হাসান গোর্কি : জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩। পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদায় থাকা দুই সদস্য ভ্যাটিকান সিটি এবং প্যালেস্টাইনকে গণনায় নিলে মোট সদস্য সংখ্যা ১৯৫। যদি জিজ্ঞেস করা হয় এর মধ্যে সবচেয়ে চৌকশ রাষ্ট্র কোনটি, তাহলে কোনো দ্বিমত ছাড়াই ইসরায়েলের নাম আসার কথা। মেধা, কৌশল ও সাহসের সমন্বয়ে তারা যে বিস্ময়কর সাফল্যের উদাহরণ তৈরি করেছে সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র পার্ল হারবারে জাপানী আক্রমণে (৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১) পর্যুদস্ত হয়েছে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলায় বড় ক্ষতি স্বীকার করেছে; এমনকি তাদের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরও এই হামলার শিকার হয়েছে। দ্বিতীয় পরাশক্তি রাশিয়া ১৯০৫ সালে জাপানের সাথে যুদ্ধে হেরে কোরিয়ায় জাপানি আধিপত্য স্বীকার করে নেয়, পোর্ট আর্থারের ইজারা জাপানের কাছে হস্তান্তর করে, মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং শাখালিন দ্বীপের দক্ষিণাংশ জাপানের কাছে হস্তান্তর করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
চীন দুটি যুদ্ধে (১৮৯৪-‘৯৫ ও ১৯৩২-‘৩৯) জাপানের কাছে পরাজিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স দখল করে নেয় জার্মানি; আবার মিত্র বাহিনীর কাছে হারে জার্মানি-জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধে কার্যত ফ্রান্স ও স্পেনের কাছে পরাজিত হয় ব্রিটেন। বড় যুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের ১৬টি বৈরী মুসলিম রাষ্ট্র বেষ্টিত ইসরায়েলের ইহুদি জনসংখ্যা ৬৯ লাখ (মোট জনসংখ্যার ৭৩.৫%)- যা ঢাকার জনসংখ্যার মোটামুটি ৩ ভাগের ১ ভাগ। ইসরায়েলে মুসলিম জনসংখ্যা ১৯ লাখ (মোট জনসংখ্যার ২০%)। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২৯ কোটি। পৃথিবীর ৪৭ টি মুসলিম রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ১৮০ কোটি, যা ইসরায়েল সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদি জনসংখ্যার (দেড় কোটি) ১২০ গুণ। আরব রাষ্ট্রগুলোর সন্মিলিত আয়তন ৫.০৭ মিলিয়ন বর্গমাইল। এই হিসেবে ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর ০.১৬% । অন্য কথায় আরব রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে ইসরায়েলের চেয়ে ৬৩০ গুণ বড়। কিন্তু ৩ টি আরব ইসরায়েল যুদ্ধে-ই জয়লাভ করে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্র আয়তন ও জনসংখ্যার এই রাষ্ট্রটি। আরব-ইসরায়েল বিরোধের কারণ মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতা যা কয়েক শতাব্দী ধরে আবর্তিত হয়ে এসেছে পবিত্র নগরী জেরুজালেম এবং বিশেষ করে আল আকসা- ট্যাম্পল মাউন্ট বিতর্ককে ঘিরে।
ইহুদিরা এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে থেকে। হিব্রæ বাইবেল বা তানাখের বর্ণনা অনুযায়ী, তাদের জাতির পিতা অব্রাহামকে [ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী ইব্রাহিম (আঃ)] এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের পুরষ্কার স্বরূপ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ইস্হাক কনানের (বর্তমান ইসরায়েল) উত্তরাধিকারী হবেন। পরবর্তীতে ইস্হাকের পুত্র যাকোবের [(ইয়াকুব (আঃ)] বংশধরদের ফারাও সম্রাটরা ক্রীতদাসে পরিণত করেন। এক সময় তারা ইসরায়েলে গিয়ে সমবেত হতে সক্ষম হয় এবং ৩০০ বছর শিলোহ শহরে বাস করে (এই বিবলিক্যাল শহরের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে)। তাদের নবী শমূয়েল প্রথমে শৌল ও পরে তাঁর জায়গায় নবী দায়ূদকে [ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি নবী দাউদ (আঃ)] রাজা হিসাবে নিয়োগ দেন। তিনি ইহুদিদের প্রথম মন্দির ট্যাম্পল মাউন্ট নির্মাণ করেন শিলোহ শহরে। ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী ৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হয়ে জেরুজালেম ও শিলোহ ধ্বংস হয়। সে’সময় ট্যাম্পল মাউন্টও ধ্বংস হয়ে যায়। এই ট্যাম্পলের খোঁজে কোনো প্রত্নতাত্বিক খনন কাজ হয়নি; ফলে এ’রকম কোনো ট্যাম্পল ছিলো কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দ্বিতীয় মন্দিরটি ৫১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মাণ করেছিলেন আচেমেনিড সাম্রাজ্যের ইহুদ প্রদেশের গভর্নর (এবং পরবর্তীতে জুডাহের রাজা) জেরুব্বাবেল। পরে সেটি সংস্কার করেন রাজা হেরোড। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা আক্রমণ করে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে এবং দেবতা জুপিটারের উপাসনালয়ে পরিণত করে।
রোমানরা চলে যাবার পর ট্যাম্পল মাউন্টের ধ্বংসাবশেষ ঘিরে ইহুদিরা দেওয়াল তোলে এই বিশ্বাস থেকে যে এখানেই চূড়ান্ত মন্দির নির্মিত হবে যখন পৃথিবীতে মশীহ-র পুনরাবির্ভাব ঘটবে। ট্যাম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা এই দেওয়াল (‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’) ইহুদিদের কাছে ‘পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসেবে স্বীকৃত। এই দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তাদের প্রার্থনার দৃশ্য আমরা টিভিতে প্রচারিত খবর বা ডকুমেন্টারিতে দেখি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রাঃ) জেরুজালেম দখলের পর ট্যাম্পল মাউন্ট চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি আল-আকসা, বা বায়তুল মুকাদ্দাস হিসেবে পরিচিত যা ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ হিসেবে পরিগনিত হয়। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী বায়তুল্লাহ নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত আদম (আঃ) এটি নির্মাণ করেছিলেন। [আবু জর গিফারি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! দুনিয়াতে প্রথম কোন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে? তিনি বলেন, মসজিদুল হারাম। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, তারপর হলো মসজিদুল আকসা। অতঃপর আমি জানতে চাইলাম যে, উভয়ের মধ?্যে ব?্যবধান কতো বছরের? তিনি বললেন চল্লিশ বছরের ব?্যবধান। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১১৫)]। ইহুদি-মুসলিম বৈরিতার সূত্র এই দুই বিপরীতমুখী বিশ্বাসের মধ্যে নিহিত। আর এই বিশ্বাস থেকেই তৈরি হয়েছে ভ‚খণ্ডগত বিরোধ।
সপ্তম থেকে একাদশ শতাব্দী ইসরায়েল ভ‚খণ্ডটি মুসলিম শাসনাধীনে ছিলো। এটি ১০৯৯ সালে খ্রিস্টানদের দখলে যায়। ১১৮৭ সালে আইয়ুবীয় রাজবংশ, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিশরের মামলুক সলতানাত এবং ষোড়শ শতাব্দীতে উসমানীয় সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ফলে ইহুদিরা সপ্তম শতাব্দী থেকেই বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছে। পরে তারা ইউরোপ মহাদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু সেখানেও শেষ রক্ষা হয়নি। তারা দীর্ঘদিন ইউরোপ জুড়ে প্রধানত রোমান ক্যাথলিকদের হাতে বলপূর্বক ধর্মান্তরের শিকার হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অঞ্চলটি ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। এ’সময় এখানে বাস করতো প্রধানত ফিলিস্তিনিরা। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ফিলিস্তিনি ভ‚খণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষত ব্রিটেন, ফ্রান্স,জার্মানি,নরওয়ে, পোল্যান্ড, গ্রীস এবং সুইজারল্যান্ডে বসবাসকারী ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে জড়ো হতে থাকে। ফিলিস্তিনিরা বাধা দিলে তাদের কঠোর হাতে দমন করে শাসক ব্রিটেনের সেনারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন অংশ না হয়েও হিটলারের গ্যাস চেম্বারে প্রাণ দেয় ৬০ লক্ষ ইহুদি শিশু-বৃদ্ধ, নর-নারী। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ৫৬% ইহুদিদের এবং ৪৪% ফিলিস্তিনিদের দেওয়ার মাধ্যমে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়।
এরপর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরদিন মিশর, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান, লেবানন, সৌদি আরব ও ইয়েমেন একযোগে ইসরায়েল আক্রমণ করে। পাকিস্তান তাতে যোগ দেয় সেচ্ছাসেবী হিসেবে। প্রায় ৯ মাস স্থায়ী এই যুদ্ধে ইসরায়েল তার জন্য জাতিসংঘ বরাদ্দকৃত ভ‚খণ্ড ধরে রাখার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ভ‚মিরও ৬০% দখল করে নেয়। ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভ‚মি থেকে বিতাড়িত হয়ে শরণার্থী হয়ে পড়ে। বাকিরা ইসরায়েলি নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানে থেকে যায়। এই যুদ্ধে আরবদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ইসরায়েলি সেনারা সাহসী, কুশলী, কৌশলী ও নিবেদিত। যুদ্ধে তারা এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে যা সমর বিশেষজ্ঞদের ধারণার বাইরে ছিলো। যেমন, পুরো যুদ্ধ জুড়ে তারা ফাঁদ তৈরি করেছে এবং তাতে আটকা পড়ে আরব সৈন্যরা বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে। ১৯৪৮-র যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারছিলেন না আরব রাষ্ট্র নায়করা। তাঁরা তাদের সমর বিশেষজ্ঞদের এমন একটা যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন যা হবে তড়িৎ গতির, সর্বাত্মক ও ইসরায়েলের জন্য হতবুদ্ধিকর।
অন্যদিকে ইসরায়েল জানতো তাদের আরও যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে এবং পরবর্তী প্রতিটি যুদ্ধে জিততে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ’রকম একটা প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে আরও একটা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য এতদিন মিশরকে দায়ী করা আসা হয়েছে। কিন্তু গত এক দশকে অবমুক্ত হওয়া মার্কিন ও ইসরায়েলি নথি থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে আরব দেশগুলো যথেষ্ট সংগঠিত হয়ে ওঠার আগে ইসরায়েল আরও একটা যুদ্ধের অজুহাত খুঁজছিল।
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর প্যালেস্টাইন স্টাডিজের পরিচালক, অধ্যাপক ইলান পাপে ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ টেন মিথস এবাউট ইসরায়েল গ্রন্থে লিখেছেন, “এই যুদ্ধটা শুরু হতে যাতে বিলম্ব না হয় তার জন্য তাঁরা (ইসরায়েলের নেতারা) সব রকম পথের তালাশ করছিলেন- উস্কানি দেওয়া, বিভ্রান্তি ছড়ানো বা ছোট কোনো সংঘর্ষকে বড় করে ফেলা; তবে এটা নিশ্চিত করে যে যুদ্ধ শুরুর দায় যেনো নিজেদের ওপর না বর্তায়।” ১৯৬৭-র মে মাসের শেষের দিকে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক সদস্য মস্কোতে আটক হন। তার স্যুটকেসে পাওয়া এক গোপন নথির পাঠোদ্ধার করে দেখা যায় ইসরায়েল শীঘ্রই মিশরের সিনাই অঞ্চলে এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে তা দখল করে নিতে চেষ্টা করবে। আরব দেশগুলোর তৎকালীন মিত্র ও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত খবরটি কায়রো পৌঁছে দেয়। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা ছিলো সাজানো। মোসাদের ঐ গুপ্তচর ইচ্ছা করেই তার গতিবিধিকে সন্দেহজনক করে তুলেছিলেন এবং আত্মগোপনে থাকার ভান করছিলেন যাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার কাছে পাওয়া বানোয়াট গোপন নথি থেকে পাওয়া তথ্য আরব দেশগুলোকে আগেভাগে ইসরায়েল আক্রমণে উৎসাহিত করে। ইসরায়েলের আসল উদ্দেশ্য ছিলো একটা সর্বাত্মক যুদ্ধ যা তাদের এলাকা স¤প্রসারণের পাশাপাশি আরব দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রস্তুতিকে স্থবির করে দেয়।
তাদের এই ফাঁদে মিশর পা দিয়েছিল। তারা দ্রুত সিনাই উপদ্বীপে মোতায়েন থাকা জাতিসংঘ বাহিনীকে হটিয়ে ইসরায়েলি সীমান্তে সেনা সমাবেশ করে এবং উত্তরে আকাবা উপসাগর ও দক্ষিণে লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী তিরান প্রণালীতে নৌ অবরোধ দিয়ে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে। তারা বিপুল সংখ্যক সৈন্য, ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান মোতায়েন করে স্থল যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরায়েল ৫ জুন (১৯৬৭) মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিমান ক্ষেত্রগুলোতে এক যোগে বিমান হামলা চালিয়ে দেশ তিনটির বিমান শক্তির ৯০% ধ্বংস করে দেয়। এ’রকম একটা অভিযানের প্রস্তুতি ইসরায়েল ১৯৪৮-র যুদ্ধের পর থেকেই নিতে শুরু করেছিল। মোসাদের সদস্যরা শত্রু পক্ষের বিমান ক্ষেত্রগুলোর নিখুঁত নকশা তৈরি করে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর হাতে দিয়ে রেখেছিল।
৫ জুনের এই হামলায়-ই আসলে যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারিত হয়ে যায়। পরবর্তী ৫ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই মরুভ‚মি, সিরিয়ার গোলান মালভ‚মি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ৬ হাজার আরব সৈন্যের বিপরীতে ইসরায়েলের ৪ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৭-র যুদ্ধে ইসরায়েলের শক্তি বৃদ্ধির চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে— এই যুদ্ধে ৮০০ ইসরায়েলি ও ২০ হাজার আরব সেনা নিহত হয়। ইসরায়েল ও আরব দেশগুলো যথাক্রমে ৪৬ ও ৪৫২ টি যুদ্ধ বিমান হারায়। ১৯৪৮ সালে পরাজিত হলেও আরব দেশগুলো ফিলিস্তিনের ২৮% ভ‚মি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে তার পুরোটা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এই যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। (বিস্তারিত জানতে বিবিসি-র ১৯৬৭ war: Six days that changed the Middle East শিরোনামের এই আর্টিকেলটা পড়তে পারেন: https://www.bbc.com/news/world-middle-east-39960461
১৯৬৭-র যুদ্ধের পর আরব নেতৃবৃন্দের ধারণা হয় যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের কারণ যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাব এবং ইসরায়েলের আকস্মিক আক্রমণ। তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় এবং ৬ অক্টোবর, ১৯৭৩ ইসরায়েল আক্রমণ করে। সেদিন ছিলো তাদের বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন— ইয়ম কিপুর ডে বা প্রায়শ্চিত্তের দিন: যেদিন তারা কৃত অন্যায়ের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মিশরীয় ও সিরিয়ান সেনারা যুদ্ধবিরতি রেখা ভেদ করে যথাক্রমে সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভ‚মিতে ঢুকে পড়ে, সুয়েজ খাল অতিক্রম করে মিশরীয় বাহিনী সিনাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। বেশিরভাগ সমর বিশেষজ্ঞ মনে করেন এটা ছিলো ইসরায়েলের একটা কৌশল। তারা আরব বাহিনীকে অগ্রসর হতে দেয় এবং ঘেরাও করে ফেলে। আরব বাহিনী তখন আকাশ পথে তেল আবিব, হাইফা এবং জেরুজালেমে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে যুদ্ধে অর্জিত প্রাথমিক সাফল্য ধরে রাখার পরিকল্পনা করে। ১৯৬৭-র যুদ্ধের পর আরব দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেশ কার্যকর কিছু বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছিল। বিশেষ করে ভ‚মি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য শ্যাম-৬ শত্রুপক্ষের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রে প্রায় অব্যর্থভাবে আঘাত হানতে পারতো। তাই শত্রু দেশের আকাশে গিয়ে মারা পড়ার চেয়ে নিজের আকাশে ডেকে এনে তাদের বিমান ধ্বংস করার চেষ্টা করা ইসরায়েল শ্রেয় মনে করেছে। এই লক্ষ্যে তারা দীর্ঘদিন ধরে আরব দেশগুলোর বিমান বাহিনীর পাইলটদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিচিতির বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করেছে। বিভিন্ন স্কোয়াড্রনের লিডারদের স্কোয়াড্রন নাম্বার, সেগুলোর সাংকেতি নাম (যা যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়), তাদের ব্যবহৃত বিমানের বোমা বহন ও উড্ডয়ন ক্ষমতার তথ্য যোগাড় করেছে।
বিমান উড্ডয়নের সময় গ্রাউন্ড কন্ট্রোলে যারা থাকে তাদেরও নাম, ভাষা, কন্ঠস্বর জোগাড় করেছে। যে ফ্রিকোয়েন্সিতে বিমানগুলোর সাথে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল যোগাযোগ করে সেগুলো যোগাড় করেছে। ৯ অক্টোবর মিশর, সিরিয়া, ইরাক ও জর্ডান যে এক যোগে ইসরায়েলে বিমান হামলা চালাবে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলের সামরিক কমান্ডের কাছে সে তথ্য নির্ভুলভাবে পৌঁছে যায়। সম্মিলিত আরব বাহিনীর প্রায় ৩০০ বিমান একযোগে রওনা দেয়। ইসরায়েল বিমানগুলোর সাথে তাদের যোগাযোগের ফ্রিকোয়েন্সি হ্যাক করে নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় এবং পাইলটদের আরবি ভাষায় বিভ্রান্তিকর নির্দেশনা দিয়ে এমন এলাকায় নিয়ে যায় যেখানে বিপুল সংখ্যায় এন্টি এয়ারক্রাফট গান ও বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি আছে। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে ধরে নেওয়া হয় যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানগুলোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা মিশন বাতিল করে ফিরে আসার জন্য বিকল্প ফ্রিকোয়েন্সিতে মেসেজ পাঠায়। এতে পাইলটরা আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কোনটি আসল গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সেটা বুঝে ওঠা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে বিমানগুলো বিপদজনক এলাকায় পৌঁছে যায় এবং ২০০-র বেশি ভুপাতিত হয়। সে’সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গোল্ডা মেয়ার। তিনি সে’দেশের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। গায়ে পড়ে আরবদের সাথে আরও একটা যুদ্ধ শুরু করা ইসরায়েলের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে কিনা সে বিষয়ে মন্ত্রীসভা থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে। এই গুরু দায়িত্বের বোঝা একা মাথায় নেওয়াটা কঠিন ছিলো এবং ৭৫ বছর বয়স্ক স্বল্পভাষী এবং বাহ্যত খুব-ই নরম স্বভাবের এই নেত্রী ‘হ্যাঁ’-বাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। নিজেদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া ২০০-র বেশি বিমান ভুপাতিত করা একটা বড় সাফল্য। সিনাই-র যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা এরিয়েল শ্যারন (সে সময়ের একজন জেনারেল এবং পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী) প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে টেলিফোনে খবরটা জানালে তিনি বলেন, “ধন্যবাদ, জেনারেল। খবরটা আমি-ই আপনাকে জানাতে চাচ্ছিলাম। এটা ছিলো ইসরায়েলীয়/ ইসরায়েলসুলভ (Israelite)” (অন্য ভাষ্যে বলা হয়েছে ‘জ্যাকবীয়’)। এরপর ইসরায়েল প্রতি আক্রমণে যায় এবং প্রাথমিকভাবে হারানো ভ‚মি পুনরুদ্ধার করে মিশর ও সিরিয়ায় ঢুকে পড়ে। আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রস্তাবে ২৫ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি হয় এবং যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
ইসরায়েলের সাথে ৩ টি যুদ্ধে আরবরা হেরেছে মূলত প্রযুক্তি, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার কাছে। প্রত্যেক যুদ্ধে তারা আলাদা কৌশল ব্যবহার করেছে যা আগে থেকে অনুমান করার কোনো উপায় ছিলো না। তারা এতটা আনপ্রেডিকটেবল ছিলো যে শুধু ঘটনাটা ঘটে যাবার পর-ই তা কল্পনায় আনা সম্ভব হয়েছে। কোনো যুদ্ধে পরাজিত হবার পর আরব নেতৃবৃন্দ তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে পরের যুদ্ধে অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু সে যুদ্ধে ইসরায়েল ব্যবহার করেছে ঠিক উল্টো ও অভাবনীয়রকম প্রতারণামূলক আরও কিছু কৌশল। তারা বিশ্বের সমর বিদ্যাকে হতচকিত করে বারবার জয়ী হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত আরব ভুমিতে বলপূর্বক দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। সামরিক শক্তি হিসেবে ইরানের উত্থান ইসরায়েলের জন্য চিন্তার নতুন ইস্যু। ইরানকে তারা এমন একটা যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স তাদের পক্ষ হয়ে অংশ নেবে। প্রাজ্ঞ ইরানি নেতৃত্ব কোনো ফাঁদে পা দিতে রাজি নন। তাঁরা ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলার দারপ্রান্তে পৌঁছেছে। এই বোমা তৈরির উদ্যোগ নিলে ইরান-ইসরায়েল একটা যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইসরায়েল কী প্রযুক্তি লুকিয়ে রেখেছে সেটা অতীতের মতো সময়-ই বলে দেবে। এব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা টু Eilam রচিত The Secret of Israel’s Power বইটা অ্যামাজন থেকে কিনে পড়তে পারেন। আপাতত আল জাজিরার Infographic: What you need to know about IsraelÕs military শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে চোখ বুলিয়ে নিন: https://www.aljazeera.com/news/2021/6/4/infographic-what-you-need-to-know-about-israels-military.
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।