার লম্বা ছুটি, ছুটিতে দূরে কোথাও যাওয়া যায় কিনা? ভারত বেড়ানোর বিষয়টিও ওরই। দুদিন ভাবার পর বল্লাম, সবাইকে বলো। কে কে যাবে, কত দিনের জন্য সব কিছু দেখো। আলমের হলে বসলাম বিকেলের দিকে। প্রস্তাবের উপর আলোচনা শুরু হলো। ঝামেলা ছাড়াই সবাই রাজি। ৪/৫ দিনের মধ্যে সবাই পাসপোর্ট এনে রাখবে। কাছেই ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস, ওখান থেকে ভিসা ফর্ম এনে সেটা ফিলাপ করে বিদ্যুৎ-এর হাতে দিতে হবে জমা দেবার জন্য। আলম, বিদ্যুৎ, আমি আর সেকান্দর মোটামুটি যাওয়ার বিষয়ে একমত হলাম। টাকা পয়সার ব্যাপারে কারোই তেমন সমস্যা নাই জানতাম। ধানমন্ডির ২নং সড়কে তখন ভারতীয় দুতাবাস, ওখানে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার ২ দিন পর ওরা ভিসা দেয়।

বিমানে যাওয়ার ব্যাপারেও সবারই একটা ইচ্ছা কাজ করছিলো তাই সেটাই চূড়ান্ত ধরে সিদ্ধান্ত হলো। সড়ক যোগে বর্ডার পার হওয়ার মধ্যে নানান ঝামেলাও কাজ করে। তাছাড়া বিমানের ভাড়াও খুব বেশি না, রিটার্ন টিকিটসহ সর্বসাকুল্যে খরচ ছয়’শ টাকার মতন পড়বে। বিমানে যাবো কোলকাতা সেখান থেকে ট্রেনে দিল্লী, পরে সড়ক পথে শিমলা। সিনিয়র মুস্তাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে মোটামুটি একটা ধারণা নিলাম, রাস্তার ও আনুঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের। এতে মোটামুটি একটা বাজেটও সবাই করে ফেলেছে মনে মনে।

তিনদিন পর দেখা হলো বুলার সাথে ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরির সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে এলো আষাঢ়ে মেঘের মত মুখ চোখে অনেক প্রশ্ন বল্লাম, কেমন আছো? উত্তর দিলো না বরং মুখটা আরো গম্ভীর মনে হলো। কোনো কথা না বলে কড়িডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো, এগিয়ে গিয়ে আমিও ওর পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলাম। ভবনের শেষ মাথায় যেয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো, বল্লো, কবে যাচ্ছো বেড়াতে? আমাকে জানাওনি তো! বাড়ি যাওয়ার আগেও তো জানিয়ে গেলে না? বুঝলাম আষাঢ়ে মেঘের কারণ। বল্লাম, পরশু ভোরে বাড়িতে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট আনতে। তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলাম, রাতে তোমাকে তো হলে ডাকা যাবে না তবু বিদ্যুৎকে বলে গিয়েছিলাম সকালে তোমাকে জানানোর জন্য। বিদ্যুৎ তাকে বলেছে তাই মন খারাপ, মনে হলো কিছুটা মেঘ কাটলো। বল্লো, এখন ক্লাশ আছে? মাথা নাড়িয়ে বল্লাম, আছে। বল্লো, আচ্ছা যাও। পাঁচটার দিকে পারলে হলের সামনে এসো। পারলে – শব্দে বুঝলাম মনে জমে থাকা মেঘ পুরোপুরি এখনো কাটেনি।

ডিপার্টমেন্টের অনেকেই আমাদের বিষয়টা জেনে গেছে বুঝতে পারি, কারো কারো মুখ দেখে। সাফায়েত ভাইয়ের কানেও কথাটা গেছে বুঝলাম সেদিন উনার ঈঙ্গিতপূর্ণ হাসি দেখে। বল্লেন, ইদানীং মনে হয় তোমাকে বেশি পাচ্ছি না! আমাদের খোঁজখবরও নিও। আমি কিন্তু তোমার আপনজন। গোজগাছ করতে লেগে গেলাম।

বিদ্যুৎ-এর কাঁধে ভিসার দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম বল্লাম, তুমি যা লাগে খরচ করে হিসেব দিও। আলম সব সময়ই একটু বেশি স্মার্ট টাইপের ওঁকে বল্লাম, তুমি সব খরচের হিসাব রাখবে পরে আলাদা ভাবে ভাগ করে দেবে। সবাই নিজেদের মতো করে তৈরী হচ্ছে। সেকান্দরকে নিয়েই চিন্তা একটু বেশি তার কারণ ও নিজে বড় বেশি আত্মসচেতন, নিজের বুঝটার বিষয়ে বেশি খেয়াল করে। রোজার দীর্ঘ বন্ধ প্রায় চল্লিশ দিন, সবাই যার যার মতো দেশের বাড়ি চলে যাবে। দুই দিন পর ছুটি, ছুটির পর পরীক্ষা তার জন্যও কিছু প্রস্তুতি সবাই নিচ্ছে। যার যার মতো লাইব্রেরিতে বসে প্রয়োজনীয় নোট করে নিচ্ছে অনেকেই। বিকালে বুলাকে নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করতেই বুলা বল্লো, এখন হাঁটবো না, নিউমার্কেট যাবো রিক্সা নাও।

রিক্সায় উঠে রিক্সাওয়ালাকে বল্লো, ভাই আজিমপুর হয়ে নিউমার্কেট যাবো একটু ঘুরে চলেন। ও বসতেই বর্ষবরণ দিনের সেই মিষ্টি গন্ধটা আমার নাকে লাগলো। বল্লাম, তোমার সাথীটা তো ভারী মিষ্টি। চমকে উঠে বল্লো, সাথী! সাথীকে বল্লাম, তোমার পারফিউমটা। হেসে উঠলো বল্লো, তাই! এটা আমার প্রিয় পারফিউম। বেশ খুশী হয়ে গেলো। ফর্সা মুখটা যেন হঠাৎ করেই আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো। হাসির সাথে ওর চোখের তারার ঝলকানীর একটা সম্পর্ক আছে যেনো। বুঝলাম একটু বেশিক্ষণ ঘুরতে চায়। লম্বা ছুটি, অনেক দিন পর আবার দেখা হবে, হয়তো তাই।

জগন্নাথ হল ডানে রেখে পলাশীর মোড় পার হতেই বল্লো, চুপ করে আছো যে, তোমার খারাপ লাগছে না কি আমার সাথে ঘুরতে? আসলে ও নিজেও মনে হয় একটু আড়ষ্ট হয়েছিলো, হয়তো সেটা কাটানোর জন্যই বলছে। বল্লাম, কি যে বলো! তোমার সাথে ঘুরতে খারাপ লাগবে কেনো? তোমার সাথে সব সময়ই তো থাকতে চাই। ভাবলাম দেশে যাবে হয়তো জরুরি কিছু কেনাকাটা আছে। বলেই ফেল্লাম, কিছু কেনাকাটা আছে নাকি তোমার? সহজভাবে বল্লো, না তো। একটু অবাক হয়েই বল্লাম, তাহলে নিউমার্কেটে কেনো? আমি তো ভেবেছি কিছু জরুরি কেনাকাটা আছে! হেসে বল্লো, তোমার সাথে এমনি করে কোনদিন তো রিক্সায় ঘুরিনি। ইচ্ছে করলো তাই বের হোলাম, তোমার ভালো না লাগলে চলো ফিরে যাই। হেসে বল্লাম, আমি কি সে জন্যে বলেছি। তা হলে কেন বল্লে? আমি সাথে থাকায় কোনো সমস্যা হচ্ছে? তার মানে তুমি চাও না আমার সাথে … একটু আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লো। বল্লাম, কাজ নাই ভালোই হলো, চলো কোঁথাও যেয়ে বসি। ভাবলাম অনেকদিন দেখা হবে না, নিরিবিলিতে একটু কথা বলি।

ঘড়িতে প্রায় ছ’টা বাজে, বাংচিন এর গেটে যেতেই ছোট্ট লাভলু মিয়া সালাম দিয়ে গেট খুলে দিলো। কাউন্টারের কুদ্দুসকে বল্লাম, ঝটপট করে একজনকে পাঠাও, তাড়াতাড়ি চলে যাবো। কোণার টেবিলে বসতেই স্লিপ কাগজ নিয়ে কুদ্দুস নিজেই চলে এলো। বল্লো ভাইজান আপনি বলেন, আমি তাড়াতাড়ি রেডী করিয়ে দিচ্ছি। দুই তিনটা খাবারের কথা বলে বল্লাম, তাড়াতাড়ি কিন্তু। বুলা জিজ্ঞাস করলো, ম্যানেজারকে চিনো নাকি? বল্লাম, হ্যাঁ পরিচিত। আমার এলাকার ছেলে, খুব ভালো। বল্লাম বাড়ি যাচ্ছো কবে? মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লো, বড় ভাই এসেছে ঢাকায়, সম্ভবত পরশু রাতের লঞ্চেই যেতে হবে। তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে কে জানে। আমার এবার কেনো জানি বাড়ি যেতে খুব একটা ইচ্ছাও করছে না। বল্লাম, মন খারাপ করো না ঈদের পর ক্লাশ শুরুর আগেই চলে আসবে। আমি তো দিন দশেকের মধ্যেই চলে আসবো দেশে। মন খারাপ করছো কেনো। তোমার বরিশালের বাসার ফোন নাম্বারটা দাও। ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে নাম্বারটা লিখে বল্লো, ওখানে পৌঁছে আমাকে জানাবে। সম্ভব হলে আমি ঈদের পরদিনই চলে আসবো।
আসলে আমার নিজেরও যেনো ভালো লাগছিলো না। মন চাইছিলো না, ও দূরে চলে যাক। সন্ধ্যার আগেই বুলাকে হল গেটে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে গেলাম।
(চলবে)
হিউষ্টন, টেক্সাস