হাসান গোর্কি : সারা বিশ্বে পৃথিবীকে আদর করে ব্লু প্লানেট বলা হয়। আমরা বলি নীল গ্রহ। আমাদের বর্তমান সময়ের সাহিত্যে এমন লেখক পাওয়া বিরল যিনি পৃথিবীর জন্য ‘নীল গ্রহ’ অভিধাটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, নজরুল, শেকসপিয়র, কীটস, তলস্তয়, ব্রাউইনিং, অস্টেন, বিদ্যাপতি, বঙ্কিমচন্দ্র, আলাওল, শরৎচন্দ্র- কেউ-ই ‘নীল গ্রহ’ শব্দগুচ্ছটি লেখেননি। কারণ, বাইরে থেকে পৃথিবী দেখতে যে প্রধানত নীল সেটা প্রথম দেখা যায় ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পাঠানো পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক’ এর প্রেরিত ছবি থেকে। যদিও এর আগে বিজ্ঞানীরা কল্পনায় পৃথিবীর যে ছবি এঁকেছেন তার সাথে ‘স্পুটনিক’- এর পাঠানো ছবির প্রায় শতভাগ মিল পাওয়া যায়। কিন্তু ‘নীল গ্রহ’ টার্মটি সাহিত্যে এসেছে মোটামুটি ৬/৭ দশক আগে। আমরা যেহেতু এই সময়ের মানুষ তাই আমরা এটার সাথে পরিচিত। আমাদের হয়তো এটা ভেবে অবাক লাগছে যে আগের দিনের মানুষ ‘নীল গ্রহ’ বলে কিছু চিনতো না। এই ‘নীল গ্রহ’ ছাড়াও আমাদের জানা মহাবিশ্বে কোটি কোটি গ্রহ আছে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবী ছাড়া কোনো মহাজাগতিক স্থানের কথা আমরা জানি না যেখানে প্রাণের অস্তিত্তে¡র প্রমাণ পাওয়া গেছে। পৃথিবী এলো কীভাবে? আমাদের জানা অন্য গ্রহ থেকে সে আলাদা কেনো? টিকে থাকবে আর কতদিন?

পৃথিবী শব্দটা এসেছে পৃথ্বী থেকে। পৌরাণিক মহারাজ পৃথুর রাজত্বের নাম ছিলো পৃথ্বী। কালক্রমে তা পৃথিবী হয়েছে। পুরানে শুরুর ইতিহাসটাও সরলÑ “মহারাজ পৃথু স্নেহার্দ্রহৃদয় এই সর্বংসহা জীবধাত্রীকে নিজ আদরের কন্যারূপে স্বীকৃতি দিলেন। নিজ ধনুর প্রান্তভাগ দ্বারা বহু পর্বতের ঊর্ধ্বাংশ চূর্ণ করে ভ‚মির বিশাল অংশ সমতলে পরিণত করলেন। অতঃপর তিনি প্রজাপালনে রত হলে- তিনি গ্রাম, ছোট ও বড় নগর, বহু প্রকারের দুর্গ, ঘোষপল্লি, গো-মহিষের বাসস্থান, সৈন্যশিবির, খনি ও তৎসন্নিহিত বাসভ‚মি, কৃষকপল্লি- সবই সুনির্দিষ্টরূপে বিভাগ করে মানুষের বাসস্থানের পরিকল্পিত নির্মাণরীতি প্রবর্তন করলেন” (পৃথু উপাখ্যান: পর্ব ১)। খ্রিস্ট ধর্ম মতে ঈশ্বর ৬ দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন: ১. শুরুতে, ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। প্রথমে পৃথিবী সম্পূর্ণ শূন্য ছিল; পৃথিবীতে কিছুই ছিল না। ২. অন্ধকারে আবৃত ছিল জলরাশি আর ঈশ্বরের আত্মা সেই জলরাশির উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ৩. তারপর ঈশ্বর বললেন, “আলো ফুটুক! (Let there be light)” তখনই আলো ফুটতে শুরু করল। ৪. আলো দেখে ঈশ্বর বুঝলেন, আলো ভালো। তখন ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলোকে পৃথক করলেন। ৫. ঈশ্বর আলোর নাম দিলেন, ‘দিন’ এবং অন্ধকারের নাম দিলেন ‘রাত্রি’। সন্ধ্যা হলো এবং সেখানে সকাল হলো। এই হলো প্রথম দিন। (দ্য বুক অব জেনেসিস, অধ্যায়- ১, ভার্স: ১-৫)। এভাবে ষষ্ঠ দিনে এসে ঈশ্বর সৃষ্টিকে পূর্ণতা দেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম করেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের বয়স কয়েক হাজার বছর হলেও মহাবিশ্বের আঙিনায় তা সত্যিকার অর্থে দৃষ্টি মেলাতে শুরু করেছে মাত্র এই ১৯৯০ সালে- হাবল টেলিস্কোপ উৎক্ষিপ্ত হবার পর। প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাত্ত থেকে এখন অনুমান করা হয় যে মহাজগতে কোটি কোটি বাসযোগ্য গ্রহ আছে। এই হিসাব মাথায় নিলে আমরা বুঝতে পারি ‘আসমান ও জমিন’- এর যে ধারণা প্রাচীন পৃথিবীর মানুষের মাথায় এসেছিল তা তাদের খালি চোখে দেখা পর্যবেক্ষণের ফসল। আমাদের এই আবাস আসলে অসীম ঘোর লাগা, দুষ্পাঠ্য ও বিভ্রান্তিকররকম গতিময়, রহস্যঘন গন্তব্যে ছুটে চলা শ্যামল প্রলেপ মাখা একটা প্রস্তর খণ্ড ছাড়া কিছু নয়:
“ঈশ্বর ছুড়েছে ঢিল ঈশ্বরীর দিকে, কৌতুকবিলাসে।
গ্রহটিকে মাটির ঢেলা বানিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্ত থেকে
ক্ষেপণ করেছে ভগবান, অন্য প্রান্তে থাকা ভগবতীর প্রতি।
মহাকাশ জুড়ে প্রসারিত মহাহিম শূন্যতা, লক্ষ-ডিগ্রি নিস্তব্ধতা-
তারই মধ্য দিয়ে একপিÐ ছোট্ট শ্যামল কোলাহল হয়ে
ধেয়ে যাচ্ছে এই ঢিল”
(কৌতুকবিলাস, মাসুদ খান)

শিল্পীর কল্পনায় আদি পৃথিবী। সূত্র: NASA/Goddard Image Lab

পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞানের বর্ণনাটা এরকম: আজ থেকে ১৩৬০ কোটি বছর আগে পরম শূন্যে পুঞ্জীভ‚ত এক অসীম শক্তির বৃহৎ বিস্ফোরণ ঘটে। পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার সময় শক্তি পদার্থে রূপান্তরিত হয় এবং গ্যালাক্সি তৈরি করে যারা এখনও পরস্পর থেকে অকল্পনীয় গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা বিজ্ঞানীদের নিছক অনুমান নয়। এর পর্যবেক্ষণযোগ্য সাক্ষ্য আছে। এই তত্তে¡র উদ্ভাবক ফ্রিডম্যান ও লেমেতার। ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যার আলোকে এটি তাত্তি¡কভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন জর্জ গ্যামো ও তাঁর সহকর্মীরা। এরপর বিজ্ঞানী এলান পেনজিয়াস ও উড্রো উইলসন যৌথ গবেষণার মাধ্যমে মহাজাগতিক ক্ষুদ্র তরঙ্গ পটভ‚মি বিকিরণ আবিষ্কার করেন (এজন্য ১৯৭৮ সালে তাঁরা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন)। তাঁরা মহাকাশের সবদিক থেকে সবসময় ভেসে আসা ২.৭ ক উষ্ণতার তরঙ্গস্রোত তাদের গ্রাহক যন্ত্রে ধারণ করেন। পূর্বের অনুমান মতো তাঁরা দেখলেন এই তরঙ্গস্রোত সমসত্ত¡ ও দিকপ্রতিসম (isotropic)। এতে ‘বিগ ব্যাং’ এর স্পষ্ট প্রমাণ খুঁজতে থাকা বিজ্ঞানীরা স্বস্তি পেলেন।
এরকম একটা ছুটন্ত গ্যালাক্সিতে সূর্যের সৃষ্টি হয় ৪৬০ কোটি বছর আগে। একই সময় সৌর জগতেরও সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণনশীল সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা অগ্নিগোলকগুলো মহাকর্ষের টানে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। এই অগ্নিগোলকগুলোর মধ্যে সূর্যের তৃতীয় নিকটতমটি হলো আমাদের আজকের পৃথিবী। নেচার সাময়িকীতে (জুন, ২০০২) শুরুর সময়ের তাত্তি¡ক ব্যাখ্যা লেখা হয়েছে এভাবেÑ “একটি আণবিক মেঘ থেকে একটি সৌর নীহারিকা মহাকর্ষীয় ধসের মাধ্যমে একটা এলাকায় জড়ো হয় এবং ঘুরতে শুরু করে। ঘূর্ণনজনিত কারণে তা চ্যাপ্টা হয়ে একটা পরিনাক্ষত্রিক চাকতি তৈরি করে এবং তা থেকে সূর্য ও গ্রহ-উপগ্রহ-গ্রহাণুদের উৎপত্তি ঘটে।” একটি নীহারিকাতে অনেক ধরণের গ্যাসীয় পদার্থ, বরফ কণা মহাজাগতিক ধূলি ও আদি নিউক্লাইড থাকে (নিউক্লাইড হলো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রোটন এবং নিউট্রন ধারণ করে এমন স্বতন্ত্র ধরনের পরমাণু বা নিউক্লিয়াস)। ধারণা করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় পৃথিবীটি গঠিত হতে প্রায় ২ কোটি বছর লেগেছিল। আদি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল গঠিত হয়েছিল আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত মিথেন, এমোনিয়া, নিয়ন ও জলীয় বাষ্প দিয়ে।

পৃথিবীর গঠন নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহ ছিলো এবং তাদের অদ্ভুত কিছু বিশ্বাস ছিলো। যেমন, ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত মত (ভ‚তবাদ) অনুসারে সমস্ত মহাজাগতিক সৃষ্টির ভিত্তি উপাদান হলো ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (পানি), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) ও ব্যোম (আকাশ)। আবার আব্রাহিমিক ধর্মগুলোতে বিশ্বাস করা হয় পৃথিবী সমতল এবং পাহাড়গুলো খুঁটির কাজ করে ‘যাতে পৃথিবী কোনদিকে ঢলে না পড়ে’। আসলে শূন্যে ভাসমান একটা গোলকের ঢলে পড়ার সুযোগ নেই। আর পৃথিবী কক্ষচ্যুত হলে পাহাড় তা ঠেকাতেও পারবে না। তাপমাত্রা কমে যাবার সাথে সাথে আদি পৃথিবীর উপরিতল সংকুচিত হতে থাকে এবং কুঁচকে যায়। এই কোঁচকানো অংশগুলো-ই পাহাড়-পর্বত। ভ‚পৃষ্ঠে আলাদা করে এদের কোনো গোড়া পোঁতা নেই। এটা অনেকটা দুধের সরের মতো। পৃথিবীর গভীরতার তুলনায় এই পাহাড়-পর্বত দুধের সরের চেয়ে কম ছাড়া বেশি নয়। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভ‚পৃষ্ঠের দূরত্ব ১২,৫০০ কিলোমিটার। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ এভারেস্টের উচ্চতা ৮.৮ কিলোমিটার। মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে একটা নিখুঁত গোলাকার বলের মতো দেখায়। ছোটবেলায় আমরা ভ‚গোল বইয়ে পড়েছি, পৃথিবী কমলালেবুর মতো। আসলে পৃথিবীর দুই মেরু মাত্র ২৫ কিলোমিটার চাপা; অর্থাৎ বিচ্যুতির পরিমাণ এক হাজার ভাগের এক ভাগ। কোনো গোলকের (যেমন একটা ফুটবলের) হাজার ভাগের এক ভাগ বিচ্যুতি আমাদের চোখে পড়ার কথা নয়। একইভাবে পৃথিবীও দেখতে নিখুঁত গোল।

পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ নিয়ে জানার এখনও অনেক বাকি। কয়লার খোঁজে মানুষ মাটির মাইল খানেক নিচে নেমেছে। কিন্তু পৃথিবীর ভিতরের অবস্থা জানতে গেলে যতটা খুঁড়ে দেখা দরকার এখনো ততটা নিচে পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি। পরোক্ষ কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়েছে যে, পৃথিবী গঠিত হয়েছে লোহা (৩২.১%), অক্সিজেন (৩০.১%), সিলিকন ( ১৫.১%), ম্যাগনেসিয়াম ( ১৩.৯%), সালফার (২.৯%), নিকেল (১.৮%) এবং এলুমিনিয়ান (১.৪%) দিয়ে। অন্যান্য উপাদান রয়েছে ১.২%। এই তালিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ লোহা। ভ‚ত্বকীয় পাতসমূহ (টেকটোনিক প্লেট) প্রকৃতপক্ষে চাপের কারণে অতি ঘন অবস্থায় থাকা উত্তপ্ত গলিত লোহার সমুদ্রের ওপর ভাসছে। তরল হলেও এর ঘনত্ব এতো বেশি যে তা টেকটোনিক প্লেটগুলোকে ভাসিয়ে রাখতে পারে। তাহলে লোহা পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে এরকম ধারণার উৎস কী? পৃথিবীতে লৌহ যুগের সূত্রপাত হয় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। নৃতাত্তি¡ক গবেষণায় দেখা গেছে এই প্রযুক্তি ভ‚মধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও পরে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সারুনাস মিলিসাসকাস তাঁর Old World archaeology; European prehistory বইয়ে লিখেছেন,”কৃষি কাজ, বয়নশিল্প, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি, আবাসন ও পশু শিকার সহ দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে লোহার ব্যবহার রপ্ত করার পর ভ‚মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে লোহা ঈশ্বর প্রেরিত কোনো বস্তু। কারণ তখন লোহার উৎস ছিলো আকরিক ও পতিত উল্কার দেহাবশেষ।“ পৃথিবীর ভর ৬ লক্ষ কোটি কোটি টন। এখন আমরা জানি, এর এক তৃতীয়াংশ-ই (২ লক্ষ কোটি কোটি টন) লোহা। এই লোহার প্রায় ৯৯% আছে পৃথিবীর কেন্দ্র জুড়ে। প্রাচীনকালে এই তথ্য মানুষের কাছে ছিলো না।

পৃথিবীতে প্রাণের প্রধান উৎস পানি। ভ‚পৃষ্ঠের ৭ ভাগের ৫ ভাগ জলমগ্ন থাকলেও পৃথিবীর মোট পানির অনুমানিক ভর প্রায় ১.৩৫দ্ধ১০১৮ মেট্রিক টন যা পৃথিবীর ভরের ৪৪০০ ভাগের এক ভাগ। মোট পানির প্রায় ৯৭.৫% লবণাক্ত। মাত্র ২.৫% হলো মিঠা পানি। আবার এই মিঠা পানির ৬৮.৭% আছে বরফ হিসাবে আইস ক্যাপে এবং হিমবাহে। এই সৌর জগতের সবগুলো গ্রহ-উপগ্রহ বাদ দিয়ে শুধু পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ঘটার অন্যতম কারণ হলো পানির উপস্থিতি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের সাম্যের কারণে এরকম ঘটেছে। পৃথিবী এমন একটা দূরত্বে আছে যেখানে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। পিতৃনক্ষত্র থেকে এরকম দুরত্বকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘গোল্ডিলক জোন’। সূর্যের অনেক কাছে হবার কারণে বুধ গ্রহের বিষুব অঞ্চলে তাপমাত্রা দিনের বেলা সাড়ে চারশ’ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। ফলে সেখানে পানির তরল অবস্থায় থাকার সুযোগ ছিলো না এবং প্রাণ সৃষ্টি হবার কারণ তৈরি হয়নি। একইভাবে অন্য পাথুরে গ্রহ শুক্র উত্তপ্ত হবার কারণে এবং মঙ্গল বা ইউরেনাস শীতল হবার কারণে প্রাণ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি।

আমরা প্রায়-ই প্রশ্ন করি পৃথিবী এমন নিখুঁত দূরত্বে আছে কেনো? বিষয়টা এভাবে ভাবুন, পৃথিবীর কক্ষপথে পৃথিবী না থেকে মঙ্গল বা বুধ গ্রহ থাকলে তখন সেখানে প্রাণের উদ্ভব ঘটতো। আবার সূর্যের তাপমাত্রা কম হলে অথবা সূর্য থেকে বুধের দূরত্ব কম হলে সেখানে প্রাণের জন্ম হতো। সেই প্রাণিদের মধ্যে মানুষের মতো বুদ্ধিমান কোনো প্রজাতি থাকলে তারাও একই প্রশ্ন করতো- আমাদের গ্রহ এমন নিখুঁত দূরত্বে আছে কেনো? মঙ্গলের কক্ষপথে পৃথিবী থাকলে পৃথিবীও হতো একটা প্রাণহীন, বিজন, ঊষর প্রান্তর; আর বুধের কক্ষপথে থাকলে একইরকমভাবে জনমানবহীন মৃত,উত্তপ্ত একটা গ্রহ হতো সে। তখন আমাদের উৎপত্তি হতো না; আর আমরা বলতেও পারতাম না, পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হচ্ছে না কেনোÑ যেমন পৃথিবীর শুরু থেকে ৪৫৮ কোটি বছর সেটা বলতে পারিনি; এমনকি যখন চারশ’ কোটি বছর নানা জাতের সংখ্যাতীত প্রাণি পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছে তখনও আমরা ছিলাম না।

আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে মনে করে আসা হয়েছে। ‘আসমান’কে ‘জমিনে’র সমান গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ত¡ বলে মনে করা হয়েছে। বিজ্ঞান বলছে, পৃথিবীর তুলনায় শূন্যে ভাসমান একটা ধূলিকণা যতো বড়, মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের পৃথিবী তার চেয়ে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ ছোট। ধর্মগ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে পৃথিবী স্থির এবং পৃথিবীর ‘আসমান’কে সাজানো হয়েছে তারকারাজি দিয়ে। আসমানের যে খুঁটি নাই সে বিষয়ে বিস্ময়ও প্রকাশ করা হয়েছে। এখন আমরা জানি, সূর্যের তুলনায় পৃথিবী ১৩ লক্ষ গুণ ছোট। তাহলে কি সূর্যের মতো বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র দিয়ে আমাদের আকাশ সাজানো হয়েছে? বিষয়টা এরকম যে- একটা ধূলিকণার গায়ে বসে কয়েক মিলিয়ন অণুজীব ভাবছে তাদের আকাশ সজ্জিত করা হয়েছে সূর্য ও সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ দিয়ে! এই ভাবনার কারণ হলো, ঐ ধূলিকণার আকাশে যে সূর্যের জায়গা হবে না সেটা ঐ অণুজীবদের মাথায় আসার কথা নয়। আমরা যে পৃথিবীর গায়ে পিঁপড়ার মতো হেঁটে বেড়াই, চাকরি করি, ফসল ফলাই, যুদ্ধ করি, উপন্যাস লিখি, সে নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে সেকেন্ডে ৪৬০ মিটার, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার এবং সূর্যের সাথে গ্যালাক্সি প্রদক্ষিণ করে সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার গতিতে। অন্য গ্যালাক্সিগুলোর সাপেক্ষে আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে অজ্ঞাত গন্তব্যে ছুটছে সেকেন্ডে ৬৬০ কিলোমিটার গতিতে (বা রাইফেলের গুলির ৬৬০ গুণ গতিতে)। পৃথিবীর পিঠে বসে এই সবগুলো গতিতে-ই আমরা একই সাথে বিভিন্ন দিকে ছুটে চলেছি। একইভাবে মহাবিশ্বের অনুমিত ২০,০০০ কোটি গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে দূরের গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছে।

পৃথিবীর ভ‚খণ্ড গঠিত হবার বিষয়ে উপাত্ত ভিত্তিক যে অনুমান বিজ্ঞানীদের আছে তার মূল কথা মোটামুটি এরকম: সূর্য থেকে আলাদা হবার মোটামুটি এক-দুই কোটি বছরের মধ্যে পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে পরিণত হয় গলিত লাভার সমুদ্রে। লাভার উপরিস্তর জমাট বেঁধে তৈরি হয় পাথরের সাতটি অতিকায় টেকটোনিক প্লেট। এই প্লেটগুলোর ওপর তৈরি হয় ভ‚খণ্ড-মহাদেশ- মহাসাগর। আজ থেকে ১১০ কোটি বছর পূর্বেও পৃথিবীতে একটি মাত্র ভ‚খণ্ড ছিলো। বিভিন্ন পর্বতমালা, ভ‚ত্বকের গঠন ও মানচিত্র দেখে গবেষকেরা বের করতে পারেন ঠিক কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা একত্রে যুক্ত থেকে এই মহা-মহাদেশের সৃষ্টি করেছিলো। বিজ্ঞানীরা এই মহা ভ‚খণ্ডের নাম দিয়েছেন রোডিনিয়া। রুশ ভাষায় ‘ৎড়ফরহধ’ অর্থ মাতৃভ‚মি বা জন্মভ‚মি। ‘rodina’ থেকে এসেছে রোডিনিয়া। ৭৫ কোটি বছর পূর্বে এর কিছু অংশ ভেঙে দক্ষিণ গোলার্ধে চলে যায়। ৩০ কোটি বছর আগে এরা জুড়ে গিয়ে আবার একটা ভ‚খণ্ড তৈরি করে। তার নাম দেওয়া হয়েছে প্যানজিয়া। এভাবে ভাঙা গড়ার খেলায় মাত্র ৯ কোটি বছর আগে ভারত ছেড়ে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার সাঁতরে মাদাগাস্কার চলে যায় উত্তমাশা অন্তরীপের কাছাকাছি- মোজাম্বিকের উপক‚লে। ভ‚খণ্ডগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হয়েছে বা জোড়া লেগেছে তখন পিঠে করে বয়ে নিয়ে গেছে পাহাড়-পর্বত (খুঁটি!), লেক, বন, হ্রদ, মালভ‚মি, মরুভ‚মি, শস্য ক্ষেত।

পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে ওঠার সময়টা কেমন ছিল বিজ্ঞানীরা তা ভালো করে জানেন না। তাঁদের অনুমান পৃথিবী সৃষ্টির ৫০ কোটি বছরের মধ্যেই সেখানে প্রাণ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কয়েক কোটি বছর ধরে চলা অবিরাম ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের ফলে সৃষ্টি হয় এমোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ পূর্ণ জলের সাগর-মহাসাগর। লাভা শীতল হয়ে তৈরি করে জিরকন, পাথর, মাটি, লোহা, নিকেল, দস্তা। জমাট বাঁধার কারণে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র গঠিত হয়, যা পৃথিবীর বায়ুমÐলকে উড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। আগ্নেয়গিরির উৎগীরণ ও জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ গ্যাসের অতিনির্গমন (Outgassing), সূর্যের আলো, তাপ, বজ্রপাত থেকে আসা বিদ্যুৎ রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এমিনো এসিডের জন্ম দেয়। এরপর স্বয়ং উদ্ভূত আমিষের জটিল যৌগ আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়ে এককোষী প্রাণের সৃষ্টি করে। সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ কোটি বছর আগে পাথরের ওপরে জন্মানো সায়ানোব্যাকটেরিয়া বা নীলচে সবুজ শ্যাওলার সালোকসংশ্লেষণ থেকে আসে প্রথম অক্সিজেন। শুরু হয় অনন্ত মহাশূন্যে ছুটে চলা এক শ্যামল শিলার গায়ে প্রাণ নামক এক বিস্ময়কর অস্তিত্তে¡র পথচলা। (পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।