হাসান গোর্কি : আমরা যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে সেখানে বেড়ে উঠেছি এবং এখন অভিবাসন সূত্রে অন্য দেশে বসবাস করছি, জন্মভূমি নিয়ে তাদের কিছু মানসিক সংশ্রব আছে। গতরাতে আমি রুদ্ধশ্বাসে ই.এস.পি.এন.- এ বাংলাদেশ- জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ম্যাচের লাইভ স্কোর দেখেছি। প্রবাসী লেখকদের একটা বড় অংশ প্রতিবছের বাঙলা একাডেমির বইমেলায় যান। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসীদের আগ্রহ, যারা দেশে থাকেন তাদের সমান। স্বাধীনতার প্রাক্কালে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশের সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন ৩৫ তম অর্থনীতির দেশ। পেছনে আছে মালয়েশিয়া (৩৬) সিঙ্গাপুর (৩৭) ভিয়েতনাম (৩৮) সাউথ আফ্রিকা (৩৯) ফিলিপাইন (৪০) ডেনমার্ক (৪১) পাকিস্তান (৪২) কাতার (৫৫) কুয়েত (৫৯) শ্রীলংকা (৭৯) মায়ানমার (৯০)। উন্নয়ন বলতে কি আমরা অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, সপিং মলে কেনাকাটা, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভার- এসব বুঝবো? দুই দশক আগে ঢাকা যশোর রুটে সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট চলতো। এখন দিনে ১০ টি ফ্লাইট চলে। কক্সবাজার বিমানবন্দর এখন গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডের মতো ব্যস্ত। এই অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে কি উন্নয়ন বলা যাবে? এ’রকম এক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর আনু মোহাম্মাদ বলেছেন, “আগে উন্নয়নের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে। তারপর বুঝতে পারা যাবে আমরা উন্নয়নের পথে আছি কিনা।”
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি;”। আমরা লক্ষ করলে দেখবো ‘বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা’র উদ্দেশ্য হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’ করার কথা বলা হয়েছে। উন্নয়নের প্রধান সূচক হবার কথা ছিল এই তিনটি লক্ষ্য অর্জন, যেখানে অর্থনীতির অগ্রগতি হবে এগুলোর বাহন।
শিরোনামে যেমন দেখেছেন, আজকের লেখার বিষয়বস্তু ‘মানবিক মর্যাদা’। বাসি হয়ে যাওয়া একটা প্রসঙ্গ বিষয়টা বুঝতে আমাদের সহায়তা করতে পারে। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরার পর বাফুফে দপ্তরে সংবাদ সন্মেলনে হাজির হয়েছিল। এক সময় দলপতি ও কোচকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে শুকনো মুখে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এই দুইজন ব্যতীত অন্য কারো স্টেজে থাকার কথা নয়। মন্ত্রী, বাফুফের চেয়ারম্যানদের বসার কথা শ্রোতাদের সারিতে। পৃথিবীর সব দেশে সেটাই ঘটে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন ফেসবুকে ছবিটি পোস্ট করে লিখেছিলেন, “যে সাংস্কৃতিক চর্চা এ ছবিতে প্রতিফলিত তা-ই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর…।” মামুন মেধাবী মানুষ। তিনি এক বাক্যে সমস্যাটা বর্ণনা করেছেন।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হবার পর হোয়াইট হাউসের সামনে এক শিশু তাকে দেখে ‘হাই’ বললে তিনি এগিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলেন। এ’সময় শিশুটিকে কষ্ট করে উপরের দিকে তাকাতে দেখে বাইডেন হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েন এবং আলাপচারিতা শেষ করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও কারো সাথে কথা বলার সময় প্রায়-ই মেঝেতে বসে পড়েন। প্রথমবার নির্বাচিত হবার পর মন্ট্রিয়লের প্লামনডন মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের সাথে তাঁর শুভেচ্ছা বিনিময়ের দৃশ্য আমরা দেখেছি। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একবার হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে সাংবাদিকরা তাঁর পিছু নেয়। কর্তব্যরত ডাক্তার এতে বিরক্তি প্রকাশ করে জানান যে এতে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ক্যামেরন দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাসা থেকে নিজের বাসায় চলে যাবার সময় তিনি মুভারদের সাথে মালামাল টানাটানি করেছেন।
আমরা একটা ছবিতে দেখতে পাই, নেহেরু রবীন্দ্রনাথের সামনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। বঙ্গবন্ধু অসুস্থ মওলানা ভাসানী বা নজরুলকে দেখতে গিয়ে তার খাটের পাশে মেঝেতে বসেছেন। বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। এক দুপুরে ৩২ নম্বরের বাসায় ভালো রান্না হয়েছে। ছবিতে দেখেছি, এক সিপাহীর হাত ধরে তাকে বাসায় নিয়ে যেতে টানাটানি করছেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে দেখা করতে তাঁর দপ্তরে যান। বের হবার সময় হিথ দ্রæত এগিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির দরজা খুলে ধরেন। গত সপ্তাহে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এক হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে এক বৃদ্ধা রোগীকে জিজ্ঞেস করেন, ডাক্তার ও নার্সরা ঠিকমতো তার দেখাশোনা করছে কিনা। জবাবে ওই রোগিণী বলেন, ‘‘ওরা সব সময়ই ভালভাবে কাজ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনারা ওদের ঠিকভাবে বেতন দেন না।’’ ঋষি বলেন, ‘‘আমি চেষ্টা করব।’’ বৃদ্ধা ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, ‘‘না, আপনারা ঠিকমতো চেষ্টা করছেন না। আরও সক্রিয় হতে হবে।’’ ঋষি উত্তরে বলেন, ‘‘ঠিক আছে, তা-ই হবে।’’
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কোনো তত্ত¡ বা উপদেশ নয়; আমাদের আচরণ কেমন হতে পারতো তার দুটি কাল্পনিক ছবি আঁকা যাক- (১) সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল পরম মমতার সাফ জয়ের গল্প শুনছেন। (২) ফাইনালে দুই গোল করা কৃষ্ণা রানী বাফুফে থেকে বাড়ি যাবেন। সালাহউদ্দিন দ্রুত নেমে এসে কৃষ্ণার গাড়ির দরজা খুলে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। খেয়াল করে দেখুন এ’রকম দৃশ্য কল্পনায় নিতে কষ্ট হচ্ছে। কারণটা প্রফেসর মামুন বলে দিয়েছেন- একটা ভয়ঙ্কর পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির অর্বাচীন চর্চা। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী মানবিক মর্যাদায় সরকার প্রধান, রিকশা চালক, জেলে, রাষ্ট্রপ্রধান, অধ্যাপক, নির্মাণ শ্রমিক সমান। আমরা জানি, বাস্তব চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা।
বাংলাদেশ ডিগনিটি ফোরাম নামে একটা সংগঠনের প্রধান নির্বাহী বায়েজিদ্দৌলা একজন মেধাবী একাডেমিশিয়ান। তিনি একজন এক্টিভিস্টও। মানবিক মর্যাদা বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাঁর সংগঠন কাজ করে। দেশে আরও এ’রকম সংগঠন গড়ে ওঠা উচিত। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দরকার সরকার ব্যবস্থায় নিয়োজিত মানুষদের মনস্তত্তে¡। এখানে ‘নিয়োজিত’ শব্দটা আমি ভুলভাবে প্রয়োগ করিনি। সরকার পরিচালনায় যারা আছেন জনগণ তাঁদের নিয়োগ দিয়েছে। এই কথাটা মনে রাখলে মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে সাম্যের ধারণা চর্চা করার মানসিকতা তৈরি হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী দেশ চালান। শ্যামলী পরিবহনের ড্রাইভার গাড়ি চালান। যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁরা দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁদের কাজের গুরুত্বে অনেক বড় পার্থক্য আছে। কিন্তু সেটা যখন মর্যাদার ক্ষেত্রেও পার্থক্য তৈরি করে তখন তা আর ন্যায়ানুগ থাকে না।
আমি রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর ওরিয়েন্টেশনের দিন সবার আগে হাজির হয়েছি। নির্দিষ্ট হল রুমের দরজায় গিয়ে দেখলাম, এক ভদ্রলোক একাই চেয়ার টেবিল টানাটানি করছেন। তিনি দরজা খুলে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন। আমি একটা চেয়ারে বসলাম। তিনি এসে আমার সাথে গল্প শুরু করলেন। অনুষ্ঠান শুরু হলো। চেয়ারগুলো বৃত্তাকার করে সাজানো। আমরা সবাই অল্প করে কথা বললাম। শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টকে কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানালেন সঞ্চালক। দেখলাম, ঐ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি পেছনের দিকে একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। সেখান থেকেই কথা বললেন। আমরা পেছন ফিরে তাঁর কথা শুনলাম। পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি ছোট হয়ে যাননি। যাদের অভ্যর্থনা জানাতে ঐ ওরিয়েন্টেশন, তাদের সন্মান জানিয়ে নিজেও সন্মানিত হয়েছেন।
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি
hassangorkii@yahoo.com