স্বপন শিকদার : সূর্যাস্ত হলো পৃথিবীর আবর্তনের ফলে দিগন্তের নীচে সূর্যের দৈনিক অন্তর্ধান। এটি এমন মুহূর্ত যখন সূর্যের উপরের অংশ দিগন্তের নীচে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রতিটি সূর্যাস্ত নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। প্রতিটি সূর্যাস্তও একটি সূর্যোদয়। আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এটি তার উপর নির্ভর করে।

গোধূলি লগ্নে সূর্যের মনে বুঝি ঘটা করে অভিমান জড়ো হয়। তাই তো পশ্চিমাকাশে অল্প অল্প করে ডুবে যেতে থাকে। গোধূলির আবিরে রাঙা অস্তয়মান লাল সূর্য। দিনের শেষে থেমে আসে চারপাশের কর্মকোলাহল। প্রকৃতিতে নেমে আসে অন্যরকম এক প্রশান্তি। পশু-পাখি নীড়ে ফিরে যেতে থাকে।

সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর শুরু হয় শ্রান্ত মানুষের ঘরে ফেরার পালা। চরাচরে সর্বত্রই বিরাজ করে এক নৈসর্গিক নীরবতা। সূর্যের রক্তিম আলোর ছটায় প্রকৃতি যেন অন্যরকম রঙে নিজেকে সাজায়। সূর্যাস্ত আমাদের মনের উপর বেশ প্রভাব ফেলে – মানসিক চাপ কমায়। ইহা অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। ইহা মনে ধর্মীয় অনুভূতি ও ভাবাগের সৃষ্টি করে যা সৃজনশীল, নিরাময় ও শক্তি পুনঃ জাগরণে বা সৃষ্টিতে কাজ করে। ইহা মনে পরিসমাপ্তির ভাব আনে। ইহার আকর্ষণীয় রং আমাদের অভিভূত করে। পৃথিবী যতদিন থাকবে, সূর্যাস্তও থাকবে। ইহা মোহনীয় ও মায়াময়। ইহা আমাদের চেতন ও অবচেতন মনের মধ্যে যেন সেতু। প্রত্যেক সূর্যাস্ত আমাদের কাছে এক সুন্দর ও নুতন দিনের ডালা নিয়ে আসে। সূর্যাস্তের প্রশান্ত ভাব আমাদেরকে স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে গভীরভাবে উপলব্ধি করায়।

সূযূাস্ত অনেক মহান ব্যক্তিত্বকে ভাবাবাগে আপ্লæত করেছে। যেমন – “When I admire the wonders of a sunset or the beauty of the moon, my soul expands in the worship of the creator.” -Mahatma Gandhi. ইহা সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রতীক। সূর্যাস্ত আমাদের মনে যাদুকরী মুহূর্তের সৃষ্টিকারী যাহা ভালোবাসার ব্যক্তিকে আরো কাছে পেতে দুর্নিবারভাবে আকর্ষণ করে।

সূর্যাস্তের সময় প্রকৃতিকে সতেজ, উজ্জ্বল এবং মনোমুগ্ধকর মনে হয়। সূর্য যেন স্বর্ণের একটি থালা। ইহার হালকা অন্ধকার আমাদের মধ্যে আনন্দ ও প্রশান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে। ইহার সৌন্দর্য আমাদেরকে কাব্যিক করে। সাগর তীরে দাঁড়ালে সূর্যাস্তের এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। বিস্তৃত সমুদ্র, সামনে কল্লোলিত ঢেউ, স্বর্গীয় আভায় রঞ্জিত আকাশ- এই শোভা, এই অপরূপ রূপের মাধুরী দেখে দু চোখের তৃষ্ণা যেন মেটে না। বিশ্বস্রষ্টা যেন নিজেকে আড়ালে রেখে মোহময় সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষকে ডুবিয়ে রেখেছেন। রহস্যময় এক মায়ার জগৎ সৃষ্টি করে খেলছেন আড়ালে বসে। সূর্যাস্তের সময় নির্জন সাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়ালে এমন আধ্যাত্মিক ভাবনা ভেসে আসে মনে। সূর্যাস্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আপ্লুত করেছে। যেমন –

‘সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার”।

দিবসের অবসান আর রাত্রির আগমনের এই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে পৃথিবী যেন মিলন-বিরহের খেলায় মেতে ওঠে। আকাশ আর মাটি যেন মুখোমুখি মৌনমুখর। সে অপার্থিব মৌনতা ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ চরাচরে, নদীবক্ষে, পর্বতে, অরণ্যে। ছায়াঢাকা গ্রামের নিবিড় প্রেক্ষাপটে সূর্যাস্তের দৃশ্য ঘোমটা-টানা লাজুক বধূর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আকাশের রক্তিম রঙে নদীর পানি রঙিন হয়ে ওঠে। এ সময় দিগন্তে দ্রুত রং বদলাতে থাকে। অস্তগামী সূর্যের লাল টিপ কপালে পরে পৃথিবী যেন নববধূর মতো সাজে। ঝিলিমিলি ঢেউখেলানো সোনারঙের পানিতে পালতোলা নৌকা ভেসে চলার দৃশ্য অপূর্ব লাগে। নদীর তীর ঘেঁষে বাতাসের স্রোত সাঁতরে উড়ে চলে সাদা বক, গাঙচিল, বালিহাঁসের ঝাঁক। কাব্য কথায় –
“বিকেলের রোদ লালচে আভায় মিলিয়ে যায় অস্তাচলে।
পাখি আকাশের ফিরে যায় ঘরে, না-বলা গল্প বলে”

রক্তিম সূর্য তার উষ্ণতা বিলিয়ে লাল হতে হতে নীচে নামতে থাকে। এক সময় মনে হয় সাগর আর আকাশ যেন মিশে গেছে দিগন্তরেখায়। সূর্য যেন কান পেতে শুনছে পৃথিবীর গোপন বিষাদের সুর। একটু একটু করে সাগরের বুকে হেলে পড়ে সূর্য। সাগরের বুকে যতোই হেলে পড়ছে সূর্য, ততোই আবিররঙা হয়ে উঠে আকাশ, চারপাশ। নিরবে সৈকতে আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে পা ভিজে দর্শনার্থী কেউর। ক্ষণিকেই আরও হেলে পড়ে, নিমিষেই একেবারে সাগরের বুক ছুঁই ছুঁই লাল সূর্য। সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে যায় সাগর জলে। ততোক্ষণে লাল সূর্য হয়তো সাগর জলে নিজেকে সপে দিয়েছে। সেই অগ্নিগোলক যেন সাগর বুকে টুপ করে ডুবে যায়। আঁধারে কালো চাদর আচ্ছন্ন করে চারদিক। চরাচরে ঝিঝির শব্দ, জোনাকির টিপটিপ আলো, ঝিরিঝিরি বাতাসে সৃষ্টি হয় নতুন এক আবেশ। ইচ্ছে হয় হৃদয়ে সন্ধ্যার অপরূপ রূপের মাধুর্য ধরে রাখার। কিন্তু বাস্তবে তা যে হবার নয়। রক্তিম আকাশ আর বিশাল সমুদ্রের প্রেক্ষাপটে সূর্যাস্তের বিচিত্র শোভা শুধু মনের পর্দায় চিরকালের আঁকা ছবির মতো ভাস্বর হয়ে থাকে। এক শাশ্বত অনুভূতিতে হৃদয় মন ভরে ওঠে।

সূর্যাস্ত আমাদের মনের উপর ভিন্ন ভাবেও বেশ প্রভাব ফেলে। যেমন একজন কবির দৃষ্টিতে সূর্যাস্ত –
“আমি সূর্যাস্ত দেখেছি, গোধূলি লগ্নে কৃষ্ণচূড়ার রঙিন আভায়,
লাল গোলাপের মৃত্যু মোহনায়, হংস-বলাকার নির্জীব পাখনায়
আমি সূর্যাস্ত দেখেছি, সব রঙিন স্বপ্নের অবসানে।
উর্বশী মেনকার ক্রন্দনে, আর শহীদের বাহু-বন্ধনে।
আমি সূর্যাস্ত দেখেছি, অনশন ক্লিষ্ট মানুষের চোখে, সর্বহারা মানুষের বুকে।
স্বৈরাচারের লাল পাথর ঠুকে, আমি সূর্যাস্ত দেখেছি
দেখেছি, দেখেছি বহুযুগ ধরে, আমি সূর্যাস্ত দেখেছি”।- সালেহা বড়লস্কর
সূর্যাস্ত আমাদেরকে ব্যথিতও করে। যেমন –
“কোন এক সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে ভেবেছি
জীবন সে তো এমনিভাবেই নিভে যাওয়া প্রদীপ!
যেখানে প্রতাপের দম্ভ ধীরে ধীরে হতে থাকে ক্ষীন
যেখানে অবারিত আলো নিয়মের ধারাপাতে নিমজ্জিত হতে থাকে এক নতুন ঠিকানায়.
এ জীবনের এতো আয়োজন, এতো দেনা-পাওয়ার হিসাব মিলাতে –
ঘুরছি গ্রাম থেকে শহরে, দেশ হতে দেশ
তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরি অনিয়ন্ত্রিত সুখ!
কতটা মিলে জীবনের যোগবিয়োগ? দিন শেষে হিসেবের খাতায় কেবল অন্ধকার
সূর্য ডুবে গেলে যেমন অন্ধকার হয় মায়ার পৃথিবী”। —– জয়নুল শামীম
সূর্যাস্ত দেখা রোমান্টিক ও প্রেরনাদায়কও। দিনান্তে সূর্যের প্রতিটি আলোকণা বালুকা বেলায় আঁচড়ে পড়ে, ঠিক যেমনি প্রতিটি ঢেউ এসে আঁচড়ে পড়ে সমুদ্র সৈকতে, স্নাত করে বালুকণা। প্রতিদিনের অস্ত যাওয়া সূর্য নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায় প্রেয়সীকে হয়তো এইভাবে –
“আমি কখনো যাইনি জলে কখনো ভাসিনি নীলে,
কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে,
আবার যেদিন তুমি সমুদ্রস্নানে যাবে, আমাকেও সাথে নিও,
নেবে তো আমায়?”- মৌসুমী ভৌমিক
শেষ গোধূলির রঙে সন্ধ্যা ঘনানো আলো নিঃশব্দে বিলীন মুহূর্তের মত কানে কানে যেন ফিসফিসিয়ে বলে যায় –

“তোমায় নিয়ে একদিন সূর্যাস্ত দেখতে যাবো, দেখতে যাবো সমুদ্রের বিশালতা।
হাতে হাত রেখে দেখব সূর্য আর সমুদ্রের ডুবে যাওয়া প্রেম।
তুমি জানো,সমুদ্র আর সূর্য-কতটা দূরত্ব তাদের মাঝে।
তবুও দেখো ঠিক বেলা শেষে নিয়ম করে এক হয়ে মিশে!
কি বলবে এই মিশে যাওয়া কে? ভালোবাসা? ” ———রুদ্র
বিকেল গড়াতেই পর্যটকদের চোখ যায় পশ্চিম আকাশে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় দেখা যায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য। বঙ্গোপসাগরের এই সৈকতের একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার বিরল সুযোগ থাকায় ইহা বিশ্বের অনন্য পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আটলান্টিক বীচ্, প্যাসিফিক বীচ্ সহ অনেক বীচের মধ্যে এখন পর্য্যন্ত আমার কাছে কক্সবাজার বীচকেই তুলনামূলক বিচারে ভাল মনে হয়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অতি মনোরম।

সূর্য অস্ত গেলে তবেই তো আমরা জোনাকী পোকার ঝিকমিক দেখতে পাই। এই সূর্য অস্ত গিয়ে গোটা দুনিয়াকে অন্ধকার করে দেয় বলেই তো আমরা আলোর কদর বুঝি। আমরা একটি সূর্যাস্তকে একটি নতুন ভোরে পরিবর্তন করতে পারি। সূর্য্যাস্ত দেখায় যে অতীত যতই সুন্দর হোক না কেন তা ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাই বর্তমানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সূর্য্যাস্তের রঙিন আলোয় জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে আবার রাঙিয়ে তুলতে হবে নিজেকে । সূর্য্যাস্ত প্রমাণ দেয় যে যাই ঘটুক না কেন, প্রতিদিন সুন্দরভাবে শেষ হতে পারে। সূর্য্যাস্ত উপভোগ করতে কেবল একটি সুন্দর হৃদয় প্রয়োজন। সূর্যাস্ত আমাদের স্বপ্ন গুলিকে নতুন রঙে রাঙিয়ে তোলে। সূর্য্যাস্থের ছবি সংগৃহীত। ধন্যবাদ।

লেখক, টরন্টো, কানাডা