হাসান গোর্কি : “পূর্ণমদ, পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।“
[এই পরব্রহ্ম পূর্ণ (অখণ্ড)। এই নাম-রূপস্থ ব্রহ্মও পূর্ণ। পূর্ণ হতে পূর্ণ উদ্গত হন]।
আলোর বিপরীতে অন্ধকার সত্য, সত্যের বিপরীতে মিথ্যা সত্য। তাহলে অস্তিত্বের বিপরীতে কি ‘অনস্তিত্বে’র সত্য হবার সম্ভাবনা আছে? ননইজম মনে করে যে ভৌত জগতের অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ, আমরা তথাকথিত নির্দিষ্ট কোয়ান্টিফায়ার ব্যবহার করে অস্তিত্বহীন বস্তুর (‘আইটেম’) পরিমাপ করে থাকি। এটা আমরা করি পরিচিত-অস্তিত্ববাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিভ্রান্তিকরভাবেÑ অস্তিত্বগত পরিমাপক দিয়ে। এই তত্ত¡ অনুযায়ী অসম্ভব বস্তুগুলি অসম্ভব বিশ্বে বিদ্যমান থাকতে পারে, আবার অস্তিত্বহীন বস্তুগুলি সম্ভব (কিন্তু বাস্তব নয় এমন) বিশ্বে/পৃথিবীতে থাকতে পারে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত রিচার্ড রুটলির এক্সপ্লোরিং মেইনং’স জাঙ্গাল অ্যান্ড বিয়ন্ড: অ্যান ইনভেস্টিগেশন অব ননইজম অ্যান্ড দ্য থিওরি অব আইটেম এবং ২০০৫ সালে প্রকাশিত CUNY রিসার্চ সেন্টারের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গ্রাহাম প্রিস্টের টুওয়ার্ডস নন-বিয়িং: দ্য লজিক অ্যান্ড মেটাফিজিক্স অব ইন্টেনশ্যালিটি বই দুটিকে অধুনা অনস্তিত্ববাদের আকর গ্রন্থ বলে বিবেচনা করা হয়। (পরের বইটির ২০১৬ সালের সংশোধিত সংস্করণ অ্যামাজনে কিনতে পাওয়া যায়)। ভারতীয় দর্শনে অনস্তিত্বের ধারণা প্রধান না হলেও অনেক পুরনো যাতে মনে করা হয়েছে জগৎ একটা মায়া মাত্র: আমরা যা দেখি তা কোথাও নেই; বরং আমাদের চৈতন্য একটা ভৌত জগৎ তৈরি করে। মায়া শব্দটিকে আমরা ইংরেজিতে ভালো বুঝি- ইলিউশন। মহাজগৎ হলো একটা ইলিউশন।
ভাষার দর্শন এবং দার্শনিক যুক্তিবিদ্যায়, উদ্দেশ্যমূলকতা সমস্যা সৃষ্টি করে। পরিচিত ধাঁধা, উদ্দেশ্যমূলক প্রসঙ্গ, সমস্যার অন্তর্নিহিত প্রসঙ্গগুলির শব্দার্থবিদ্যা এবং যুক্তি আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে। অস্তিত্বগত সাধারণীকরণ বা অভিন্নগুলিকে সহজবোধ্য শব্দ- প্রত্যয় দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে আমরা আরও বিভ্রান্ত হই। যেমন জীববিদ্যার ‘আমি’ আর দর্শনের ‘আমি’ এক নয়। পদার্থ বিজ্ঞানের ‘আমি’ আরও দূরবর্তী কিছু- একগুচ্ছ পারমাণবিক কণার সুশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া। অনস্তিত্বের ধারণা কি দর্শনের জগতে সমস্যা তৈরি করে? আসলে দর্শনশাস্ত্রে ইচ্ছাকৃত সমস্যা একটি সমস্যা নয় বরং সম্পর্কিত সমস্যার একটি পরিবার। গ্রাহাম প্রিস্ট তাঁর বইয়ে অধিবিদ্যা এবং এর সংশ্লিষ্ট শব্দার্থবিদ্যা এবং যুক্তিবিদ্যার সাহায্য নিয়ে বলতে চেয়েছেন যে অস্তিত্ব যদি সত্য হয় তাহলে অনস্তিত্বের দশাও সত্য হতে বাধা নেই। মূল কথা হয়তো এটাই। তাঁর এই ধারণার ভিত্তি মেইনংজিয়ানিজম। এই তত্তে¡র প্রবক্তা অ্যালেক্সিয়াস মেইনং। তাঁর নামেই তত্ত¡টির এ’রকম নাম। মেইনং ভিয়েনার আকাদেমিশেস জিমনেসিয়ামে অধ্যয়ন করেন। ১৮৮২ সালে, মেইনং গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন এবং পরবর্তীতে এর দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মেইনং ডেভিড হিউমের উপর দুটি প্রাথমিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, প্রথমটি তার বিমূর্ততার তত্ত¡ নিয়ে, দ্বিতীয়টি তার সম্পর্কের তত্ত¡ নিয়ে। তবে তিনি তার সম্পাদিত বই থিওরি অব অবজেক্ট (সম্পূর্ণ শিরোনাম: “ইনভেস্টিগেশনস ইন থিওরি অব অবজেক্টস অ্যান্ড সাইকোলজি”, ১৯০৪)- এর জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, মানসিক ক্রিয়াকলাপের লক্ষ্য যাই হোক না কেন, তা আদতে একটি ‘বস্তু’। তাঁর এই বস্তুর তত্ত¡ ‘মেইনংজিয়ান অবজেক্ট থিওরি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে যা অভিজ্ঞতামূলক পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এর মূল কথা হলো, কোনো কিছুর উপস্থিতির জন্য এর ভৌত অস্তিত্বের দরকার নেই। যেমন ধরা যাক, আমরা মাউন্ট এভারেস্ট দেখছি এবং এর পিঠে উঠে প্রমাণ পাচ্ছি বা বিশ্বাস করছি যে এটা আছে। আমরা যদি বিশ্বাস করি যে পৃথিবীতে একটা সোনার পাহাড় আছে তাহলে সেটারও অস্তিত্ব আছে। যেহেতু আমরা এই ধরণের জিনিসগুলি কল্পনা করতে পারি, তাদের অবশ্যই কিছু ধরণের সত্তা থাকতে হবে। মেইনং এইভাবে একটি জিনিসের ‘সত্তা’কে কে আলাদা করে দেখেছেন। লালন বলছেন- “শরাকে সরপোষ লেখা যায়, বস্তু মারফত ঢাকা আছে তায়, সরপোষ থুই তুলে কি দেই ফেলে লালন বস্তু- ভিখারী?”। তিনি মানবদেহকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র রূপ হিসেবে দেখেছেন- “যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহভাণ্ডে”। অদ্বৈতবাদী দর্শনের সাথে মেইনং-এর পরিচয় ছিলো কিনা সেটা জানা যায় না; অন্তত তাঁর রচনায় এই দর্শনের উল্লেখ নেই। বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা, নাথ-যোগীদের নানা সাধনচর্চা ও বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনায় বস্তুকে যেভাবে গৌণ মনে করা হয়েছে বা জিনিসের অস্তিত্বের চেয়ে এর মূল অন্টোলজিক্যাল স্ট্যাটাসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে, তা মেইনং-এর ধারণার খুব কাছাকাছি। যেমন, বস্তু জগতে ইউনিকর্ন নেই। কিন্তু কল্পনায় আমরা তাকে তৈরি করতে পারি। দৈত্য, দেবদূত, ঈশ্বর, দেবতাদের কথা ভাবতে পারি।
মেইনং এই মত পোষণ করেছিলেন যে বস্তুগুলি “সত্তার প্রতি উদাসীন” এবং তারা “সত্তা ও অ-সত্তার বাইরে”। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি স্পষ্টভাবে অস্বীকার করছেন যে অস্তিত্ব একটি বস্তুর সম্পত্তি। তাঁর মতে বস্তুর আসল সারমর্ম, বস্তুর বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। বস্তুর অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকৃতপক্ষে অধিষ্ঠিত এবং তাই অস্তিত্ব কোনো বস্তুর এমন বৈশিষ্ট্য নয় যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় না তা আছে। স্পিনোজা যেমন মনে করেছেন অস্তিত্বের মূলে রয়েছে সাবস্টেন্স (সারবত্তা)। এর সাথে মেইনং-এর ধারণার কিছু মিল আছে। মেইনং মনে করেন যে বস্তুগুলিকে তাদের জ্ঞানতত্ত¡ীয় অবস্থার ভিত্তিতে তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায়। বস্তুর সত্তা এবং অ-সত্তার তিনটি পদ্ধতির একটি থাকতে পারে: (১) অস্তিত্ব বা বস্তুগত এবং অস্থায়ী সত্তা (২) সচলতা, ক্রিয়া বা ভৌত লক্ষণ (৩) অ-ভৌত ও পরম অবস্থা।
মহাজগৎ সাবস্টেন্স বা সারবত্তা না হলে কিছু জিনিস নীতিগতভাবে কখনোই থাকতে পারে না; যেমন গণিতের বস্তু (সংখ্যা, উপপাদ্য, ইত্যাদি)। সেক্ষেত্রে আমাদের ধারণায় যে বস্তুগুলো থাকতে পারে (পাহাড়, পাখি, ইত্যাদি) সেগুলোকেও সত্তার স্বয়ম্ভূ ও স্বাধীন একক হতে হবে। বস্তুজগত এককভাবে সত্য হলে অসম্ভব বস্তু (যেমন বর্গাকার বৃত্ত, কাঠের লোহা ইত্যাদি) টিকে থাকতে পারে না। আমরা চারকোণা বৃত্ত তৈরি করতে পারি না অথবা কাঠ দিয়ে লোহার কড়াই বানাতে পারি না। তাই বলে তাদের অ-ভৌত অস্তিত্বকে বাতিলও করে দিতে পারি না। তাই অনুপস্থিতি, অস্তিত্ব এবং টিকে থাকা— সবকিছু মেইনং-এর মতে অনুপস্থিত। ফলাফল দাঁড়ায়, যা কিছু অনুপস্থিত থাকে তা একটি বস্তুর অ-সত্তা (non-entity) নিশ্চিত করার পাশাপাশি সত্তাকেও নিশ্চিত করে। সোনার পাহাড় থাকার জন্য তার বস্তুগত উপস্থিতি দরকার নেই। বস্তু এবং বিষয় অস্তিত্বগত, সুনির্দিষ্ট এবং অনুমানমূলক বিচারের সমান্তরাল। এদের উদ্দেশ্যগুলি (সামসময়িক দার্শনিকরা যাকে স্টেট অব অ্যাফেয়ার্স বলেন) তার কাছাকাছি, যেখানে এগুলি বাস্তব হতে পারে, বা নাও হতে পারে। আমরা একটা পাথরকে শুধু-ই বস্তু মনে করতে পারি; কিন্তু এটি একই সাথে উদ্দেশ্যও হতে পারে। আমরা রকি মাউন্টেইনের খাড়িতে পড়ে থাকা একটা পাথর খণ্ডের সাথে অনেক দূরবর্তী সম্পর্কে পারস্পরিক। মহাজগতের এমন কোনো বস্তু (যেমন, পাহাড়), অ-বস্তু (যেমন, স্পেস), প্রতি-বস্তু (যেমন, ডার্ক মেটার) নেই যা পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। মেইনং-এর মতে, এই সম্পর্ক থেকে উদ্দেশ্য আলাদা নয়।
পাথর, শূন্যস্থান, বায়ু, বর্গক্ষেত্র (ধারণা), সত্য (মানসিক বস্তু), ইউনিকর্ন (অসম্ভব বস্তু)- এ’সবের ভাষা বুঝতে পারি না বলে আমরা এদের উদ্দেশ্যহীন মনে করি। বানর, বৃক্ষ, পঙ্গপাল, দেহকোষ, অণুচক্রিকা- এদের উদ্দেশ্য আছে বলে অনুভব করি। কারণ, এরাও আমাদের মতো জৈব সংগঠন। মেইনং বিশ্বাস করতেন, বস্তু ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। এই ধারণা অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ধারণার মতো। এই দর্শন আত্মাকে স্ব-অস্তিত্বের সচেতনতা, সীমাহীন, অদ্বৈত ও ব্রহ্মের মতোই বিবেচনা করে। অদ্বৈত দর্শন দাবি করে যে প্রতিটি জীবন্ত সত্তার মধ্যে “আত্মা, স্বয়ং” আছে এবং কোনো পৃথক ভক্ত আত্মা (আত্মান) বা কোনো পৃথক ঈশ্বর আত্মা (ব্রহ্ম) নেই। গৌতম বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন বস্তুতে-ই সত্তার বাস। তিনি ‘সৎকায়-দৃষ্টি’ নামে একটি নতুন শব্দ ব্যবহার করেছেন। বুদ্ধ নিজের বোধিবিদ্যা ব্যক্ত করার জন্য সে যুগের প্রচলিত ভাষায় উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাননি বলে ধারণা করা হয়। তাই তিনি ধর্ম, বস্তু, বিজ্ঞান সহ কিছু প্রাচীন শব্দকে কিছু নতুন অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। আবার প্রতীত্যসমুৎপাদ, সৎকায় প্রভৃতির ন্যায় কিছু নতুন শব্দও সৃষ্টি করেছিলেন। প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দটির বিশ্লেষণ এ’রকম: প্রতীত্য+সম+উপ্পাদ = প্রতীত্যসমুৎপাদ, এক্ষেত্রে ‘প্রতীত্য’ শব্দের অর্থ কারণ যেটি ‘সম’ (যার অর্থ যথার্থ বা উপযুক্ত) এর উপর নির্ভর করে। আর ‘উপ্পাদ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে উৎপাদিত বা সংগঠিত। সৎকায় অর্থ কায়ায় (অন্য কথায় বস্তুতে) বিদ্যমান, অর্থাৎ কায়া হতে-ই অজর অমর সত্তা।
উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে বস্তু ও ধারণার উৎস অভিন্ন। এর যে কোনো একটির অনুপস্থিতির দশা-ই অনস্তিত্বের দশা তৈরি করবে। কিন্তু পরম অনস্তিত্ব কি সম্ভব? বিজ্ঞানীদের মতে সিঙ্গুলারিটির দশায় সময় ও স্থান বলে কিছু ছিলো না। কিন্তু তাকেও অনস্তিত্বের দশা বলা যাবে না। কারণ, সেখানেও কিছু একটা ছিলো- অকল্পনীয় (প্রায় অসীম) ঘনত্ব, তাপমাত্রা ও চাপে বিপুল মাত্রার শক্তি একটি বিন্দুতে পুঞ্জীভ‚ত ছিলো। সিঙ্গুলারিটি কতো সময় বিরাজ করেছিল, এটি একটি অনন্য দশা কিনা অথবা একটা বৃহৎ সংকোচন থেকে এর উৎপত্তি ঘটেছিল কিনা এসব বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কিছু জানেন না। যা-ই ঘটে থাকুক তাকে অনস্তিত্বের দশা বলা যাবে না। মহাজগতে যদি স্পেস, টাইম, মেটার, এন্টি মেটার- কিছু-ই না থাকতো তাহলে তা হতো পরম অনস্তিত্বের অবস্থা। স্থান ও সময়ের মধ্যে বসে ঐ অবস্থার কথা কল্পনা করা কঠিন। আমরা শুধু এটুকু ভাবতে পারি তা হতো বর্তমান অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত দশা। আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসবে, তখন কি শূন্যতাও থাকতো না? না। শূন্যতা থাকবে কী করে! শূন্যতা তো স্পেস, যার উৎপত্তি বিগ ব্যাং থেকে। বিগ ব্যাং এর আগে কি আলো বা অন্ধকার ছিলো? না। স্পেস না থাকলে এরা কোথায় থাকবে? তাহলে সিঙ্গুলারিটি দশায় থাকা বিন্দুটি কোথায় ছিলো? এই প্রশ্নের মধ্যে-ই উত্তর আছে। বিন্দুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ থাকে না; শুধু অবস্থিতি থাকে। ফলে ঐ বিন্দুটি কোথায় ছিলো সে প্রশ্ন অর্থহীন। সে তার নিজের মধ্যে-ই ছিলো। পরম অনস্তিত্ব অসম্ভব দশা নয়। তবে তাকে সম্ভব হতে হলে শুধু তাকেই অনন্ত সময়ের জন্য সত্য হতে হতো। মহাবিশ্বের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে তা প্রায় অসম্ভব ছিলো। যা সম্ভব বা অবশ্যম্ভাবী ছিলো সেটা ঘটেছে। মহাজগৎ অস্তিত্বে এসে প্রমাণ করেছে যে অনস্তিত্বের অবস্থা সত্য হবার সুযোগ ছিলো না। অনস্তিত্ব সত্য হতে পারতো যদি মহাজগৎ উদ্ভূত হবার সবগুলো শর্ত একযোগে অনুপস্থিত থাকতো।
জন্মের আগে আমরা কি অনস্তিত্বে ছিলাম? না। আমরা এসেছি স্টার ডাস্ট থেকে। নক্ষত্র এসেছে বিগ ব্যাং থেকে। বিগ ব্যাং এসেছে সিঙ্গুলারিটি থেকে। সিঙ্গুলারিটি এসেছে বিগ ক্রাঞ্চ থেকে। বিগ ক্রাঞ্চ এসেছে আগের মহাজগৎ থেকে। এভাবে অনন্ত অতীত পর্যন্ত গেলেও আমরা ছিলাম- কণা, তরঙ্গ বা শক্তির আকারে। আগামী অনন্ত পর্যন্ত এই আকারগুলোর মধ্যে টিকে থাকবো। আমার শরীরের অণু–পরমাণু বয়ে বেড়াবে প্রাণি, উদ্ভিদ, বায়ু, জল, মৃত্তিকা। উপরের অনুচ্ছেদে আমরা বলেছি, উদ্ভূত হবার শর্ত পূরণ হবার কারণে মহাজগতের অস্তিত্বে আসা অবশ্যম্ভাবী ছিলো। যে আকারে তা উদ্ভূত হয়েছে সেটাও কি অবশ্যম্ভাবী ছিলো? হ্যাঁ। মূল বিধিগুলো অভিন্ন থাকার বিকল্প ছিলো না। বিগ ব্যাং থেকে যে শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল তা চারটি ফোর্স ফিল্ড তৈরি করেছিল-
এক। গ্রাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ: এই শক্তির উপস্থিতির কারণে গ্রহগুলো তার নিজের শরীরে বা সন্নিহিত স্থানে থাকা বস্তুকে নিজের কেন্দ্রের দিকে টানে। ফলে আমরা স্বচ্ছন্দে পৃথিবীর মাটিতে চলেফিরে বেড়াতে পারি। দুই। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড: তড়িৎ প্রবাহের কারণে যে ফিল্ড তৈরি হয় তা হলো ইলেকট্রিক ফিল্ড এবং চুম্বক তার চারপাশে যে আকর্ষণ ক্ষেত্র তৈরি করে তা হলো ম্যাগনেটিক ফিল্ড। এই দুই প্রকার ফিল্ডের মধ্যে কোনো আধান যে চাপ অনুভব করে সেটাই হলো তড়িৎ বল বা চৌম্বক বল। তিন। স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স: পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে দু’ধরণের কণিকা, প্রোটন ও নিউট্রিন। আর পরিধি বরাবর ঘুরপাক খায় ইলেকট্রন কণিকা। প্রোটন ও নিউট্রন একটা নিউক্লিয়াসের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স-এর উপস্থিতির কারণে। প্রোটন সংখ্যার পার্থক্য-ই পদার্থের ভিন্নতা তৈরি করে। চার। উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স: তেজস্ক্রিয়তা ঘটে এই ফোর্সের কারণে। কোনও মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা নিউট্রন ও প্রোটনের অনুপাত যদি ১.৬ এর থেকে বেশি হয়ে যায়, তাহলে নিউট্রন ও প্রোটন নিজে থেকে ভেঙে যেতে শুরু করে। এই ভাঙনের ফলে যে তরঙ্গ উৎপন্ন হয় তা আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির আকারে নির্গত হয়।
আমরা জানি, এই চারটি শক্তি-ই মহাজগতের যাবতীয় বিধি তৈরি করেছে। ফলে আমাদের জানা মহাবিশ্বের সবখানে পদার্থ বিদ্যার নীতি অভিন্ন। এখন যদি একটা বিগ ক্রাঞ্চ ঘটে তাহলে মহাবিশ্ব সিঙ্গুলারিটির দশায় ফিরে যাবে। এবং তাকে অনুসরণ করে আবার একটা বিগ ব্যাং ঘটবে। তখন যে মহাবিশ্ব তৈরি হবে, বর্তমান মহাবিশ্বের সাথে তার তেমন পার্থক্য থাকার কথা নয়। কারণ, পদার্থের নীতি বদলাবে না বরং তা পুনারাবৃত্ত হবে। নক্ষত্র, নীহারিকা, গ্রহ- উপগ্রহ তৈরি হবে। অন্তহীন মহাশূন্যে ছুটতে থাকা গ্রহগুলোতে উদ্ভিদ ও প্রাণির আবির্ভাব ঘটবে। হয়তো হাজার কোটি বছরের বিবর্তনে মানুষের মতো বা তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বুদ্ধিমান প্রাণির উদ্ভব ঘটবে সে’সবে। তবে বর্তমান আকৃতি নিয়ে কোনো প্রাণির আবির্ভাবের সম্ভাবনা লক্ষ কোটি ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগও নয়। কারণ, যে পারমুটেশন- কম্বিনেশনে বিলিয়ন বছর ধরে প্রাণির কয়েক লক্ষ ধরণের বিবর্তন ঘটেছে তার যে কোনো একটি ভিন্ন হলে তার আকার, অভ্যাস, বুদ্ধিও ভিন্ন হতো। হোমো হ্যাবিলিস থেকে ছোট্ট একটা জেনেটিক পরিবর্তন আমাদের হোমো ইরেক্টাস-এ রূপান্তরিত না করলে আমরা এখনও স্যুট-প্যান্ট পরে বানরদের কায়দায় হামাগুড়ি দিয়ে অফিসে যেতাম।
পুনশ্চ: অনস্তিত্ব কি সত্যি হতে পারে? আপনি আমার এই আর্টিকেলটা পড়ে ফেলেছেন। এটা কি আর অপঠিত থাকার অভিধা পেতে পারে? আপনি যদি না পড়তেন তাহলে সেটা হতে পারতো। মহাবিশ্ব নামের এই মহাগ্রন্থ যদি সৃষ্টি না হতো তাহলে অনুচ্চারিত পংক্তিমালার মতো তা অনস্তিত্বে-ই থেকে যেতো।অবিদ্যমানতা সত্য হতো।
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা