হাসান গোর্কি : আয়তনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৯২ তম স্থানে- রাশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার তুলনায় ১১৫, ৬৭, ৬৬ ও ৬৫ গুণ ছোট। ভারত, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের তুলনায়, ২২, ১৪, ও ৫ গুণ ছোট। জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দারিদ্র্যপীড়িত এই ক্ষুদ্র অঞ্চল নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর আগ্রহ যেভাবে ডালপালা মেলেছে তা আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে। বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে তা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে পরাশক্তিসুলভ নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন স্তরে পৌঁছায়নি যে তা কারো দুশ্চিন্তার কারণ তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর ৩৫ তম অর্থনীতির দেশ। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের (জিএফপি) ২০২৩-র মিলিটারি স্ট্রেন্থ র্যাঙ্কিংয় অনুযায়ী সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। বাংলাদেশ প্রায় পুরোটা-ই পরিবেষ্টিত পৃথিবীর চতুর্থ সামরিক শক্তি ভারতকে দিয়ে। অন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারও বাংলাদেশের চেয়ে তিন ধাপ (অবস্থান ৩৭তম) শক্তিশালী। তাহলে বাংলাদেশে কোন্ দল ক্ষমতায় থাকলো তা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো কেনো? এর সোজা উত্তর হলো, বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যক্রমে ও ঘটনাচক্রে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের (এবং অংশত রাশিয়ার) অঘোষিত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধের সুবিধা আমরা পেয়েছিÑ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভূত হবার পেছনে দুই পরাশক্তির এই বৈরিতার বড় ভ‚মিকা ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের লক্ষ্য ছিলো এশিয়ায় সোশ্যালিজমের বীজ বপন। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিলো এ অঞ্চলে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা। সেই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন জিতেছে বলে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি।

এবারের বৈরিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে এসেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশ্বে প্রথম অর্থনৈতিক পরাশক্তি ও দ্বিতীয় সামরিক শক্তি হবার পথে আছে চীন। চীনের এই উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বস্তিকর নয়। দক্ষিণ চীন সাগরের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ (যেমন, প্যারাসেল, স্প্র্যাটলি) এবং সংলগ্ন জলসীমা নিয়ে চীনের সাথে ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, ব্রুনেই ও মালয়েশিয়ার বিরোধ আছে। চীন সেখানে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে এবং নৌবাহিনী পাঠিয়ে টহল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট কোনো পক্ষ না নিলেও তাদের ভাষায় ‘নৌপথে চলাচলের স্বাধীনতা’ রক্ষার জন্য সেখানে যুদ্ধ জাহাজ ও বিমান পাঠিয়েছে। চীনের নৌ-বাহিনীর অস্বাভাবিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে ভারত মহাসাগরে তাদের মিত্র ভারতের নৌ-আধিপত্য খর্ব হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম ‘গেøাবাল টাইমস’ গত ২৮ অগাস্ট সে দেশের ‘স্ট্যান্ডার্ড ম্যাপে’র ২০২৩ সালের যে সংস্করণ প্রকাশ করেছে তাতে ভারতের পুরো অরুণাচল প্রদেশ, ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পর চীনের দখলে চলে যাওয়া ‘আকসাই চিন’, তাইওয়ান এবং বিতর্কিত সাউথ চায়না সি এলাকাকে (তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরের ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’ দিয়ে চিহ্নিত অংশ) নিজেদের দেশের অংশ বলে দাবি করেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট এটাকে ‘কার্টোগ্রাফিক অ্যাগ্রেশন’ (মানচিত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর ক‚টনৈতিক পরিভাষা) বললেও চীনের মূল লক্ষ্য যে এই অঞ্চলগুলো দখলে নেওয়া সেটা অনুমান করতেও ভুল করেনি। লাদাখসহ সীমান্ত অঞ্চলে প্রায় ২০০০ বর্গকিলোমিটার ভারতীয় ভ‚খণ্ড চীনের দখলে চলে গেছে বলে ভারতের কংগ্রেস নেতারা যে দাবি করে চলেছেন তার সমর্থনে ভারতের গণমাধ্যমে স্যাটেলাইট ইমেজ প্রকাশিত হয়েছে। এই বিষয়গুলো বিশ্ব-আধিপত্যের লড়াইয়ে নামা (বা আগে থেকে নেমে থাকা) যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবিয়ে তুলেছে।

এই আর্টিকেলের শিরোনামের (“বাংলাদেশ কি আর একটি সিরিয়া হতে চলেছে”) আলোচনায় চীন কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? চীন দক্ষিণ চীন সাগর ও আরব সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি গাঁড়তে চায় যাতে পুরো অঞ্চলটা তাদের অধিকারে আসে। এটা তাদের বেশ পুরনো পরিকল্পনা। এক দশকেরও বেশি আগে চীন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে বাংলাদেশকে অর্থ ব্যয়ের বিচারে খুব-ই সাশ্রয়ী ও সুবিধাদির বিচারে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল। আমাদের মনে আছে, প্রস্তাব নিয়ে সে দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী নিজে ঢাকা এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চাপে বাংলাদেশ সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও চীনের সাথে বানিজ্য সম্পর্ক বাড়িয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, এই সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র এমনকি ভবিষ্যতে রাশিয়ার নেতৃত্বে একটা জোট পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। গত এক দশকে বাংলাদেশের আমদানি করা অস্ত্রের ৭৩.৪৪% এসেছে চীন থেকে। এ’সময় পাকিস্তানের পরেই চীনের অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজারও ছিলো বাংলাদেশ। ৫১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে চীনের জিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত সড়কপথ নির্মাণ করেছে চীন। রেলপথ নির্মাণাধীন। দুই দশকের জন্য বন্দরটির মালিকানাও লাভ করেছে তারা। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (এক অঞ্চল, এক পথ) উদ্যোগের নামটির মধ্যে যে সামরিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে সেটা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অস্বস্তি ও একই সাথে ভীতির কারণ। হিন্দুস্থান টাইমস-এর কলামিস্ট রাজেশ মহাপার্থ এনডিটিভি-র এক টক শোতে বলেছিলেন, এখানে ‘রোড’ শব্দটির ব্যবহার হয়তো ফিগারেটিভ- যার অর্থ হতে পারে মতাদর্শ বা জীবনপ্রণালি।

এই উদ্যোগের পরিধি প্রাথমিকভাবে এশিয়া ও ইউরোপের প্রায় ৬০টি দেশ। ওশেনিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকাও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অনির্দিষ্টকাল সময়সীমা ধরে আনুমানিক ক্রমসঞ্চিত বিনিয়োগ ৪ থেকে ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক দুটি উদ্যোগের (‘ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ ও ‘দি ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ’) জন্য সরাসরি হুমকি না হলেও তাদের অর্জনের গতিকে শ্লথ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এই দ্ব›েদ্ব ঢুকে পড়েছে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে। এটাকে আমরা দুর্ভাগ্য মনে করছি। কিন্তু এটা সৌভাগ্যও হতে পারে। বিষয়টা নির্ভর করবে কতোটা বুদ্ধির সাথে বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি থেকে সুবিধা লাভ করতে পারে তার ওপর। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং এর ঢাকা সফরের সময় ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ যোগ দেয়- যে পরিকল্পনার অংশ কুনমিং থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ। বাংলাদেশে চীনের মেগা প্রকল্প চালু আছে ৯টি, যেগুলোতে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ৮.৮০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর প্রায় ৭০ শতাংশই বিনিয়োগ হয়েছে চীন সরকারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, বিআরআইয়ের অধীনে। এই বিষয়গুলোকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার এশীয় মিত্র ভারত অপছন্দ করছে না। তাদের বিশ্বাস এই উন্নয়ন উদ্যোগের মূল বা চূড়ান্ত লক্ষ্য সামরিক।

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বৈরথের ডামাডোলে ভারত অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চেয়ে পাকিস্তানের বিভাজন ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। পেটের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান তাদের জন্য ভীতির কারণ ছিলো। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর একই ভীতি টিকে থাকা তাদের কাছে কাম্য নয়। ভারত বাংলাদেশে এমন কোনো সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না যারা ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি তৈরি করবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং চীন-পাকিস্তান থেকে অস্ত্র পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার কিছুদিন পর ভারতীয় দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রি বলেছিলেন, “আমরা বাংলাদেশের বন্ধু। বাংলাদেশ চাইলেও আমরা বন্ধু থাকবো। না চাইলেও থাকবো। অতীতে যে ভুল আমরা করেছি তার পুনারাবৃত্তি আর হবে না।” “না চাইলেও” অর্থ কী? জোর করে বন্ধু থাকা? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্তির ২৬ দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কথায় ভারত বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যুক্তরাষ্ট্র অধিকৃত দেশগুলোর বন্ধু হয়েছিল জোর করে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ৮ দশক আগে। এখনও জার্মানিতে ১৭২টি, ইতালিতে ১১৩টি, জাপানে ৮৪টি মার্কিন ঘাঁটি আছে। ১৯৯৪ সালে ফিলিপাইন থেকে সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী অবস্থান নিয়ে উদ্বিঘ্ন যুক্তরাষ্ট্র এ’বছরের এপ্রিল মাস নাগাদ তাইওয়ানের কাছাকাছি ফিলিপাইনের মূল দ্বীপ লুজন, দক্ষিণ চীন সাগরের পালাওয়ান প্রদেশের বালাবাক দ্বীপের সান্তা আনা, কাগায়ান প্রদেশের ক্যামিলো ওসিয়াস, লাল-লো ও মেলচোর-এ নতুন করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে।

১৯৭২ সালে ভারত তড়িঘড়ি সৈন্য প্রত্যাহার না করলে হয়তো ’৭৫-র পট পরিবর্তন ঘটতে পারতো না। বিনা সিক্রির বক্তব্যকে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রতিফলন হিসেবে ধরে নিলে ১৯৭২-এর সৈন্য প্রত্যাহারকে ভারত ‘ভুল কাজ’ মনে করে বলে ধরে নেওয়া চলে। আওয়ামীলীগ সরকার তাদের সব ক’টি দফায় ক্ষমতায় থাকা কালে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কঠোর হাতে দমন করেছে। ব্যবসা-বানিজ্য সহ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে লেনদেন হয়েছে তাতে ভারতের লাভের পাল্লাই ভারি (এই সমীকরণ চীনের ক্ষেত্রেও একই)। তাহলে আওয়ামীলীগকে আবারও ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে ২০১৪ ও ’১৮-র তুলনায় এবার ভারতকে কম উৎসাহী মনে হচ্ছে কেনো? প্রথমত এই ধারণাটি ভুল যে ভারত বাংলাদেশের ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য কোনো দলকে দেখতে চায়। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সা¤প্রতিক বিবৃতিগুলো খুব অস্পষ্ট। এগুলোতে বারবার শুধু বলা হয়েছে, ‘তারা বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়’। এ দিয়ে তারা পরোক্ষভাবে হয়তো আওয়ামীলীগ সরকারের ধারাবাহিকতার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝাতে চেয়েছে। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া (অথবা বড় স্বার্থ জড়িত না থাকলে) কোনো রাষ্ট্র তার প্রতিবেশীকে সমৃদ্ধ হতে দেখলে খুশি হবার কারণ নাই। এই অখুশি হওয়াটা দেশপ্রেমের নমুনা।

ভারত চায় চীনের সাথে সম্পর্ক যতোখানি সম্ভব শিথিল করে আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় আসুক। এই প্রতিশ্রুতি আদায়ের জন্য তারা ক‚টনৈতিক উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামীলীগ যদি শেষ পর্যন্ত তাতে রাজি না হয় তাহলে ভারত আওয়ামীলীগের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে এমন ভাবার কারণ নেই। ২০১৪ ও ’১৮-র ধরণের নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য আওয়ামীলীগের পক্ষে ভারতের সমর্থন ২০২৪-এ এসে যথেষ্ট হবে না এটা স্পষ্ট হয়েছে। সে’সময় এ অঞ্চলে প্রভাবশালী ও বড় মিত্র হিসেবে ভারতের স্বার্থকে যুক্তরাষ্ট্র বড় করে দেখেছে। ফলে নির্বাচনের পরও পশ্চিমা গণমাধ্যম অনিয়মের তেমন কোনো অভিযোগ তোলেনি। এখন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থকে উপেক্ষা করার বাস্তবতায় নাই। এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে আওয়ামীলীগ চীনের সাথে সকল সম্পর্ক (বিশেষ করে যেগুলো চীনের জন্য সামরিক শক্তি স¤প্রসারণের কৌশলগত সুবিধা বৃদ্ধি করে) সর্বনিম্ন মাত্রায় শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দিলে ২০১৪ ও ’১৮-র ধরণের আর একটি নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে পারবে। সেন্টমার্টিনে গুয়ামের মতো একটা সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতির প্রতিশ্রুতি দিলে কাজটি আরও সহজ হয়ে যাবে। আওয়ামীলীগ এই সহজ বিকল্পটি বেছে নিচ্ছে না কেনো?

সামরিক ঘাঁটির অনুমতি দিলে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির পুরনো অভিযোগ উঠবে। তারা সেটার ভয় পায়। বিএনপি-র কাছে যুক্তরাষ্ট্র এ’রকম প্রতিশ্রুতি পেয়েছে কিনা সেটা অনুমানের চেষ্টা করা অমূলক হবে। তবে তারা এ’রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলে তা বাস্তবায়নে জনগণের পক্ষ থেকে বাধা থাকবে না। কারণ বিএনপি-র বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ নাই। এছাড়া গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের বড় অবদান আছে। আওয়ামীলীগ এই চমক ধরে রাখতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো ব্যক্তিগতভাবে চান তাঁর মৃত্যুর পরও এই বিস্ময়কর অবকাঠামোগুলোর দিকে তাকিয়ে মানুষ তাঁর নাম নেবে। চীন যতো কম টাকায় জিনিসপত্র দিতে পারে পৃথিবীর কেউ তা পারে না। যেমন, চীন না থাকলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করাই কঠিন হতো। আমাদের এই প্রকল্পের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা দাইয়ু ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ পেলে আমাদের খচর হতো দ্বিগুণেরও বেশি টাকা। আর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানির কাছে করিয়ে নিলে হয়তো খরচ হতো ৫/৭ গুণ বেশি। বছর পাঁচেক আগে যুক্তরাষ্ট্র ২ কিলোমিটার দীর্ঘ অকল্যান্ড বে ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় করেছে ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে চীন ১৬৫ কিমি লম্বা Danyang–Kunshan Grand Bridge নির্মাণে ব্যয় করেছে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। সস্তা জিনিস পাওয়া যায় এমন দুই প্রতিবেশী দেশ, ভারত ও চীন আছে বলে আমরা যে সুবিধা পাচ্ছি সেটা আমাদের ভৌগলিক আশীর্বাদ (আমি নিশ্চিত, অভিশাপ নিয়েও একটা চৌকশ ও জনপ্রিয় নিবন্ধ হতে পারে)।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাঘের লেজ ধরার বাস্তবতায় বাংলাদেশ নাই। তাছাড়া পুতিন ও সি-র মতো দুই বিশ্ব নেতার আবির্ভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে। আওয়ামীলীগ সাহস করে দ্বিতীয় বিকল্প বেছে নিয়েছে এটা স্পষ্ট। ২০১৪ ও ’১৮ ধরণের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামীলীগের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও তারা সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্বসহ সকল পক্ষ জেনে গেছে। কিন্তু তাদের পক্ষে এ’রকম একটা নির্বাচন সরাসরি ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তারা সে’রকম চায়ও না। জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান, মানবাধিকার পরিস্থিতি, ভোটাধিকার ইত্যাদি প্রসঙ্গ এনে হয়তো তারা বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চায় যাতে জাতিসংঘের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি হয়। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার এ’রকম ঘটেছে। আসন্ন নির্বাচনে বড় ধরণের সহিংসতা ঘটলে আওয়ামীলীগের সকল প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে পারে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের (মূলত যুক্তরাষ্ট্রের) বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ চাইলে সিরিয়ার মতো বহুপাক্ষিক দ্ব›েদ্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব যতোটা সাহসী তাতে অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়োজনে বড় ঝুঁকি নিতে তারা কুণ্ঠিত হবেন বলে মনে হয় না।

আওয়ামী লীগ যদি তত্ত¡াবধায়ক ধরণের কোনো সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচন দেয় তাহলে দেশের জন্য সকল ঝুঁকির অবসান হবে। কিন্তু দলের জন্য সেটা বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। বিএনপি ভালো ব্যবধানে ক্ষমতায় আসবে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টিকে এই ভ‚খণ্ডে বসবাসকারী মুসলমানদের ৯৫% সমর্থন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ বঙ্গবন্ধু নিজেও পাকিস্তান আন্দোলনের একজন নিবেদিত সৈনিক ছিলেন। মুসলিম লীগ যে চেতনা ধারণ করতো সেটা এখন বিএনপি-জামায়াত ধারণ করে। এটাই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেতনার মূল ধারা। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে এই ধারার জন্য মর্যাদাপূর্ণ পরিসর ছেড়ে দিতে হবে। আসলে বাংলাদেশের মানুষ হুতি-তুতসিদের মতো আওয়ামীলীগ ও বিএনপি-তে জাতিগতভাবে বিভক্ত। এই বিভক্তি অদৃশ্য কিন্তু গভীর ও অনপনেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শতবছর একইভাবে টিকে থাকবে এটা কল্পনাবিলাস। অনেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এবং ‘স্বাধীনতার চেতনা’ প্রত্যয় দু’টিকে এক করে ভাবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদের পরম বন্ধু ছিলো, বঙ্গবন্ধু একক ও অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন, আওয়ামীলীগ (ক্ষুদ্র কম্যুনিস্ট পার্টির সমর্থনে) একমাত্র রাজনৈতিক দল ছিলো। সেটা ছিলো ১৯৬৬ থেকে ’৭১-র বাস্তবতা। আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় জীবনে সেই চেতনার প্রতিফলন এখনও দেখতে চায়। এটা তাদের অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব দান করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে কংগ্রেস দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় এবং ১৯৪৭ থেকে ’৭৭ — একটানা ৩০ বছর দেশ শাসন করে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-র উত্থানে সেই কংগ্রেস এখন বিলুপ্তির পথে।

‘স্বাধীনতার চেতনা’ এখন জামায়াত সহ সকল দল ধারণ করে। আওয়ামীলীগ দেশ স্বাধীন করলেও সে’সময়ে বিরোধিতাকারী জামায়াত সহ পরবর্তীতে তৈরি হওয়া বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল তার সুবিধা ভোগ করছে। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী বলে বাংলাদেশে কেউ থাকার কারণ নেই। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে কিছু ঘটবে না এটা সবাই বোঝে। কিন্তু সমস্যা হলো আওয়ামীলীগ ও বিএনপি-র মতপার্থক্য রাজনৈতিক পরিধিতে সীমাবদ্ধ নেই। স্বাধীনতার পাঁচ স্থপতিকে (ও তাঁদের অনেক পরিজনকে) হত্যার সাথে জড়িতদের পুরস্কৃত ও পুনর্বাসিত করে বিএনপি রাজনৈতিক দর্শনে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সাথে বিএনপি-র সংশ্লিষ্টতা প্রায় শতভাগ বলে সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকা আওয়ামীলীগের জন্য একটা জিরো সাম গেম। নিরপেক্ষ নির্বাচন দিলে তারা শুধু ক্ষমতা হারাবে তা-ই নয়, বোমা মারার জন্য স্বেচ্ছায় নিজেদের মাথাও পেতে দেবে। এই উপলব্ধি তাদের কাছে স্পষ্ট। তাই কোনো উপদেশ-পরামর্শ এক্ষেত্রে কাজ করবে না। ধানক্ষেতে বিবদমান দুই প্রতিপক্ষের একজনকে যদি আপনি বলেন তার হাঁসুয়াটা অন্যজনের হাতে তুলে দিতে তাহলে আপনার নিরপেক্ষতা নিয়েও লোকের মনে প্রশ্ন দেখা দেবে। খুব দূর (নাকি দূরদর্শী?) অনুমানকে প্রশ্রয় দিলে ধারণা করা চলে, আগামী নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং বাংলাদেশ সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক বা লিবিয়ার ভাগ্য বরণ করবে। আর আওয়ামীলীগ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে পারলে চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম উদাহরণ হিসেবে দ্রæত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা একটি দীর্ঘমেয়াদী একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ।

hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা