সাজ্জাদ আলী
ডাক্তারের সাফ জবাব, “নিয়মিত যদি সাঁতারে না যাই তবে আমার শিরদাঁড়ার কয়েকখানা হাড় তাঁকে কাটাছেড়া করতেই হবে”। নিষ্ঠুর ডাক্তার আরো সতর্ক করেছে যে, এ ধরণের অপারেশনে সফলতার সম্ভাবনা যথেষ্ট খাটো! অগত্যা, জীবন চালু রাখতেই পাড়ার কমিউনিটি সুইমিং পুলে সাঁতরাতে যাই। বিশাল সেই পুলটিতে সেদিন টানা ২ রাউন্ড সাঁতারের পর ক্লান্ত হয়ে এক প্রান্তের রেলিং ধরে হাঁফাচ্ছিলাম। ওখানকার একজন সুইমিং ইনস্ট্রাকটর হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে ঘেঁষে বসলো। ভেজা গায়ে সংক্ষিপ্ত পোষাক পরিহিতা এ নারী তাঁর ধবধবে সাদা পা দুখানা জলে ডুবিয়ে নাড়ছে। পরিস্কার ইংরেজিতে নিচু গলায় বললো, এ কেমনতর সাঁতরানো তোমার? না ফ্রিস্টাইল, না বাটারফ্লাই, না সাইডস্ট্রোক- কোন ব্যাকরণেইতো পড়ে না? জলের মধ্যে উল্টাপাল্টা হাত-পা নাড়ছো? আচ্ছা বলোতো, তুমি জলে ভেসে থাকো কি করে? আর কোথা থেকেই বা এমন বিচিত্র উপায়ে সাঁতার শিখলে?
হেসে বললাম, তোমার মতো পেশাদার মাস্টারনি’র কাছে শিখিনি বলেই আমার সাঁতারের এই দূরাবস্থা। দেখ, আমার শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের জলে ডোবা একটি প্রত্যন্ত গাঁয়ে। সেখানে সুইমিং পুলের বদ্ধ জলে সাঁতার শেখার স্কুল নেই। আছে প্রাকৃতিক খাল, বিল, পুকুর, নদীতে উন্মুক্ত দাপুটে জলরাশি! সেখানে বেঁচে থাকার তাগিদেই শিশু বয়সে প্রত্যেককে সাঁতার শিখে নিতে হয়। এই যেমন ধরো, মাত্র ৫/৬ বছর বয়সে আমি নৌকা থেকে পানিতে পড়ে গিয়ে একা একাই সাঁতরাতে শিখেছিলাম। সুন্দরী গালে হাত দিয়ে আমার কথা শুনছে। তাঁকে আমার সাঁতার শেখার ঘটনাটি বললাম। বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনলো সে। তারপরে হো হো করে হেসে উঠে বললো, বেশ গল্পকার তো তুমি! অমন করে কেউ সুইম শিখতে পারে নাকি? বুঝলাম, আমার কথার এক কানাকড়িও সে বিশ্বাস করেনি। তা সে না করুক, আমার পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন। দুর্দান্ত সে কাহিনীটি আপনাদেরই তবে বলি।
সেদিন ভরাভাদ্রের ভর-দুপুরে আমাদের কানাপুকুরের স্বচ্ছ জল টলমল করছিলো। ৪/৫ বিঘা জুড়ে দাদীর মস্ত সে দিঘীটি বাড়ির পশ্চিম পাশ লাগোয়া। পুকুরটির পশ্চিম কোণে তালবাড়ি, উত্তর-পশ্চিম পাড়ে মুন্সিকাকার বাড়ি, দক্ষিণ পার্শ্বে তফু বুজির বাড়ি, আর উত্তর সীমানায় ঘুণা’র ভিটা। সে বছর বর্ষার পানি প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছিলো। আর এক ফুটের মতো বাড়লেই দিঘীর চারপাশের এই বাড়িগুলোর উঠোন পানিতে তলিয়ে যাবে। কানাপুকুরের মাঝখানে গভীর জল। ১৫ ফুট লম্বা বাঁশের চৌড়ও ঠাই পায় না। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতে বৈঠা দিয়ে নৌকা বাইতে হয়।
দিঘীতে ইতস্ততঃ ছড়ানো হালকা আকাশী রংয়ের কচুরীপানার ফুলগুলো বাতাসে দুলছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে সহস্র নাইল ফুল ফুটে রয়েছে (শাপলার দেশজ নাম)। জলের গভীরতা ভেদে সে সব নাইল ১০ থেকে ১৫ ফুট লম্বা। ডাসা ডাসা ডগাগুলো উৎকৃষ্ট তরকারী বটে। তা দিয়ে যেকোন মাছ রাঁধা চলে, কেটেকুটে তা ডালের মধ্যেও দেওয়া যায়, আবার মরিচ পেঁয়াজের ফোঁড়ানি দিয়ে তেলে ভাজলেও খেতে অতি সুস্বাদু। ভরা বর্ষায় গাঁয়ের কর্মহীন হতদরিদ্র মানুষদের কাছে এই নাইল সিদ্ধ দিনের প্রধান খাদ্যও বটে। দিঘীর দক্ষিণ সীমানায় তখন কলাগাছের ভেলায় চড়ে সর্দার বাড়ির ছেকন কাকা নাইল উঠায়ে পাঁজা করে রাখছে।
ভাদ্রমাসের অলস সেই দুপুরে জ্ঞাতি-স্বজনেরা বাড়ি সংলগ্ন টইটুম্বুর জলেপূর্ণ কানাপুকুরের পূর্ব পাড়ে জটলা পেতেছে। কাজের কাজ কিছুই না, বেকার সব গালগল্পে সময় কাটানো। হিজল গাছটির ছায়া অর্ধেক পড়েছে জলে, বাকিটা বাড়ির আঙ্গিনায়। সেই ছায়ায় চাচিফুফুরা সারি বেঁধে বসে একে অন্যের মাথার চুলের তদারকি করছে। জাকিয়া ফুফু মেজকাকীর চুলে তেল মেখে সিঁথি কেটে দিচ্ছে। শহিদা ফুফু আম্মার চুলের উঁকুন মারছে। ছোট ফুফু বেজায় সুন্দরী, গায়ের চমড়া ধলা, তাঁর ডাটই আলাদা। তিনি কাউকে তাঁর মাথায় হাত দিতে দেন না। বসেছেন গিয়ে কাকাদের মাদুরে। দাদি শান্তিপুরি কড়া জর্দা দিয়ে পান খেয়ে জলচকিতে বসে ঝিমুচ্ছেন।
বরই গাছটির ছায়ায় শীতল পাটি পেতে কুটিকাকা আর এসকেন কাকা তাঁদের দলবল নিয়ে তাস পেটাচ্ছে। নোয়াকাকা দুটো বালিশে ঠ্যাস দিয়ে আধো সোয়া অবস্থায় পুরো দিঘীর উপরে নজর রাখছেন। তাঁর পাশে দোনলা বন্ধুকটি রাখা, আর গুলির বেল্টে ৪ নম্বর, ৬ নম্বর ও ১২ নম্বরের সব বুলেট গোঁজা। শিকারের অপেক্ষায় তিনি। মাঝেমধ্যেই দিঘীর জলে ঘ্যাড়-ঘ্যাইড়া পাখি উড়ে এসে বসে (হাঁস জাতীয় পক্ষী বিশেষ)। নোয়াকাকার পাখি শিকারের নেশা এলাকায় কিংবদন্তি। বিশ্বাস বাড়ির নুরুন্নাহার বেগম (আমাদের হবু নোয়াকাকি) যদি ডান দিক থেকে ইশারা করে নোয়াকাকাকে কাছে ডাকেন, আর বাম দিকের গাছের ডালে যদি একঝাঁক বকপাখি এসে বসে; তো তিনি বন্দুক হাতে বাম দিকেই ছুটবেন!
আমার সাইজের ছোটগুলান কেউ হাঁটু জলে নেমে ভেসে থাকা লাটিম কুড়াচ্ছে। কেউ বা হিজল গাছে উঠে ফুল ছিঁঁড়ে গামছার পোটলায় জড় করছে। হাসান আর কাফু পাল্লা দিয়ে লাটিম গাছের ছিটকি ডাল থেকে ডাইভ দিয়ে দিঘীর জলে পড়ছে। ছোটরাই সেখানে কাজেকম্মে ব্যস্ত; বড়রা অলস সময় পার করছে মাত্র। তখন কতই বা বয়স আমার, আন্দাজ বছর পাঁচেক হবে। আমি উঠেছি বরই গাছটিতে, বারাইস্যা বরই ছিড়বো বলে (অসময়ে ধরা বরই)। এ ডাল থেকে ও ডালের পাকা বরই ছিড়ছি বটে, কিন্তু খেতে পারছি না। সব বরইগুলা আমার আগেই পোকায় খেয়ে রেখেছে। খানিক বাদে বাদে দাদী চেঁচাচ্ছেন, অ্যাই তুই নামলি গাছ থ্যাইকা? এহনের বরই কি খাওয়া যায়? ডাল ভাইঙ্গা পইড়া যাবি, আর গাছে গরাইল আছে! নাইমা আয় কইছি। কে শোনে কার কথা! ডাল থেকে ডালে বরই খুঁজে ফিরছি!
ঘাটে বাঁধা ছোট নৌকাখানিতে উঠে আলোহাজ কাকা মাত্রই বেঠাখানা হাতে নিয়েছে। কি খেঁয়ালে যেন আমি গাছের ডাল থেকে এক লাফে রান্নাঘরের চালে নেমে চেঁচায়ে বললাম, অ্যাই নাও ভাসাইও না আমি যাবো। আরেক লাফে মাটিতে নেমে একদৌঁড়ে গিয়ে নৌকায় উঠলাম। সে কোথায় যাবে তা আমার তখনও জানা নেই। তবে আলহাজ আমাকে নৌসঙ্গী হিসেবে পেয়ে বেশ খুশি হল। সাদাসিদা এই আলোহাজ আমার জ্ঞাতি কাকা, বয়সে খানিকটা বড় হবে। বললো, চল তয় দুইজনে মিলা নাইল উঠাই। আরেব্বাস! আমি তো বেজায় খুশি। আর বিলম্ব নয়, নৌকা ভাসালো আলোহাজ কাকা। জর্দার ঝিমুনির ফাঁকে দাদী বললেন, অ্যাই আলোহাজ সাবধানে নাও বাইস, ও কলাম সাঁতার জানেনা। আলোহাজ নিজেও যে সাঁতরাতে জানে না, সে সত্যটি খানিক বাদেই বোঝা গেল।
তো সেদিন দাদীবাড়ির পশ্চিম ঘাটে কানাপুকুরের পাড় ঘেঁসে বৃহত্তর পরিবারের জনাতিরিশেক মানুষ বসে খোসগল্পে মত্ত ছিলো। আলোহাজ কাকার নৌকা ধীরে ধীরে নাইল ফুলের মধ্যে ঢুকছে। আমি নৌকার সামনের একেবারে শেষ প্রান্তে গলুইয়ের দুপাশে দুইপা ছড়ায়ে বসেছি। পা দুখানি নৌকার দোলায় কখনও কখনও জল স্পর্শ করছিলো। একটি পর একটি নাইল তুলে নৌকার খোলে ছুড়ে ফেলছি। জলের গভীরতা ভেদে ওগুলো ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা। আলোহাজ বকছে আমাকে, কি করতিছিস তুই? মোটা দেইখা উঠাবার পারিস না? হাবাজাবা নাইল উঠাইয়া নাও ভরতিছিস ক্যা? ওই যে ডাইন দিকির ওইডা উঠা, চাইয়া দ্যাখ ওই যে বড় ফুল যেইডার। এভাবে আলোহাজ কাকা নৌকার সামনের গলুই তার পছন্দমত মোটামোটা নাইলগুলার কাছে নিচ্ছে। আর আমি একটার পর একটা উঠাচ্ছি। বাড়ির ঘাট থেকে আমরা ততক্ষণে ২০০ ফুটের মতো দূরবর্তী। বেশি দূরে নৌকা নেবার দরকার পড়ছে না। সহ¯্র শাপলা পুকুরে ফুটে আছে। কোন কোন নাইল ফুল আবার পরিপক্ক হয়েছে, গোড়ায় হয়তো শালুক জন্মে থাকবে।
বিপুল আনন্দে নাইল উঠাচ্ছি আমি। ওগুলো তুলতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। ফুল ধরে টান দিলেই অনায়াশে উঠে আসে। তবে কোন কোনটার গোঁড়া খানিকটা শক্ত বটে, একটু জোর খাটায়ে টান দিতে হয়। নৌকার খোল প্রায় ভরে গেছে নাইলে। বাড়ি থেকে দাদী চেঁচিয়ে বললেন, ওই আলোহাজ ফিরা আয় আর লাগবি না। আলোহাজ নৌকা ঘুরিয়েছে বাড়ির দিকে। এমন সময় ঢাউস সাইজের একটি শাপলা ফুল দেখে আমি হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে টান দিয়েছি। কিন্তু ওটির গোড়া শক্ত, তা উঠে আসে নি। আমি আরো জোর খাটাতেই গলুইয়ের উপর থেকে নিজেই ছিটকে পানিতে পড়ে গেলাম। পড়ে যাবার প্রথম মুহুর্তেই আমি নৌকার ডালি ধরার চেষ্টা করেছিলাম বটে। কিন্তু আমার পড়ার ধাক্কায় নৌকাখানি তাৎক্ষণিক ৫/৭ ফিট সরে গিয়েছে।
আমার পানিতে পড়ে যাবার এ দৃশ্য বাড়ির ঘাট থেকে দেখা মাত্রই সবাই মরণ চিৎকার শুরু করেছে। কাকারা ৫/৭ জন তড়িৎ ঝাপ দিয়ে দ্রুত সাঁতরে আমার দিকে এগুচ্ছেন। আলোহাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সে নিজে সাঁতার জানেনা। নৌকা বেয়ে আমার কাছে এগুবে, সেই হুঁশটুকুও তার নেই। বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকার চরাটের উপরেই সে লাফাচ্ছে, আর চিল্লাচ্ছে! ওরে বাঁচাও তুমরা, আমি সাঁতরাবার পারি না! পানিতে পড়ে যাওয়া সেই ছোট্ট আমি সেই ক্ষণটিতে ঠিকই বুঝেছিলাম, “কিছুতেই ডুবে যাওয়া চলবে না”। খানিকক্ষণ অন্তত ভেসে থাকতেই হবে।
সাঁতার কি, তার কৌশল কি, পানিতে কিভাবে ভেসে থাকতে হয়, কিছুই তো জানি না। জলের মধ্যে শুধু জীবনপণ করে হাত পা ছুড়ছি, আর মাথাটা জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে অন্তত ৩০ সেকেন্ড কেটে গেছে। আল্লাহ’র ইশারায় হয়তো সেদিন সেই অবুঝ হাত পা ছোড়াটাই সাঁতারের আদলেই করে ফেলেছিলাম। ডুবে যাই, আবার ভেসে উঠি! ঢকঢক করে পানি পেটে ঢুকছে! দুএকবার যেন নৌকাখানা দেখতেও পেয়েছিলাম। আলোহাজকে ডাক দেবো, কিন্তু তার আগেই আবার ডুবে যাই! এভাবে কতক্ষণ যে নিজেকে ডোবা-ভাসার সংগ্রামে রাখতে পেরেছিলাম আজ আর তা স্মরণে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে, কুটিকাকার বাহু বন্ধনে নিজেকে আবিস্কার করেছিলাম।
কাকা আমাকে নৌকার মাচাইলের উপরে শুইয়ে দিয়ে ফোলা পেট চেপে চেপে মুখ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করছিলেন। আমি চোখ মেলতেই স্ব¯েœহে আমার কপালে হাত রেখে বললেন, ভয় পাইছিস নাকি রে? আমি ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বললাম, কই না তো। কুটিকাকা বললেন, এই তো বড় ব্যাটার মতো কথা, তোর কি ভয় পাইলে চলে রে? আর তুই তো আজ সাঁতার শিখে গেছিস বাবা! আমি ফিক করে হেসে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। দেখি অন্য কাকারাও ততক্ষণে দিঘীর মাঝের পানিতে নৌকার চারপাশের ডালি ধরে জলে ভাসছেন। বাড়ির ঘাটের দিকে চেয়ে দেখি চাচিফুফুরা সবাই সাঁতরে নৌকার দিকে এগুচ্ছেন, আর আমার দাদী গলা জলে দাঁড়িয়ে শুকরানা আদায় করছেন!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)