মণিজিঞ্জির সান্যাল : সেলিব্রিটিদের জীবন কারো কারো ক্ষেত্রে বিষাক্ত এবং ভীষণভাবে একা। আসলে একজন মানুষ যখন জীবনের লক্ষ্যে ঠিকঠাক পৌঁছে যায়, তখন সেই মানুষ বড় একা হয়ে যায়। কারও কারও নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়, সেলিব্রিটিদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে, বিশেষ করে যে নিজেকে সেলিব্রিটি বলে ভাবতে শেখে। এটা যে আসলে তার কাজ সেটা ভুলে যায়। নিজেদের এতো বেশি বিস্তৃত করে যে, পরিবার থেকে, তারপর সমাজ, তারপর দেশ, এমনকি বিশ্বের সাথে নিজের সমন্বয় তৈরি করার জন্য ব্যস্ত থাকে।
আসলে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই নিজের জন্যে বাঁচে না, অন্যের আবেগ-ভালোবাসা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। তখন সেই মানুষটি ওর লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে নিজেকে নিয়ে এতো বেশিরকম চিন্তা করে যে আশেপাশের জীবনযাত্রা তাকে মোটেই বিচলিত করে না। অর্থাৎ তার নিজস্ব কোনো বৃত্ত তৈরি হয় না; নিজেকে সবার মধ্যে অনন্য মনে করতে থাকে। অথচ সে স্বাভাবিক একটা মানুষ। নিজের শৈলী দিয়ে অন্যের মন জয় করে চলেছে কিন্তু নিজের প্রতিকৃতির সাথে সহমত পোষণ করে না।
এই পরিস্থিতি কেউ-ই কম সময়ে তৈরি করে না, বরং অনেক সময় নিয়েই নিজের মধ্যে এই আকুলতা তৈরি করে। একটা পর্যায়ে পৌঁছে তার মধ্যে দেখা যায় বিষন্নতা। ধীরে ধীরে তার মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা, যা ভয়াবহ হতে পারে জীবনের জন্যে। এই পরিস্থিতি থেকে একজন সাধারণ মানুষ বেরিয়ে আসতে পারলেও, একজন সেলিব্রিটির ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত শক্ত কাজ।
এক্ষেত্রে নিজেকে পাল্টাতে হলে, প্রথমেই তাকে
খুব কাছের মানুষের সাহায্য নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, কিছুদিনের জন্যে বাইরে কোথাও ঘুরে আসতে পারলে ভাল হয়।
তৃতীয়ত, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে হবে যে আমি আসলে কতোটা সঠিক, কতোটা অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল ।
চতুর্থত, ভালোবাসার বিনিময়ে নিজেকে নিজে কতোটা প্রসারিত করতে পেরেছি।
এবং জীবনে কতোখানি ত্যাগ করেছি।
আসলে আমরা সব সময়ই নিজের সুখের কথা ভাবি, অথচ অন্যের ভালো করার মধ্যেও কিন্তু একটা স্বর্গীয় সুখ আছে, যা হয়তো সব মানুষ অনুভব করতে পারে না। তবু মানুষ শ্রেষ্ঠ বলেই সেই চেষ্টা করতে হয়।
আমার মতে সেলিব্রিটি তাঁকেই বলতে পারি যাঁর মাধ্যমে সমাজের একটি মানুষেরও যদি কল্যাণ হয়। প্রতিটি মানুষের-ই কাজের মূল্য আছে, সে তো কারো কাছে হাত পাতছে না। প্রতিটি মানুষের কাজের জায়গায় সেই-ই সেরা। তাই পরস্পর পরস্পরের প্রতি যেন শ্রদ্ধা থাকে; কাউকে যেন ছোট করা না হয় সেদিকে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে ; কোনো কাজই ছোট নয়।
তবে কিছু ব্যক্তিও আছেন যারা নিজের খেয়াল না রেখে বিখ্যাত মানুষের পেছনে শুধু ঘোরাঘুরি করেন, তাদের খাতির করেন; তোষামোদ করেন! সমাজে এদের সংখ্যাও কম নয়।
‘সেলিব্রিটি’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘বিখ্যাত বা সুপরিচিত ব্যক্তি’। মূলত খেলাধুলা ও বিনোদন জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিরা ‘সেলিব্রিটি’র তকমা লাভ করেন। সেলিব্রিটিদের নিয়ে সারা বিশ্বেই সাধারণ মানুষের কমবেশি উন্মাদনা আছে। এই সেলিব্রিটিদের অনেকে আবার ‘তারকা’ বলেও ডাকেন। এই তারকাদের অনেকেই আছেন, যাঁরা নীরবে–নিভৃতে থাকতে ভালোবাসেন। আবার অনেকে আছেন যাঁরা শুধু আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার প্রয়াসে বৈচিত্র্যময় আলো ঝলমলে জীবন যাপন করেন। অনেকেই তাঁদের আকাশের তারকার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই সব মানব তারকাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে যে কৌতূহলের বাহুল্য চোখে পড়ে, সত্যিকারের আকাশের তারকাদের নিয়ে আমাদের সেই আগ্রহ চোখে পড়ে না। মানব তারকা চেনার, জানার এবং তাঁদের জীবনযাপনের চুলচেরা বিশ্লেষণে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। কখনো কখনো সেই কৌতূহল সীমা অতিক্রম করে। আমরা ভুলে যাই সেলিব্রিটিরাও মানুষ, তাঁদের রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত মুহূর্ত এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি।
সেলিব্রিটিদের নিয়ে মানুষের এই উন্মাদনার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে মনে করা হয় খ্যাতির প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ। মানুষের বিখ্যাত হওয়ার বাসনা চিরন্তন। কারও কারও এই বাসনা প্রকাশিত হয় আবার কারও কারও ক্ষেত্রে তা রয়ে যায় সুপ্ত অবস্থায়। অনেকে আবার নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পান বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত জীবনে।
স্কুল জীবনে অনেকেই তারকাদের নিয়ে মনে মনে কতো স্বপ্ন দেখে। সে কোনো চিত্রতারকা হোক বা সঙ্গীত জগতের কেউ কিম্বা আন্তর্জাতিক মানের কোনো খেলোয়াড় হতে পারে। তাঁদের নিয়ে দিন রাত স্বপ্ন দেখতে কোনও ক্লান্তি অনুভব করে না। অনেকে মনে করেন তারকাদের জীবনযাপন আলাদা। তাঁরা যেন ভিন্ন কোনো গ্রহের প্রাণী। তাঁদের জীবনযাপন আমাদের মতো ৯টা ৫টা অফিস সময়ের ফ্রেমে বন্দী নয়। তাঁরা হয়তো একেবারেই অন্য রকম বিলাসী জীবন যাপন করেন। তাঁরা যেন ঐ দূরে আকাশের থেকেও কোনো উঁচু জায়গায় অবস্থান করেন।
তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাবনা চিন্তার জগৎটাও পালটেছে। কেউ কেউ এখন সেলিব্রিটিদের নিজের খুব কাছের মানুষ, পরিচিত কেউ বলে মনে করেন। আর মনে করবেন না–ই বা কেন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের দৌলতে তারকাদের নানা খবরাখবর আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। কে কখন কার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, কে কখন কাকে বিয়ে করছেন, কার সঙ্গে কার বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে, কে কখন সন্তানসম্ভবা হচ্ছেন, কোন পাঁচতারা হাসপাতালে কোন তারকার সন্তানের জন্ম হচ্ছে, এসব চটকদার খবর আমাদের মুঠোবন্দী। আমরা তাঁদের জীবনযাপন নিয়ে যত খবর রাখি, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের খবরও অতটা রাখি না। এসব খবরকে পুঁজি করে চলছে বাণিজ্য, পাতা হচ্ছে মুনাফার ফাঁদ। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে নানা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং আমরাও তাঁদের চাঞ্চল্য সুষ্টির ফাঁদে পা দিচ্ছি প্রতিনিয়ত। লাইক, শেয়ার আর ভিউয়ের দৌলতে ব্যবসাও হচ্ছে মিডিয়ার। অথচ কত ভালো ভালো মূল্যবান খবর আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যায়।
বিখ্যাত হওয়ার যেমন আনন্দ আছে, তেমনি রয়েছে যন্ত্রণা। বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত জীবন প্রায়শই ঝুঁকিতে পড়ে। এই ঝুঁকি মেনে নিয়েই তারকারা তারকা হন। তারকাদের জীবনযাপন নিয়ে যেহেতু সাধারণ মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি, তাই তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর প্রাইভেসি রক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি ব্যাপার সত্য যে একজন তারকা ভালো ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন, যা সাধারণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অনেকেই আছেন যাঁরা তারকাদের নিজেদের ব্যক্তিজীবনে আদর্শ ও অনুকরণীয় বলে মনে করেন। তাই সাধারণের প্রতি তারকাদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে তারকাদের ‘ব্যক্তিগত’ জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষ যারা আবেগ অনুভূতির অতিরিক্ত প্রকাশ ঘটায়, তারা নিজেরা আসলে নিজেদের আত্মমর্যাদার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জয়জয়কার। প্রিয় তারকার কোনো খবর কে কীভাবে শেয়ার করছে, তার ওপর কিন্তু নির্ভর করে মানুষের রুচির বহিঃপ্রকাশ। যাকিছু অনাকাঙ্ক্ষিত, অরুচিকর বলে আমরা বিশ্বাস করি, তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগী হওয়া কোনো অবস্থাতেই নিজের আত্মমর্যাদাকে বাড়ায় না। আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যক্তিগত মুহূর্ত। আমরা অনেকেই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকি। অন্যের গোপন মুহূর্ত অন্যের কাছে তুলে ধরার আগে একবার তলিয়ে দেখা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের সততা, নৈতিকতা আর আদর্শের জায়গাটি। যে আঙুল আমরা অন্যের দিকে তুলছি, সেই আঙুলগুলো যেন কোনো কারণে আমাদের নিজেদের দিকে নির্দেশিত না হয়, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
যা আমরা চর্চা করি না কিংবা বিশ্বাস করি না, তা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। প্রত্যেক মানুষের রয়েছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার। তারকারা আলাদা কোনো জগতের বাসিন্দা নন। মিডিয়াতে যাঁরা নিয়মিত কাজ করেন, সেখানে তাঁরা যে খ্যাতি অর্জন করেন, তা মূলত তাঁরা তাঁদের পেশাগত কারণেই করেন। বিষয়টিকে পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে তারকাদের ‘ব্যক্তিগত’ জায়গাটির প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল থাকা যায়। শুধু সেলিব্রিটিই নয়, যেকোনো মানুষের সম্মতি ব্যতীত তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় বাইরে প্রকাশ ও প্রচার করার অর্থ হল মানবাধিকার লঙ্ঘন করা। এটি সাইবার অপরাধও বটে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত যা অনাকাঙ্ক্ষিত তা প্রচার করা থেকে নিজেদের বিরত রাখা, অন্যের সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রাখা।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ