ইউসুফ কামাল: দুই.
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আর সবার মতো আমাকেও হাতছানি দিতো। ছাত্রাবস্থায় স্কুল-কলেজে পড়ার সময় ভাবতাম একদিন ওমনি করে ওদের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির নীচে দেয়ালে হেলান দিয়ে আমিও বসবো বন্ধুদের সাথে। দূর থেকে ওদেরকে দেখে কেমন যেন একটা ঈর্ষাও বোধ করতাম। মনে হতো আহা আমিও যদি একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতাম!
আইবিএর এমবিএ-তে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম জমা দিলাম। ভর্তির লিখিত পরীক্ষায় পাশও করে গেলাম কিন্তু মৌখিকের দুইদিন আগের হাড় কাপানো জ্বরের মধ্যে আর বোর্ডের সামনে হাজির হতে পারলাম না। সপ্তাহ খানেক পর একদিন এসএম হলের কাছে দেখা হলো জাহাংগীর ভাইয়ের সাথে। ফরিদপুরের প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছোট ভাই (সম্পর্কে আমার দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ও)। বয়সে একটু বড় হলেও বন্ধুর মতোই। কেন যে ঐ সময় তার সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো সেটা এখনো একটা বিস্ময়। হয়তো মুখ দেখে কিছু বুঝেছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন- আরে বিয়েই সাহেব, কোন বিষয়ে ভর্তি হলেন? ডিগ্রীতে তো খুব ভালো করেছেন।
খুলে বললাম সব কিছু। এমবিএ-তে হয়ে যাবে ভেবে অন্য সাবজেক্টে চেষ্টাই করি নাই, এখন তো দেরী হয়ে গেছে। এ বছর হয়তো আর হবে না।
সব শুনে বললো, মনোবিজ্ঞানে পড়বো কিনা? মনের যে অবস্থা তাতে না করার উপায় নাই। সম্মতি জানালাম ঘাড় নেড়ে। মার্কশীটসহ প্রয়াজনীয় কাগজ দিয়ে যেতে বললেন কাল সকালে, আমি ‘জি এ সি’ তে সাবমিট করে দেবো। হয়তো হয়ে যাবে। পরদিন সকালে ওর হাতে সব কাগজপত্র পৌঁছিয়ে চলে এলাম আবার আমার শান্তির নীড় রাজবাড়ীতে। ভুলেই গেলাম প্রায় ভর্তির কথা।
দিন পনেরো পর ঢাকা থেকে বড় বোনের ফোন, তিন দিনের মধ্যে ভর্তি হতে হবে। বোনের বাসার ফোন নাম্বার ছিল যোগাযোগের নাম্বার। সাতদিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরল হক হলের এটাচ্ড্ ষ্টুডেন্ট হিসাবে আইডেন্টি কার্ড শার্টের বুক পকেটে নিয়ে হলের অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হলো দুনিয়া জয় করে ফেলেছি। ফুর ফুরে মন নিয়ে সমস্ত শহরটাকেই যেন রংগীন মনে হতে লাগলো।
প্রথম দিনের ক্লাশ। প্লিলিমিনারীতে জনা দশেক ছাত্রীসহ আমরা জনা ত্রিশ /পয়ত্রিশ জন সব মিলিয়ে। সামনের দিকের সীটগুলোতে সব মেয়েরা বসে। তার পিছনের সীটগুলোতে ছেলেরা। প্রথম দিনের ক্লাশের উত্তেজনাতে বাসা থেকে যে কলম আনতে ভুলতে গেছি সেটা টের পেলাম স্যারের কথাগুলোর পয়েন্ট লিখতে যেয়ে। কি করি দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম।
পাশের থেকে একজন বললো, কি হলো কিছু লিখছেন না যে? তাকিয়ে দেখলাম ছোটখাটো গড়নের একজন তাকিয়ে আমার দিকে । মুখে মৃদু হাসি। কলম আনি নি যে! হেসে অপরাধীর ভঙ্গিতে বলার সাথে সাথে সে তার কলমটা এগিয়ে বললো, আমিও লিখি আপনিও লেখেন। সেই শুরু তারপর থেকে আর তার কাছ থেকে কোনদিনই আর বিচ্ছিন্ন হইনি সুদীর্ঘ ৪৬ বৎসর। সে এখনো আমার গোপন তথ্যের ভান্ডার, পরম বন্ধু। যার নেই কোনো লোভ, কোনো রাগ কোনো অভিযোগ। পরম বন্ধু – বিদ্যুৎ সরকার। বর্তমানে কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা।
অনেক দিন দুপুরে চলে যেতাম টিএসসি-তে লাঞ্চ করতে। দুপুরের শেষ ক্লাসটা করে সবাই যে যার মতো কেটে পরতো। কেউ ‘হলে’ আবার কেউ বা বাসার দিকে। কয়েকজন বন্ধু এর মধ্যে বান্ধবীও জুটিয়ে ফেলেছেন। চার টাকায় টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ার খাবার পাওয়া যেতো। কারো হাতেই তখন বেশি টাকা থাকতো না। ডিপার্টমেন্টে বা অন্য কোথাও কোনো কাজ থাকলে আমার টাকাটা দিয়ে বিদ্যুৎ-কে আমার স্ক্রিপটা কেটে রাখতে বলতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তুকি দেওয়া খাবার- তাই সীমিত পরিসরে ব্যবস্থা থাকতো, আগে না গেলে পাওয়া যেতো না। কাজ শেষ হলে দৌড় দিতাম টিএসসি’র ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। দূর থেকেই দেখতাম ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে বসে আছে ও একা টিএসসি’র ঘাসের চত্বরে। কোনো অভিযোগ নাই। শুধু বলতো ‘চলো’।
ভার্সিটি জীবনের প্রথম এসেই কারো কারো যেন কিছু ‘মিশন’ থাকে। সহপাঠি বা কোনো একজন বান্ধবী জুটিয়ে নেওয়া। সারাক্ষণ বসে বসে বাক বাকুম করা বিষয়টা কেনো যেন মোটেই আমার ধাতে সইতো না। সাজিয়ে গুছিয়ে রাবিন্দ্রিক ষ্টাইলে কথা বলাটা যেন একটা বিরক্তিকর বলে মনে হোতো। তবু সব মেয়েরাই কিন্তু আবার এক ধাঁচের হয় না, কেউ কেউ আবার ‘রাফ এন্ড টাফ’ মার্কা ছেলেও পছন্দ করতো। পাখীর নীড়ের মতো না হলেও ডাগর নয়না মিনু মাঝে মাঝে ক্লাশের বেঞ্চে বসে পিছনে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতো-চোখে চোখ পরলেই চোখ নামিয়ে নিতো।
বিভাগীয় পিকনিকে রাজেন্দ্রপুরে যখন সবাই খাবারের লাইনে দাঁড়াতে ব্যস্ত তখন একটা প্লেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কে যেন চলে গেল দ্রæত পায়ে! বলেছিল লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই গল্পের নায়িকা যে আমার জীবনের মোড়টাই ঘুড়িয়ে দেবে সেটা তখনো বুঝিনি। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, আমেরিকা