হাসান গোর্কি : সাতাশ জুন, ১৯৭৬। এয়ার ফ্রান্সের একটি ফ্লাইট ২৪৬ জন যাত্রী ও ১২ জন ক্রু নিয়ে প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথে এথেন্স থেকে ৫৮ জন যাত্রী উঠিয়ে নেয়। উড্ডয়নের পরপরই পিএলও-র (পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন) দুই গেরিলা এবং জার্মান রেভুলেশনারি সেলের দুই সদস্য বিমানটি ছিনতাই করার পর লিবিয়ার বেনগাজিতে রিফুয়েলিং করে উগান্ডার এন্টেবি বিমানবন্দরে নিয়ে যান। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন ব্যক্তিগতভাবে তাদের স্বাগত জানান এবং উগান্ডা সেনাবাহিনীর প্রহরায় বিমান থেকে সমস্ত জিম্মিকে বিমানবন্দরের একটি অব্যবহৃত টার্মিনালে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে থেকে এন্টেবিতে থাকা ৪ ছিনতাইকারী তাদের সাথে যোগ দেন। ছিনতাইকারীরা ৯৪ জন ইসরায়েলি ও ১২ জন ক্রুকে টার্মিনাল ভবনে আটকে রেখে অ-ইসরায়েলিদের ছেড়ে দেন। তারা ইসরায়েল ও বিভিন্ন দেশে আটক থাকা ৫৩ জন প্যালেস্টাইনির মুক্তি ও ৫ মিলিয়ন ডলার দাবি করেন। ১ জুলাইয়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে তারা বন্দীদের হত্যার হুমকি দেন। পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী হানি আল-হাসানকে জিম্মিদের সাথে আলোচনার জন্য উগান্ডায় পাঠান। ইসরায়েল সরকার উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড সহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাহায্য চায়।

সব উদ্যোগ ব্যর্থ হবার পর ইসরায়েল মন্ত্রীসভা ৪ জুলাইয়ের মধ্যে ছিনতাইকারীদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ইদি আমিনের অনুরোধে ছিনতাইকারীরা সেটা মেনে নেন। ছিনতাইকারীদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি গোপনে একটি উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা করতে থাকে ইসরায়েল। আসলে বিমান ছিনতাই হবার দিন (২৭ জুন) থেকে-ই তারা কয়েকটি ভিন্ন পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল এবং আলোচনার নামে কাল ক্ষেপণ করছিল। তাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিলো — ভিক্টোরিয়া হ্রদের এন্টেবি উপক‚লে একদল নৌ-কমান্ডোকে নামানো হবে, তারা রাবারের বোটে করে তীরে পৌঁছাবে, ঝটিকা আক্রমণ করে ছিনতাইকারীদের হত্যা করে উগান্ডার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং বিশ্ব জনমতের চাপে ইদি আমিন তাদের ইসরায়েলে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু আত্মসমর্পণের পর উগান্ডার সেনাবাহিনী ও ইদি আমিনের ভ‚মিকা কী হবে সে বিষয়ে সংশয় ছিলো। এছাড়া ভিক্টোরিয়া হ্রদের নীল নদ অববাহিকার যে অংশে কমান্ডোদের নামাতে হতো সেখানে অসংখ্য মানুষখেকো কুমির বাস করে। তাই এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেওয়া হয়।

পরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল ইয়েকুটিয়েল অ্যাডাম এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড্যান শোমরন কর্তৃক প্রস্তাবিত আকাশ পথে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার একটা পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদন পায় যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন থান্ডারবোল্ট। কোড নাম দেওয়া হয় অপারেশন জোনাথন। প্যারিসে মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জিম্মিদের অবস্থান, ছিনতাইকারীদের সংখ্যা এবং উগান্ডার সেনাদের সম্পৃক্ততার একটি চিত্র তৈরি করে। যে টার্মিনালে জিম্মিদের রাখা হয়েছিল সেটি ১৯৬০-এর দশকে নির্মাণ করেছিল একটি ইসরায়েলি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। মোসাদ তাদের কাছে টার্মিনালের নকশা পায়। তেল আবিব থেকে এন্টেবির দূরত্ব ২৫০০ মাইল। ৩ জুলাই সকালে চারটি সি-১৩০ কার্গো বিমান এবং দুটি বোয়িং-৭০৭ বিমানে করে ১০০ জন কমান্ডো তেল আবিব থেকে যাত্রা করে মিশরের শারম এল-শেখ বিমানবন্দরে তেল নেওয়ার জন্য যাত্রা বিরতি করে। এরপর লোহিত সাগরের উপর দিয়ে জিবুতির পশ্চিমে গিয়ে কেনিয়ায় অবতরণ করে এবং আবার বিমানে তেল নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী এন্টেবিতে পৌঁছে মধ্যরাতে। রাডার সনাক্তকরণ এড়াতে পুরো সময় তারা ভ‚মি থেকে মাত্র ১০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়েছে, যা ছিলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

কমান্ডোরা এই মার্সিডিজ গাড়িটি বিমানে করে নিয়ে গিয়েছিলেন ইদি আমিনের গাড়ি হিসেবে ধোঁকা দিতে।
ছবির সূত্র: Ynetnews.com

এন্টেবি বিমানবন্দরে সে’সময় কোনো ফ্লাইট উড্ডয়ন বা অবতরণের সিডিউল ছিলো না। উগান্ডায় প্রবেশের সময় ইসরায়েলি বিমান থেকে উচ্চ শক্তির জ্যামার ব্যবহার করে এন্টেবি সহ আশপাশের সব বিমান বন্দরের রাডার ব্যবস্থা অকেজো করে দেওয়া হয়। ফলে কমান্ডোবাহী ৪ টি সি-১৩০ পরিবহণ বিমান যখন পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করে তখন বিমানবন্দরের কর্মীরা সেটাকে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ফ্লাইট মনে করেছে। প্রথম বোয়িংটিতে চিকিৎসা সুবিধা ছিল এবং এটি কেনিয়ার নাইরোবির জোমো কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মোতায়েন ছিলো। দ্বিতীয় বোয়িং-এ ছিলেন অভিযানের কমান্ডার জেনারেল ইয়েকুটিয়েল অ্যাডাম। এই বিমানটি অভিযানের সময় এন্টেবি বিমানবন্দরের উপর দিয়ে উড়ছিল। কার্গো বিমানগুলো অবতরণ করার পর সেগুলোর একটি থেকে একটি কালো রঙের মার্সিডিজ গাড়ি নামানো হয়। ঠিক এ’রকম একটি গাড়ি ইদি আমিন ব্যবহার করেন। নম্বর প্লেটও হুবহু নকল করা হয়েছিল। অন্য কার্গো প্লেন থেকে ৪ টি ল্যান্ড রোভার গাড়ি নামানো হয়। ইদি আমিনকে পাহারা দেওয়ার জন্য সৈন্যরা ঠিক এই রং ও নম্বরের গাড়ি ব্যবহার করেন। ২৯ জন কমান্ডো গাড়িগুলোতে উঠে ২ কিলোমিটার দূরের নতুন টার্মিনালের দিকে রওনা করেন। মোদাস জানতো না যে ইদি আমিন স¤প্রতি একটা সাদা রঙের মার্সিডিজ কিনেছেন। পথিমধ্যে একটা চেকপোস্টে একজন সৈনিকের সন্দেহ হলে তিনি গাড়ি বহরকে থামতে ইশারা করেন। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে গুলি করে দুইজন সেন্ট্রিকে হত্যা করেন কমান্ডোরা।

এই ইউনিটের নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বড় ভাই ইয়োনাথান নেতানিয়াহু। টার্মিনালে প্রবেশ করে কমান্ডোরা একটি মেগাফোনের মাধ্যমে চিৎকার করে হিব্রু এবং ইংরেজি ভাষায় বলছিল, “সবাই শুয়ে পড়ুন। আমরা ইসরায়েলি সৈন্য।” ছিনতাইকারীদের সাথে গুলি বিনিময়ের সময় কমান্ডো ইউনিটের প্রধান ইয়োনাথান নেতানিয়াহু নিহত হন; তাঁর মৃতদেহ বিমানে তোলা হয়; নতুন ইউনিট প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন কর্নেল হারতুভ। কমান্ডোদের গুলিতে সকল ছিনতাইকারী নিহত হন। এরপর যাত্রীদের দ্রুত সি-১৩০ পরিবহণ বিমানে তোলা হয়। কমান্ডোরা যখন টার্মিনালে হামলা চালাচ্ছিলেন তখন উগান্ডান সেনাবাহিনীর সদস্যরা টার্মিনালের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করেন। কর্ণেল মাতানের নেতৃত্বে অন্য ১ টি ইউনিট বাধা দেয় এবং যুদ্ধে উগান্ডান সেনা সদস্যদের ৪০ জন নিহত হন। একই সময় মেজর শলের নেতৃত্বে ডিপো থেকে বিমানগুলোতে তেল ভরা হয়। সেসময় কর্ণেল উরি তার বাহিনী নিয়ে উগান্ডান বিমান বাহিনীর ৪০ টি যুদ্ধ বিমান বোমা মেরে ধ্বংস করে দেন যাতে মিশন শেষে চলে আসার সময় কেউ তাদের পিছু নিতে না পারে।

এ’সময় এন্টেবির আকাশে উড়তে থাকা একটি বোয়িং-এ বসে পুরো অভিযানের সমন্বয় করছিলেন জেনারেল অ্যাডাম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড্যান শোমরন। সকল যাত্রীকে নিয়ে কমান্ডোরা তেল আবিবে ফিরে আসার পর সায়েন্স ফিকশন একশন মুভির চেয়েও ভয়ঙ্কর এই অভিযানের খবর যখন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় তখন সারা বিশ্বের সমর বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। মাত্র ৪টি ধীর গতির পরিবহণ বিমান ও ২ টি যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে আড়াই হাজার মাইল দূরের একটা দেশে হামলা করে প্রায় শতভাগ সাফল্য নিয়ে ফিরে আসার এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ইসরায়েলি নেতৃত্ব কীভাবে অনুমোদন করেছিলেন তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। এই ডকুমেন্টারিতে এই অভিযানের মোটামুটি একটা চিত্র পাবেন: https://www.youtube.com/watch?v=9lHAvWBxixw। ইরানের রেজা শাহ পাহলভির পতনের এক মাসের মাথায় কিছু উগ্রপন্থী ছাত্র/ এক্টিভিস্ট তেহরানের আমেরিকান দূতাবাস দখল করে নেন এবং ৪৪৪ দিন ধরে ৬৬ জন ক‚টনীতিককে আটকে রাখেন। অপারেশন থান্ডারবোল্ট-এর অনুকরণে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনীর উচ্চ প্রশিক্ষিত কমান্ডোরা জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য ১৯৮০ সালের ২৪ এপ্রিল একটি অভিযান চালান। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং দুর্ঘটনায় ৮ জন কমান্ডো নিহত হন। তখন মার্কিন প্রশাসনের অনেকেই বলেন যে দায়িত্বটি ইসরায়েলিদের দিলে তারা সফল হতো।

১৯৭৯ সালে ইরাক একটি পরমাণু চুল্লী স্থাপনের জন্য ফ্রান্সের সাথে চুক্তি করে করে যার আসল লক্ষ্য ছিলো ইসরায়েলের মোকাবিলায় পরমাণু বোমা তৈরি করা। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ফ্রান্সের লা সিয়েন-সুর-মের বন্দর থেকে চুল্লীর যন্ত্রাংশ ইরাকের উদ্দেশ্যে জাহাজে তোলার সময় সূত্রহীন কয়েকটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে ইসরায়েলি এজেন্টরা যন্ত্রাংশগুলোর বেশিরভাগ ধ্বংস করে দেন। ফরাসি পুলিশ কোনো সূত্র খুঁজে না পেয়ে এই বিস্ফোরণকে ‘রহস্যময়’ ও ‘অত্যাধুনিক’ বলে বর্ণনা করে। পরে অন্য জাহাজে করে কঠোর নিরাপত্তায় নতুন যন্ত্রাংশ ইরাকে পৌঁছানো হয়। চুল্লীর কাজ দ্রুত এগোতে থাকে। এই প্রকল্পের প্রধান ছিলেন মিশরীয় পরমাণু বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া-আল-মাশাদ। মোসাদ এজেন্টরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অনুসরণ করতে থাকেন। প্যারিসে এক সরকারি সফরে থাকাকালে ১৩ জুন, ১৯৮০ আল-মাশাদকে তাঁর হোটেল কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মাথার খুলিতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে কেউ তাকে হত্যা করেছিল। মৃত্যুর আগে হোটেলের যে নারী এটেনডেন্ট তাকে সর্বশেষ দেখেছিলেন ১০ দিনের মাথায় তিনি এক দ্রুতগামী গাড়ির চাপায় রহস্যজনকভাবে নিহত হন। ফলে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কোনো সূত্র অবশিষ্ট ছিলো না। পরমাণু কেন্দ্রের স্থাপনাগুলো নির্মাণের দায?িত্বে থাকা ইরাকি কুর্দি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আবদ আল-রহমান রসুলকে ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৮০ প্যারিসে তাঁর হোটেল কক্ষে মোসাদ এজেন্টরা গুলি করে হত্যা করেন। ঐ প্রকল্পে নিয়োজিত ইরাকি পরমাণু বিজ্ঞানী সালমান রশিদ আল-লামিকে জেনেভায় তাঁর হোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর শরীর অস্বাভাবিকরকম ফুলে গিয়েছিল। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে দেখা যায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে একটি অজানা ভাইরাসের সংক্রমণে। এরপর মোসাদের হাত থেকে বিজ্ঞানীদের রক্ষার জন্য সাদ্দাম হোসেন বিজ্ঞানীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করে দেন।

১৯৮০-র সেপ্টেম্বরে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েল ইরানকে দিয়ে ইরাকের পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করিয়ে নেওয়ার চিন্তা করে। মোসাদ এজেন্টরা ইরানের কাছে ইরাকের ওসিরাক পরমাণু কেন্দ্রের নিখুঁত নকশা হস্তান্তর করেন।

হামলার শিকার ফাখরিজাদেহ-র গাড়ি। ছবি: এএফপি

ইরান দুই দফা বিমান হামলা করে স্থাপনাটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। ইরাক যদি পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলে তাহলে তা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, এই চিন্তা থেকে ইসরায়েল স্থাপনাটি ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করে। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন অপেরা’(অন্য নাম ‘অপারেশন ব্যাবিলন’)। ১৯৮১ সালের ৭ জুন ৮টি এফ-১৬ এবং ১৬ টি এফ-১৫ (ঈগল) ওসিরাক পরমাণু কেন্দ্রে হামলার উদ্দেশ্যে রওনা করে। এ’সময় ইসরায়েলি বিমানগুলোকে শত্রিদেশ জর্ডান ও সৌদি আরবের আকাশসীমা অতিক্রম করতে হয়েছে। কাজটি খুব-ই দুরূহ ছিলো। বরাবরের মতো-ই বিস্ময়কর চাতুর্যের আশ্রয় নেয় ইসরায়েল। প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী জর্ডান ও সৌদি আরবের সামরিক বিমান পরস্পরের ভ‚খণ্ডে টহল দিতে পারে; যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান কানাডার আকাশসীমার একটা বড় অংশ পাহারা দেয়। জর্ডানের আকাশসীমায় প্রবেশের সময় ইসরায়েলি পাইলটরা বিশুদ্ধ সৌদি উচ্চারণে আরবীতে জর্ডানের কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সৌদি যুদ্ধ বিমান পরিচয় দিয়ে জর্ডান অতিক্রম করেন। আবার জর্ডান এয়ার ফোর্সের বিমান পরিচয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করে সে’দেশের আকাশসীমা অতিক্রম করেন।

ইরাকের আকাশ সীমায় পৌঁছে ৮ টি এফ-১৬ বিমানের পাইলটরা তাদের বিমানগুলো নামিয়ে আনেন ভু পৃষ্ঠের ১০০ ফুটের মধ্যে এবং পরমাণু কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হন। তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য সাথে ছিলো ২ টি এফ-১৫। বাকি ১৪ টি এফ-১৫ ইরাকের বিমান বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য আক্রমনের ভঙ্গিতে স্বাভাবিক উচ্চতায় আকাশে এলোমেলো উড়তে শুরু করে। ইরাকের বিমানগুলো তাদের তাড়া করে। ইসরায়েলের এফ-১৫ গুলো যুদ্ধে লিপ্ত হবার পরিবর্তে বার বার উচ্চতা ও দিক পরিবর্তন করে পালাতে থাকে। ইরাকের যুদ্ধ বিমানগুলো যখন চোর পুলিশ খেলায় ব্যস্ত তখন ৮ টি এফ-১৬ প্রতিটি দু’টি করে মার্ক-৮৪ নামের ২০০০ পাউন্ডের শক্তিশালী বোমা নিয়ে ওসিরাক পরমাণু কেন্দ্রে পৌঁছে যায়। এক বছর আগে ইরানের হামলার পর উচ্চ ক্ষমতার মিসাইল দিয়ে পরমাণু কেন্দ্রটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়েছিল। ইসরায়েলি বিমানগুলো বোমা ফেলার জন্য স্বাভাবিক উচ্চতায় উঠলে স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে ভুপাতিত হতো।

কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সক্রিয় হতে ২ মিনিট সময় লাগে। এটা যথেষ্ট সময়। কারণ দূর থেকে কোনো বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র আসতে থাকলে এর চেয়ে ২০/৩০ গুণ বেশি সময় পাওয়া যায়। ইসরায়েলি বিমানগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাবার কারণে ক্ষেপনাস্ত্রের রাডারে তা ধরা পড়েনি। চুল্লীর কাছাকাছি পৌঁছে বিমানগুলো অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে এক হাজার মিটার উঁচুতে উঠে যায় এবং পাইলটরা মাত্র ১ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের মধ্যে ১৬ টি ‘মার্ক-৮৪’ বোমা ছুঁড়ে মূল চুল্লী সহ পুরো স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেন। ইরাকী ক্ষেপণাস্ত্র সক্রিয় হতে তখনও ২৪ সেকেন্ড বাকি। এ’সময়ের মধ্যে উচ্চ গতিতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় ইসরায়েলের সবগুলো বিমান এবং সফল অভিযান শেষে নিরাপদে ইসরায়েলে প্রত্যাবর্তন করে। এই অভিযানের সবচেয়ে কম বয়সী (২৪ বছর) পাইলট ছিলেন ইলান রামন। উঁচু মানের দক্ষতার কারণে তিনি প্রথম ইসরায়েলি নভোচারী হিসেবে ২০০৩ সালে কলম্বিয়া মহাকাশযানের যাত্রী হয়েছিলেন এবং প্রথম যাত্রাতে-ই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। পরমাণু বোমা তৈরির লক্ষ্যে সিরিয়া রাজধানী দামেস্ক থেকে ৪৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে দেইর আল-জোর প্রদেশের আল-কিবায় একটা গোপন পরমাণু কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। ২০০৭ সালে একই রকম এক আকস্মিক হামলায় সেটিও ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। লিবিয়াও পরমাণু শক্তি অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছিল; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এক সমঝোতার মাধ্যমে গাদ্দাফি সেই কর্মসূচি পরিত্যাগ করেন। এরপর ইসরায়েলের সামনে পরমাণু হুমকি হিসেবে টিকে থাকে শুধু ইরান।

ইরান বরাবর বলে এসেছে তার পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত। ইসরায়েল এই দাবি বিশ্বাস করেনি। ফলে গত বিশ বছরে ৭ জন ইরানী পরমাণু বিজ্ঞানী ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০০৭ সালে শিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইস্পাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী হোসেনপুরকে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করে মোসাদ। অন্য ৪ বিজ্ঞানীকে হত্যায় তারা ব্যবহার করেছে গাড়ি বোমা এবং ম্যাগনেটাইজ বোমা। মোহসিন ফাখরিজাদেহ ছিলেন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রধান বিজ্ঞানী। ২০১৮ সালে মোসাদ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির কিছু গোপন নথি চুরি করে। এই নথিগুলোর বেশিরভাগ-ই ফাখরিজাদেহ নিজ হাতে লিখেছিলেন যা থেকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত হয় যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির আসল লক্ষ্য পরমাণু বোমা তৈরি করা। এরপর-ই মহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল।

তিনি যে মোসাদের হত্যা তালিকায় থাকতে পারেন সেটা ধরে নিয়েই তার জন্য কয়েক স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি রেখেছিলেন ইরানি কর্তৃপক্ষ। তিনি কখন অফিসে যাবেন, কখন অফিস থেকে বের হবেন, কোন গাড়িতে উঠবেন, কোন পথে বাড়ি ফিরবেন — এ’সবের কোনো তথ্য আগে থেকে জানানো হতো না। নরওয়ে, অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডস এর ৬ নাগরিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার হয়ে কাজ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময় ইরানে প্রবেশ করেন যারা আসলে ছিলেন মোসাদের সদস্য। তারা ৮ মাস ফাখরিজাদেহ-র গতিবিধির ওপর নজর রাখেন এবং তাঁর ব্যবহৃত সবগুলো গাড়ির রেডিয়ো সিগন্যাল ফ্রিকোয়েন্সি বের করে ফেলেন। জুইশ ক্রনিকলস নামে এক ব্রিটিশ পত্রিকা লিখেছে, ফাখরিজাদেহকে হত্যার আগে এমন নজরদারি চালানো হয়েছিল, যাতে তার নিঃশ্বাসের শব্দও টের পেতো মোসাদের গোয়েন্দারা। তারা জানতেন, ফাখরিজাদেহ কোন পথে যাতায়াত করেন, কতো গতিতে তাঁর গাড়ি চলে এবং গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য ফাখরিজাদেহ কোন দরজাটি ব্যবহার করেন।

এই পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, মহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার মিশনে অংশ নেন মোসাদের ২০ গোয়েন্দা। প্রায় এক টন ওজনের একটি দূর নিয়ন্ত্রিত বন্দুকের সাহায্যে তাকে হত্যা করা হয়। এর যন্ত্রাংশগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে আলাদা করে ৮ মাস ধরে ইরানে আনা হয়। এরপর সবগুলো জোড়া দিয়ে এই স্বয়ংক্রিয় বন্দুকটি তৈরি করা হয়। এতে জুড়ে দেওয়া হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা ফাখরিজাদেহকে চিনতে পারে। বন্দুকটিকে একটা চালকবিহীন নিশান গাড়িতে স্থাপন করা হয়। এরপর মোসাদের এজেন্টরা ইরান ত্যাগ করে অন্য দেশ ঘুরে ইসরায়েলে চলে যান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে চালিত, কালো গ্লাস লাগানো চালকবিহীন গাড়িটি দুই দিন তেহরানের রাস্তায় চক্কর দিয়ে একাই আস্তানায় ফিরে যায়। ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ফাখরিজাদেহ যখন বাসা থেকে ১২ দেহরক্ষীর একটি গাড়িবহর সহ সস্ত্রীক তেহরানের উপকণ্ঠে তাঁর অবসর যাপন কেন্দ্রের দিকে রওনা হন তখন মোসাদের বুদ্ধিমান ঘাতক গাড়িটি রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতে থাকে। তেল আবিবে বসে বড় পর্দায় গোয়েন্দারা সেটা দেখতে থাকেন। ফাখরিজাদেহকে বহন করা গাড়িটি ৬০০ মিটার দূরত্বে পৌঁছালে এই ঘাতক গাড়ি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাস্তায় বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। প্রায় ৫০০ মিটার (আধা কিলোমিটার) দূরে ফাখরিজাদেহ-র গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি বোঝার জন্য ফাখরিজাদে, তাঁর স্ত্রী ও দেহরক্ষীরা গাড়ি থেকে নামেন। এ’সময় ঐ নিশান গাড়ির ছাদ খুলে স্বয়ংক্রিয় বন্দুকটি বের হয়ে গুলি করে। ফাখরিজাদে মাথায় ১৩ টি গুলি লাগে। তাঁর শরীরের অন্য কোথাও অথবা তাকে ঘিরে ধরা রক্ষীদের কারো গায়ে গুলি লাগেনি। ১০ ইঞ্চি দূরে দাঁড়ানো তাঁর স্ত্রীও অক্ষত থাকেন। তেল আবিবে বসে মোসাদের সদস্যরা যখন দেখতে পান ফাখরিজাদেহ নিশ্চিত নিহত হয়েছেন তখন গাড়িতে থাকা অত্যন্ত শক্তিশালী এক বোমার দূর নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে গাড়িটি উড়িয়ে দেন। গাড়িটি এমনভাবে ধ্বংস হয়েছিল যে ধ্বংসাবশেষ থেকে কোনো তথ্য-ই বের করা যায়নি।

hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা