নাদিরা তাবাসসুম : সেদিন সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরছে। পথে প্রাতঃভ্রমণকারী মানুষজন খুব কম। কিন্তু তিনবন্ধু হাঁটছেন পার্কের লম্বা রাস্তা ধরে। হঠাৎ দিদার ক্লান্ত হয়ে বলে-
– ভাই আমি হাঁপিয়ে গেছি, চলো না কোথাও গিয়ে একটু বসি। আমি হার্টের রোগী, তাই বেশি সময় হাঁটতে কষ্ট হয়।
দিনার – ঠিকই বলেছ, তাহলে চলো বসি।
দিদার -ঔ যে বকুল তলা, সবুজ পাতাভরা ঘন শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট বকুল গাছের সারি, ওখানে একটা বেঞ্চও আছে।

দিনার -আহা কি সুন্দর এই জায়গাটা! গাছগুলো কেমন সবুজ ও তরতাজা, সাথে মিষ্টি বকুল ফুলের গন্ধ। অপূর্ব সৃষ্টি, সবকিছু মানুষের জন্য।
[শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কখন এলো কখন গেলো কোন খবর নেই। তিন বন্ধুর প্রতিদিন দু/এক ঘন্টা হাঁটতেই হবে। এ যেন জীবন পণ, সাথে ডাক্তারের নির্দেশ রয়েছে]

সকালে সম্ভব না হলে বিকেলে অথবা সন্ধ্যায়। দিদার, দিনার আর রুহান। এক সময় কলেজ জীবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কলেজ জীবন শেষ হলে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য তিনজন তিন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। দিদার পদার্থ বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো করেছেন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে, দিনার চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং বিষয়ে আর রুহান দর্শন বিষয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে চাকরিও করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। অবসর জীবনে তিন বন্ধু ঘটনাক্রমে ঢাকায় জায়গা কিনে বাড়ি তৈরী করেছেন পাশাপাশি এলাকায়। একজন মগবাজার, একজন সিদ্ধেশ্বরী এবং অন্যজন মৌচাক এলাকায়। একদিন হঠাৎ রমনা পার্কে হাঁটার সময় তিনবন্ধুর দেখা। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দে দিশেহারা তিনবন্ধু। তারপর থেকে শুরু হয় নিয়মিত হাঁটা এবং গল্পগুজব। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তিনজনই নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম আর পরিমিত খাওয়া-দাওয়া- এই ছকে নিজেদের যেন বেঁধে ফেলেছেন।
দিদার – সকল গাছ বা উদ্ভিদ নিজেরা যেমন সতেজ ও সজীব তেমনি জীবজগত ও মানবক‚লকে সতেজ কোরে বাঁচিয়ে রেখেছে।

দিনার – কিভাবে?
রুহান – আমরা সবাই অনেক বড় বড় ডিগ্রী নিয়েছি। আমরা সবকিছু জানি এবং বুঝি, কিন্তু কখনও চিন্তা করি না। আমাদের ভাবা উচিত, চিন্তা করা উচিত এই পৃথিবী, জীবন এবং মহাবিশ্ব কেন এবং কী উদ্দ্যশ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে।
দিদার- আমরা বিজ্ঞান থেকে জেনেছি যে, গাছ বা উদ্ভিদ হলো তাদের এবং আমাদের খাদ্য তৈরীর প্রধান উৎস। এই যে সবুজ পাতাগুলো দেখছ, এরাই নিত্য তাদের খাদ্য তৈরী করে চলেছে। গাছ বা উদ্ভিদ মাটি থেকে প্রতিনিয়ত শিকড় বা মূল দিয়ে যে রস শোষণ করছে তা পাতায় নিয়ে জমা করে। ওদিকে আবার পাতার ছিদ্র (পত্ররন্ধ্র) দিয়ে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সংগ্রহ করে পাতাতেই জমা রাখে। এরপর যখন সূর্যকিরণ পাতার উপড়ে পড়ে এবং পাতার সবুজ পদার্থে (ক্লোরোফিল) উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তখন শিকড় বা মূল দ্বারা শোষিত রস এবং পাতার ছিদ্র দিয়ে বাতাস থেকে সংগ্রহ করা কার্বন-ডাই-অক্সাইড একত্রে মিশে (রাসায়নিক বিক্রিয়া করে) গ্লুকোজ ও অক্সিজেন সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়াকেই ‘আলোক সংশ্লেষণ’ (ফটোসিন্থেসিস) বলা হয়। এই গøুকোজ গাছের আয়তন ও শক্তি (কলেবর) বৃদ্ধি করে, গাছকে সজীব রাখে এবং গাছকে ফলমূল সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। আর বাকী থাকলো কি?

দিনার – অক্সিজেন।
দিদার – এই অক্সিজেন পাতা থেকে বেড়িয়ে বাইরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা মানুষ এই অক্সিজেন নাক দিয়ে আমাদের শরীরের ভিতরে টেনে নিই।
রুহান -কি আশ্চর্য তাই না?
দিদার -আরও আশ্চর্য যে, গাছের উপরিভাগকে এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা (কিউটিকাল স্তর ) লেপে মসৃণ করা হয়েছে। রাসায়নিক পদার্থের এই প্রলেপ না থাকলে বিশ্বের সকল গাছপালা, উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম শুকায়ে মরে যেত। এই প্রলেপের কারণে শিকড় দিয়ে সংগ্রহ করা রস এবং পাতার ছিদ্র দিয়ে সংগ্রহ করা কার্বন-ডাইন-অক্সাইড পাতায় জমা থাকতে পারে। প্রলেপ না থাকলে রস বাষ্প হয়ে উড়ে যেত, অক্সিজেন তৈরী হতো না ফলে গাছ রসশূন্য হয়ে মারা যেত। সাথে প্রাণীজগত এবং মানুষও মারা যেত।
রুহান – কে এই রাসায়নিক পদার্থের প্রলেপ মেখে দিলো? উদ্ভিদবিজ্ঞান কী বলে?
দিদার -বিজ্ঞানীরাও বিস্মিত শ্রষ্টার এই সৃষ্টিকৌশলে। আর হ্যাঁ, এর মূলে রয়েছে জল্বন্ত অগ্নিগোলক সূর্য যার তাপ আর আলোকের সাহায্যে অনবরত গাছের পাতায় খাদ্য প্রস্তুত হচ্ছে। সূর্যকিরণ ও তাপ ছাড়া গ্লুকোজ এবং অক্সিজেন (যা উদ্ভিদ/গাছ এবং মানুষের জীবনীশক্তি) প্রস্তুত হওয়া সম্ভব নয়।

বাতাসের ভিতরে রয়েছে শতকরা আটাত্তর ভাগ নাইট্রোজেন, শতকরা সাড়ে বিশ ভাগ অক্সিজেন এবং বাকী দেড় ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড, বাষ্প-ধুলিকণা ও নিস্ক্রিয় গ্যাস ইত্যাদি। মানুষ আমরা যে ডাল, মাছ, আলু ইত্যাদি আমিষ জাতীয় খাদ্য খাই, সেগুলো আমাদের পরিপাকপ্রণালীতে ভেংগে এমাইনো এসিডে পরিণত হয়। এই এমাইনো এসিড আমাদের শরীরের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এমাইনো এসিডের প্রধান দু’টি উপাদান হলো- নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন
দিনার- অসাধারন!

দিদার – অসাধারন তো বটেই! মজার ব্যাপার হলো, বাতাসে নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন কি অভাবনীয় প্রক্রিয়ায় আমাদের অজান্তে আমাদের জীবনপ্রবাহে সবসময় কাজ করে যাচ্ছে।
দিনার – কিভাবে?
দিদার – বৃষ্টি যখন ঝরে সে সময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখো তাই না? ঠিক এ সময় বাতাসের ভিতর নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন-এর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নাইট্রিক অক্সাইড সৃষ্টি হয়।

নাইট্রিক অক্সাইড বৃষ্টির পানির সাথে মিশে নাইট্রিক এসিডে পরিণত হয় এবং মাটির মৌলিক উপাদানের সাথে মিশে নাইট্রিক লবণ সৃষ্টি করে। এই লবণকে তখন ব্যাপন প্রক্রিয়ার দ্বারা গাছ এবং উদ্ভিদ মাটি থেকে চুষে নেয়। আবার কোন কোন উদ্ভিদ যাদের গুটি হয়, যেমন সীম, মটর-এরা সরাসরি বাতাস থেকে নাইট্রোজেন চুষে নেয়। এই নাইট্রোজেনজনিত সার পেয়ে গাছ ফুলে ফলে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সবুজ সতেজ হয়ে উঠে। আর এইসব উদ্ভিদ থেকে আমরা আমিষ জাতীয় খাদ্য পেয়ে থাকি।

গাছ এবং উদ্ভিদের ঝরে পরা পাতা, প্রাণীদের বর্জ, তারপর প্রাণী বা উদ্ভিদের মৃত্যর পর সৃষ্ট আবর্জনায় ডি, নাইট্রোফাইসিং ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রোজেন আবার বাতাসে ফিরে আসে এবং সমতা রক্ষা করে চলে- একে বিজ্ঞানে ‘নাইট্রোজেন চক্র’ বলা হয়। এই নাইট্রোজেন চক্রের মূলে রয়েছে সূর্য। সূর্যের তাপে সমুদ্রের পানি বাষ্পিভূত হয়ে উপড়ে উঠে আবার নিম্নচাপে পৃথিবীর উপড় পতিত হয়।
মেঘের এই সঞ্চালন এবং আহ্নিকগতির কারণে বাষ্পের ভিতরে ওলট-পালট শুরু হয়। আবার মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ চমকায় এবং মুষল ধারে বৃষ্টি হয়
রুহান – এইসব বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ব্যাখ্যা দেড় হাজার বছর পূর্বে পবিত্র কোরআন শরীফে প্রদান করা হয়েছে।

পবিত্র কোরানে আছে “তাসরিফুর রিয়া” অর্থাৎ বাতাসের ভিতর রুপান্তর ঘটিয়ে দেই। আবার “বায়নাল মুছাখখারা” অর্থাৎ অতঃপর মেঘমালাকে আসমান ও জমিনের মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখি।
আল্লাহ আরও উল্লেখ করেছেন, “রাদু ওয়া বারকু” অর্থাৎ মেঘমালাতে ধাক্কা লেগে বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। এখানে নাইট্রোজেন চক্র সম্পর্কে স্পষ্ট ইংগিত করা হয়েছে।
পবিত্র কোরানে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “ওয়া আনজালনা মিনাল মু’ছিরাতে মা আনছাজ্জাদা লিনুখারিজা বিহি হাব্বা ও ইয়া নাবাতা” অর্থাৎ আমি সেই মেঘমালা হতে মুষল ধারে বৃষ্টি বর্ষণ করি, খাদ্যশস্য এবং আহার সৃষ্টি করার জন্য।
দিনার – আমরা মানুষ যেভাবে বেঁচে আছি সত্যি অবাক হওয়ার মতো।
দিদার -উদ্ভিদ/গাছপালা থেকে যে অক্সিজেন বেড়িয়ে এসে বাতাসের সাথে মিশে, সেখান থেকে মানুষ নাক দিয়ে অক্সিজেন টেনে নেয়। আগেই বলা হয়েছে যে, সূর্যের তাপ গাছের পাতায় গ্লুকোজ ও অক্সিজেন তৈরী করে। এর মধ্যে গ্লুকোজ নিয়ে বাঁচে উদ্ভিদ/গাছপালা, আর অক্সিজেন নিয়ে বাঁচে মানুষ/প্রাণীক‚ল।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এসবের প্রধান উৎস হলো সূর্য। আমাদের পৃথিবীর চেয়ে সূর্য তের লক্ষগূণ বড়। এটি একটি গোটা অগ্নিপিন্ড। এর উপরিভাগের উত্তাপ ছয় হাজার থেকে সাত হাজার ডিগ্রী সেণ্টিগ্রেড। কেন্দ্রের উত্তাপ দেড় কোটি থেকে দু’কোটি ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সূর্যের মধ্যে অনবরত মহাপ্রলয় ঘটে চলেছে। এর অণুগুলোর নিরবচ্ছিন্ন বিষ্ফোরণ হয়ে আগুনের প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। এই ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় প্রায় এক লক্ষ মাইল থেকে তিন এবং পাঁচ লক্ষ মাইল বেগে উর্দ্ধগতিতে ধাবিত হচ্ছে।

এই অগ্নিঝড়ের সামান্য কিছু অংশ পৃথিবীতে এসে পড়লে নিমিষে সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। কিন্তু সূর্য, পৃথিবী এবং সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলোকে এমন সুনিপুণভাবে মেপেজোকে তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে চালনা করা হচ্ছে যে একটুও এদিক-সেদিক নড়াচড়া করছে না। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে না হয়ে কম অথবা বেশি হলে পৃথিবী পুড়ে ছারখার হতো অথবা জমে ঠান্ডা বরফ হয়ে যেত।

দিনার- সূরা ইউনুসের ৫নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তিনি এমন সত্তা যিনি সূর্যকে করেছেন জ্যোতির্ময়, আর চন্দ্রকে আলোকময় করেছেন এবং নির্ধারণ করেছেন এর জন্য মনজিল যেন বছর গণনা ও হিসাব জানতে পার, আল্লাহ এটা যথার্থই সৃষ্টি করেছেন, তিনি বর্ণনা করেন আয়াতসমূহ সেসব লোকদের জন্য যারা জ্ঞানবান। তিনি সূরা যুমার-এর ৫ নং আয়াতে আরও বলেছেন, “তিনি আসমান-যমীন যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন; রাত দ্বারা তিনি দিনকে আচ্ছাদিত করেন, আর দিন দ্বারা আচ্ছাদিত করেন রাতকে। তিনি সূর্য-চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রত্যেকেই নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ঘুরতে থাকবে; তিনিই পরাক্রমশালী,ক্ষমাশীল”
রুহান- সত্যিই অপূর্ব সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকৌশল!
– টরন্টো, কানাডা