রীনা গুলশান : আমি এপ্লাই করেছি। ইন্টারভিউ দিয়েছি। চাকরিটা হয়ে যাবে মনে হয়।
: ওহ তাইতো বলি তুমি হঠাৎ অনার্স ফাইনালে এসে এই চাকরির জন্য এপ্লিকেশন করলে কেনো?
: নারে টিউশনি করে আর হচ্ছিলো না।
: কিন্তু তোমাদের বাড়িতে রাজি হবে? তাছাড়া পড়াশুনা করে এই ফুলটাইম জব কি ভাবে করবে?
: অসুবিধা নাই, আপাতত নাইট শিফটে করবো।
: তোর নিজের পড়াশুনা?
: আরে ওখানে তেমন কাজ কই? ফোন আসবে, কমপ্লেন আসবে। এসব সমাধান করতে হবে। তার মধ্যে আমার পড়াশুনাটা ঠিকই সেরে ফেলবো।
আদিত্যও পড়ার ফাঁকে একটা টিউশনি করে। আসলে ঢাকায় থাকা খাওয়ার খরচা অনেক বেশিতো! এর মধ্যে আবার ছুটে ছুটে আসে আমার সাথে দেখা করার জন্য।
: তোরা কোথায় দেখা করিস, যখন আদিত্য আসে?
: আদিত্যর এক কাজিন আছে, সে দোলখোলায় থাকে বউ বাচ্চা নিয়ে। ওখানে এসে ওঠে। আমি ওখানে গিয়ে দেখা করি। জানিস আদিত্য আমাদের বিয়ে নিয়েও কথা বলে যে আমাদের বিয়েটা জলদি সেরে ফেলা উচিত।

: হু! ভালইতো; তোমাদের যা ব্যাপার শুনছি। তোমাদের ক্ষেত্রে বিয়েটা করেই ফেলা উচিত।
: কেনো রে, তোর কি মনে হচ্ছে আমার সাথে ও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে?
: তা না, বহু বছর ধরে একে অপরকে চেনো জানো, তাই জড়িয়ে পড়তে দোষ কোথায়?
: আসলে ওতো ছাত্র, তাই ভাবছি …
: আসলে জানোতো, মানি প্লান্ট এর সব সময় একটা শক্ত খুঁটির দরকার হয়। এই কথায় অহনার মুখাবয়ব বেশ চিন্তা যুক্ত মনে হলো।
এরপর অহনা টিএনটিতে চাকরি পেয়ে গেলো। চাকরি এবং পড়াশুনা এক সাথে চালিয়ে যেতে হচ্ছিলো। বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। তবু তার আদিত্যর জন্য সে সব কিছুই করতে পারে। অনার্স পরীক্ষার সময় পরীক্ষা চলাকালিন সময়টা ছুটি নিয়েছিল। এত ঝামেলা করে পড়াশুনা করেছে, তবু অনার্সে আপার ফার্স্ট হলো। এদিকে আদিত্যর ও মেডিকেলে চার বছর ভালোভাবেই কেটে গেলো। ওর রেজাল্টও খুব ভাল হলো। এরপর ওকে ইন্টার্নি করতে পিজি হাসপাতালে পাঠালো। এখন আদিত্যর নাইট ডিউটি পড়লেই অহনা ফোন করে। পেসেন্টের ডাক পড়লেই কেটে দেয়, আবার করে। এবারে একদিন অহনা নিজের থেকেই বললোÑ
: তুমি অনেকদিন থেকে বলছো, এবারে বরং তোমার আব্বাকে আমাদের বাসায় পাঠাও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে।

: কিন্তু এখনোতো চাকরি পাইনি। দাঁড়াও চাকরিটা পেয়ে নাই।
: কিন্তু তারতো এখনো অনেক দেরী। প্রায় তিন বছরের ধাক্কা। ইন্টার্নী করা অবস্থাতেও তো অনেকে বিয়ে করে।
: আরে না অহনা তুমি বুঝছো না! এখন অবস্থাটা অন্যরকম।
: কি রকম? এতদিন তো তুমিই বিয়ে বিয়ে করছিলে! আর এখন আমি নিজে থেকেই বলছি, আর তুমি বাহানা করছো!
: আরে না সোনাপাখী … এখন হয়েছে কি, আমরাতো ধরতে গেলে এখনো স্টুডেন্ট। এখন বরং আগের থেকেও খারাপ পজিশন। যখন তখন ডাক দেয়।
: আমি এসব জানি আদিত্য। এতদিন তুমিইতো বিয়ের ব্যাপারে বলছিলে।
: সেতো ঠিকই। তবে এখন পরিস্থিতি একদমই আলাদা, বুঝলে?
: আমারো পরিস্থিতি একদম চেঞ্জ হয়েছে বুঝলে? এমনিতেই টিএনটির এই চাকরি নেবার পর থেকেই বাড়ির থেকে খুবই অশান্তি করছে।
: তাহলে এক কাজ করো চাকরিটাই ছেড়ে দাও।

: কেন চাকরি ছাড়বো কেনো? তোমার আর টাকার দরকার নাই?
: না ওরা এখন আমাকে যা দিচ্ছে তাতে আমার চলে যাচ্ছে, তাছাড়া পিজি উপরে এক রুমের একটা বাসস্থান ও পেয়েছি। ব্যাচেলরদের জন্য করা আছে।
: তাহলেতো তোমার সমস্যার সমাধান।
: হ্যাঁ তা বলতে পারো। এখন তুমি মন লাগিয়ে পড়তে পারো।
: আদিত্য, এখন আমার প্রবলেম শুরু হয়েছে। এখন বাসা থেকে খুব বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছে। এখন তো তোমার কিছু বলা উচিত।…

: দেখো অহনা, তুমিতো আমার স্বপ্নের কথা সবই জানো! আমি মাঝপথে সব ডুবাতে চাই না। দেখো তুমি আমাকে আজ এই পর্যন্ত আনলে! এখন আর অন্তত দুইটা বছর দাও প্লিজ! অহনার মনটা খুবই খারাপ হলো। আদিত্য বরাবরি এইরকম। নিজের কথাই সে খুব বেশি ভাবে। অনেকটা সময় সে বিমর্ষ হয়ে রইলো। তবু বিষন্ন কন্ঠে বললো-
: ঠিক আছে আদিত্য, তুমি যে সময় চাইলে আমি তোমাকে সেটাও দিলাম। যদিও এটা আমার জন্য খুবই কঠিন হবে।
: অনেক অনেক ধন্যবাদ সুইটি। অহনা কোন জবাব দিল না।
এরপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা চলে গেছে। অহনা এম এ পাশ করেছে। ওর আরো দুটো প্রোমশন হয়েছে তার কর্মস্থলে। এই সময়টাতে আদিত্য খুবই কম যোগাযোগ করেছে। অহনাও তাকে কোন ডিস্টার্ব করেনি। কারণ সে আদিত্যকে শুধু পাগলের মতো ভালোইবাসে না, অন্ধের মত বিশ্বাসও করে। যদিও ওদের কমন বেশ কিছু বন্ধু, যারা ওদের সম্পর্কের কথা জানে প্রথম থেকে; তাদের মধ্যে সুদীপ নামে একটা বন্ধু আছে। সে হঠাৎ করে মাস ছয়েক আগে ওর অফিসে এসে একদিন দেখা করলো। অহনা খুব অবাক হলো। বললো-
: তুই যে, খুলনায় কবে এলি?
: এইতো গত পরশু এসেছি।
: আচ্ছা একটু ওয়েট কর, আমি আসছিরে। অহনা অফিস থেকে একেবারে ছুটি নিয়ে বের হয়ে গেলো। সুদিপও ঢাবি থেকে এপ্লাইড ফিজিক্সে পাশ করে একটা কলেজে জব পেয়েছে। ওদের পাড়াতেই সুদিপ্রা থাকে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক প্রগোলভ হয়ে গেলো। ছেলে বেলার অনেক কথা বলতে বলতে দুজনে রীতিমত হাহা হিহি করতে লাগলো। একসময় ওরা হোটেল ডিলাক্সের কাছে চলে এলো।
: কিরে ডিলাক্সে এলি যে বড়?
: আয় একেবারে লাঞ্চটা সেরে নেই। আমি লাঞ্চ করিনি।
: ওকে চল, আজ আমি তোকে খাওয়াবো?
: উহু! আমি যখন ঢাকায় যাবো তখন তুই খাওয়াবি। অহনা ডিলাক্সে ঢুকার সাথে সাথে আলী নামে একজন বেয়ারা ছুটে এলো-
: আপা কি আনুম?
: ফুল প্লেট একটা আর হাফ প্লেট একটা চিকেন বিরানী আনো। আর খাশীর দুইটা চাপ আনো। আর খাবার পর দুইটা ফালুদা আনবে।
: ওরে বাপস! তুই দেখি একেবারে বিয়ে বাড়ির খানা অর্ডার করলি! অহনা মিস্টি করে হেসে বললো।
: তারপর বল কেমোন চলছে সব?
: এইতো মা-বাবা একটা মেয়ে ঠিক করেছে আমার জন্য। আগামী পরশু আশীর্বাদ। তোকে নেমতন্ন করতে এলাম।
: ওমা বলিস কি?
: হ্যাঁ মেয়ে ভালই, এবারে বি এল কলেজ থেকে বায়োলজিতে মাষ্টার্স করেছে।
: খুব ভালো হয়েছেরে।
: তা তোদের খবর কি? তোর না বিসিএস দেবার কথা ছিলো?
: হ্যাঁ এবারে দিয়েছি রিটেন, দেখি কি হয়?
: কি চয়েস দিলি?
: মাষ্টারীই এক নম্বর চয়েস ছিল। আর খবর জানি না। আর অন্য খবর বলতে, আদিত্য কবে যে বিয়ের জন্য হ্যা বলবে বুঝছি না।
: যদি নির্ভয় দিসতো একটা কথা বলি?

: আরে কি আশ্চর্য! আমার সাথে কথা বলার জন্য তোর পারমিশন লাগবে নাকি?
: না আফটার অল তোরা দুজনই আমার বন্ধুতো! সমস্যাটা ওখানেই। আসলে অনেকদিন থেকেই শুনছি আদিত্যর একটা মেয়ের সাথে এফেয়ার আছে। তো আমি ব্যাপারটা সিওর হবার জন্য অনেকবার ওকে ফোন করেছি। ফোন কেটে দেয়। এমন কি একদিন পিজিতেও গেলাম, সেখানেও জরুরি কাজ বলে এড়িয়ে গেলো। শুনেছি, ঢাকা মেডিকেলে পড়বার সময় থাকতেই এক নার্সের সাথে প্রেম চলছিলো। ওখানে আমার এক কাজিন আছে, তাকেও আদিত্যর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাতে, সেও একই কথা বলল। তবু তোকে এতদিন কিচ্ছু বলিনি। তবে গত মাসে হঠাৎ গাউসিয়াতে গিয়েছিলাম কিছু জিনিস কিনতে। ওখানে দুর থেকে হঠাৎ করে আদিত্যকে দেখলাম, একটা মেয়ের সাথে। আমি দূর থেকে অনেকক্ষণ অবজার্ব করে অনেকটা পালিয়ে এসেছি। এখন তোকে না বলাটা, একেবারে বেঈমানির পর্যায়ে পড়ে যাবে বলে বলছিরে। অহনা চুপচাপ শুনে গেল। কোন জবাব দিলো না। বরং আগের মতই হাসি মুখে খেয়ে গেলো । তবে ভ্রুটাতে কিঞ্চিত চিন্তার ভাজ পড়লো। পরদিন অফিসে যেয়ে নীতুকে সব বললো। সেতো উল্টা চিল্লাপাল্লা শুরু করলো-

: এখুনি ফোন দে। তোর এই বিশ্বাসই একদিন কাল হবে।
: ওকে বাবা দিচ্ছি। এরপর অহনা ক্রমাগত ফোন দিয়ে গেল। ঢাকাতে, আদিত্যর দেওয়া সব কটা নাম্বারেই ট্রাই করে গেল। কোন রেসপন্স নাই। অতঃপর আদিত্যর ঠিকানায় একটা চিঠি দিলো। তাও তিন মাসের মত হয়ে গেলো। তখন নিতুই বলল-
: এটা জীবন মরন সমস্যা। তুমি এক কাজ করো, তিন দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে একেবারে সরেজমিনে তদন্ত করে আসো। সেই মোতাবেক অহনা ঢাকা যাবার প্লেনের টিকিটও বুক করে ফেললো। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই যাবে। আদিত্যকে জানালো না। ওকে সারপ্রাইস দেবে বলে ঠিক করলো।

: কিরে বাড়ি যাবি বলেও উঠছিস না যে, কি হলোরে তোর? এই অহনা? – নিতু অতঃপর অহনার হাত ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিল। এতক্ষণে অহনা তার হাতের চিঠিটা নিতুর দিকে বাড়িয়ে ধরলো। নিতু অনেকটা ঝাঁপিয়ে পড়লো চিঠিটার উপর-

অহনা,
আমি জানি গত তিন/চার মাসে তুমি আমাকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছো। আমি ফোন ধরিনি। এমনকি তোমার চিঠিরও জবাব দেইনি। কি জবাব দিবো বল? তোমাকে বলার মত আমার যে কিছুই নাই! আমি অত্যন্ত অপারগ অহনা। আসলে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা একদম আলাদা ব্যাপার। ঢাকা মেডিকেলে যখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তখনই প্রথম দেখি আলিনাকে। ওই দেখাটাই কাল হলো। বুঝলাম ওই দেখাই আমার জীবনের সর্বনাশ হলো। ওকে দেখার পরই বুঝলাম প্রকৃত প্রেম কি জিনিস? আমি ওকে ছাড়া বাঁচতেই পারবো না। আমি জানি তুমি আমার জন্য যা কিছু করেছো, সেটা আমার নিজের বাবা মাও করতে পারবে না। কিন্তু অহনা কৃতজ্ঞতার বোঝা নিয়ে, ভালোবাসার ঘর কন্যা করা যায় না। আমি আসলে গত বছরেই আলিনাকে বিয়ে করে ফেলেছি। প্লিজ পারলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর আমি চাকরি পেলে তোমার পাঠানো প্রতিটি পয়সা, হিসাব করে শোধ করে দিবো। আর তুমি তোমার বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে ফেলো। ভালো থেকো।

-আদিত্য।
অনেকক্ষণ হলো সূর্যটা ডুবে গেছে। তার লালিম আভা চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। শরতের মৃদু মন্দ হাওয়ায় দুলছে কাশবন। ভালোবাসা কখনো শেষ হয়ে যায় না। নিতু গভীর মমতায় অহনার হাত দুটো জড়িয়ে নিলো ওর করতল দিয়ে। রাস্তায় নেমে এলো দুটো বিষন্ন ছায়া। সমাপ্ত