হিমাদ্রী রয় : অনেকগুলো রোদেলা দিন কেটে ফেটে, আকাশের জেদ কিংবা মাটির আকর্ষণ যে কারণেই হোক সকাল হওয়ার আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে আজ। বৃষ্টিতে স্নাত টরন্টোর প্রকৃতিতে স্নিগ্ধ বাতাবরণ। বেলা ঢলানি দুপুরে, সজল মেঘ সরিয়ে মর্মরিত সবুজ পাতাদের উপর উজ্জ্বল রোদের নাচন। ডন রিভারের পটারি রোড ধরে ড্রাইভ করে ডাউন টাউনের দিকে যেতে যেতে কানের মাঝে গুনগুনিয়ে বেজে উঠলো মল্লার রাগে ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে’। ডিসেম্বরে যে হাঁসগুলো উড়ে গিয়েছিল দক্ষিণের আকাশে, এখন নিশ্চয়ই তারা ফিরে এসেছে এই উত্তরের জনপদে। রাস্তার দুই ধারে ম্যাগনোলিয়ার গোলাপি সামিয়ানা, চারিদিকে এত আনন্দ আয়োজন তবু কিসের যেন হাহাকার; মনের মধ্যে এক বিলাপ। চেনা আকাশ, চেনা মেঘ, কাদাজলের পথ আর চেনা আষাঢ়ের জন্য।

গন্ধমাধব ধানের ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে পোনা মাছের ঝাঁক, পাশ দিয়ে কলকল বয়ে চলা সরু খালের দুইকুল চাপিয়ে আষঢ়ের সন্ধ্যা নামতো কাঁঠাল, কদমের সুবাস নিয়ে। তখন সেই বয়স যখন আকাশটা খুব কাছে ছিল আর বৃষ্টি পাশে বসে ভিজিয়ে দিত জাম কাঠের বেঞ্চিটাকে।

আজ সকালের বৃষ্টি স্মৃতির ভিটাকে ভিজিয়ে দিল ঠিক কিন্তু বর্ষার প্রাণ ছিলো না, সজল বায়ে স্নিগ্ধতা ছিল, কদমের ঘ্রাণ ছিল না, মেঘ মল্লারে সারাদিনমান তাই আজ বেদনার গান।
যে বেদনা বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে।
শ্রীমতি রাধিকার কৃষ্ণ বিরহের চতুর্মাস্যার বর্ণনায়।

“আষাঢ় মাসে নব মেঘ গরজএ। মদন কদনে মোর নয়ন ঝুরএ। পাখী জাতী নহোঁ বড়ায়ি ঊড়ী জাওঁ তথা। মোর প্রাণনাথ কাহাঞিঁ বসে যথা। কেমনে বঞ্চিবোঁ রে বারিষা চারি মাস”।
শ্রীকৃষ্ণ বিহনে শ্রীরাধা একেলা চার মাস কেমন করে কাটাবেন, সেই বিলাপ করছেন বড়াইয়ের কাছে।

শ্রীমতি বলছেন আষাঢ় মাসে নবমেঘ গর্জন করছে, বাইরে বারি ধারা আর মদনবাণে আমার নয়নে অশ্রুধারা। বড়াই, আমি তো পাখি নই, নইলে যেখানে আমার প্রাণনাথ আছেন আমি এখনি সেখানে উড়ে যেতাম। সত্যিই কানু বিনে শ্রীমতির জগত শূন্যময়। তেমনি এক শূন্যতা মেঘ হয়ে জমাট বাঁধে আমরা যারা দূরবাসী তাদের বুকে।

শ্বেতশুভ্র চেরী ফুলের দেশে, কলাবতী, কামেনী, বকুল আর কদমের আষাঢ় বিহনে।
মেঘ ছাড়াও যে বৃষ্টি হয় অভিবাসী জীবন তা জানে।

শ্রীরাধিকার বিরহকাল চারমাস্যা আর আমাদের দহনকাল বারোমাস্যা। ঠেলা জালে পোনা মাছের উত্সবে হানা, ভরা বর্ষার আন্ধকারে হ্যাজাক জ্বলা নৌকার গলুইয়ে কুচ নিয়ে বসে থাকা রাত, আর ফিরে আসে না। ঈশান কোনের বিদ্যুত চমকানো, তমাল বনে আষাঢ়ের কালো কোমল ছায়া, হারিকেন জ্বালা শ্রাবণ সন্ধ্যা, ফুরিয়ে গেছে। মনের মাটিতে বৃষ্টির ফোটায় পুলকিত হয়ে, আলের পথে বাছুর তাড়া করে ঘরে ফেরা কালো মেয়ে বুড়িয়ে গেছে সেই কবে। এখন বাদাম তোলা বর্ষা কেবল গান কবিতা আর পঞ্জিকাতে। পাখিজাতি হলে উড়াল দিতাম দক্ষিণের আকাশে, পাখায় জাফরানি রঙ মাখিয়ে বসতাম গিয়ে কদমের শাখাতে।

এখানে জুন মাসের ঝরো ঝরো বাদর দিনে অন্টারিও লেকের নীল জলরাশিতে জল নপুরের ছন্দ দুলে, কেন জানি বৃষ্টি বিলাসী মন পড়ে রয় বাদল দিনের কদম ফুলে।

তবু বিরহ জ্বালার দহন ভুলে আজো কাফি রাগে মত্ততা ছড়ায় তোমার উদার আহ্বান চিত্ত খোলে।
‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে’।