হাসান গোর্কি : প্রত্যেক ধর্মের মানুষ তাদের ঈশ্বরের আরাধনা করার পর শান্তি অনুভব করে। এই প্রশান্তির উৎস কী? মহাজগতে সর্বাধিক একজন সত্য ঈশ্বরের থাকার কথা। পৃথিবীতে মোটামুটি ৪২০০ ধর্মের অস্তিত্ত¡ আছে। প্রত্যেক ধর্মের ঈশ্বর আলাদা। তাহলে ভুল ঈশ্বরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১৯৯। আরাধনার সময় প্রশান্তিটা যদি ঈশ্বরের পক্ষ থেকে অতীন্দ্রিয় মাধ্যমে এসে থাকে তাহলে যারা ভুল ঈশ্বরের প্রার্থনা করে তারা শান্তি পায় কেনো? এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, যার প্রথম অংশের ভিত্তি দার্শনিক। এই বিপুল বা অন্তহীন মহাজগতে আমরা অতি ক্ষুদ্র ও কার্যত শক্তিহীন একটা প্রাণি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের কল্পনাশক্তি আছে। যখন আমরা ভাবি এক সময় আমরা এই পৃথিবীতে থাকবো না তখন খারাপ লাগে। এই কষ্টের অনুভূতি থেকে বাঁচার জন্য আমরা একটা পরজগতের কল্পনা করি এবং নিজেদের প্রবোধ দেই এভাবে যে সেখানে আমাদের একটা অন্তহীন স্থায়ী প্রশান্তিময় আবাস থাকবে। যেহেতু মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই তাই কল্পিত কোনো মহাশক্তির কাছে সে’রকম একটা জগতে আশ্রয় পাবার জন্য প্রার্থনা করি। আমাদের অভিযাচন ও অনুনয়ের অন্য লক্ষ্য পার্থিব প্রশান্তি। সংক্ষেপে এটা-ই আমাদের প্রার্থনার মূল সূত্র।

আমাদের এই উপলব্ধি বা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বংশগতি পরিবর্তনের প্রবাহের বিশেষ একটা সময়ে। প্রায় দুই লাখ বছর আগে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষ হিসেবে হোমো সেপিয়েন্সদের আবির্ভাব ঘটে। সে’সময় বৃহৎ নরবানরদের (‘এপ’ এর বাংলা করা হয়েছে ‘নরবানর’। ফলে বানর থেকে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে ভুল করে) শরীরে FOXP2 নামের জিনটি এমাইনো এসিডের বিশেষ দু’টি যৌগসহ আবির্ভূত হয় যা তাদের বুদ্ধিমান করে তোলে এবং অন্য সকল প্রাণি থেকে আলাদা করে ফেলে। শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের পার্থক্য খুব-ই সামান্য শিম্পাঞ্জির শরীরে FOXP2 নামের জিনটির অনুপস্থিতি। তাহলে কী ঘটবে যদি আমরা একটা শিম্পাঞ্জির শরীরে এই মহামূল্যবান জিনটি সফলভাবে স্থাপন ও সক্রিয় করতে পারি? সে কি রাতারাতি মানুষে পরিণত হবে? না। তার এই জেনেটিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্কসহ শরীরের সকল অঙ্গে সঞ্চারিত হতে কয়েক সহস্র প্রজন্ম পার করা লাগতে পারে। যেমন তাদের স্বরযন্ত্র পরিবর্তিত হয়ে মানুষের মতো হতে লক্ষ বছর লেগে যাবে। ধরা যাক, একদল শিশু শিম্পাঞ্জির শরীরে FOXP2 প্রবেশ করানো হলো। তাদের আলাদা করে একটা জঙ্গলে রেখে আসা হলো। আরও ধরে নেওয়া যাক যে তাদের শরীরে সংযোজিত জিন প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া জিনের মতো কাজ করছে। সেক্ষেত্রে মোটামুটি লাখ খানেক বছরের মধ্যে তারা মানুষের সমান বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পারে।

এর বিপরীতটা কল্পনা করা যাক: একদল শিশুর শরীর থেকে FOXP2 অপসারণ করে তাদের জঙ্গলে রেখে আসা হলো। তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো যদি এক লাখ বছর টিকে যায় তাহলে তাদের শারিরীক গঠন ছাড়া বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো শিম্পাঞ্জির মতো হবে। আর শরীরে লোম গজিয়ে পুরোপুরি শিম্পাঞ্জি হয়ে যেতে তারা হয়তো সময় নেবে মিলিয়ন বছর। তাদের ঈশ্বর চিন্তা, সাহিত্য-শিল্পকলা ও কল্পনাশক্তি বিলুপ্ত হবে। বিষয়টার উপযুক্ত উদাহরণ নেই; তাই একটা অসম উদাহরণ থেকে সেটা বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, অস্ত্রোপচার করে আমার মস্তিষ্কের সক্রিয় কোষের ৫০% কে এমনভাবে নিষ্ক্রিয় করা হলো যাতে তা বাকি ৫০% কে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। ধরে নিতে হবে আমাদের মস্তিষ্কের যে কোষগুলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের দলে নেই। সেক্ষেত্রে জ্ঞান ফেরার ঠিক পরের মুহূর্ত থেকেই আমার বুদ্ধির স্তর একটা বানর, হাতি বা ডলফিনের স্তরে নেমে আসবে। যদি ৯০% কোষকে নিষ্ক্রিয় করা হয়ে তাহলে আমার বুদ্ধি ছাগল, প্রজাপতি বা ইলিশ মাছের মতো হয়ে যাবে। মানুষের শরীর নিয়ে বসবাস করতে থাকলেও আমি তখন প্রার্থনা করতে, গান গাইতে, ছবি আঁকতে বা বিশ্বকাপ ফুটবলের চিত্তচাঞ্চল্য উৎপাদনকারী ম্যাচগুলো দেখতে উৎসাহী হবো না। আমার ইচ্ছাগুলো হবে ছাগল, প্রজাপতি বা ইলিশ মাছের মতো। এই অনুকল্পের কাছাকাছি উদাহরণ হলো পাগল ও মানসিক প্রতিবন্ধী। এ’ধরণের মানুষদের মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তবে আমাদের কল্পিত ঘটনার মতো বেছে বেছে শুধু বৌদ্ধিক আচরণের জন্য দায়ীগুলো নয়। ফলে তারা কিছু মাত্রায় মানবীয়ও থেকে যায়। নিম্ন বুদ্ধির প্রাণিদের মতো আচরণ করে না।

গোবেকলি তেপে, তুরস্ক

উপরের দুই অনুচ্ছেদ থেকে অন্তত এতটুকু বোঝা গেলো যে প্রার্থনার ইচ্ছা তৈরি হবার ক্ষেত্রে দায়ী আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ এবং তা থেকে উদ্ভূত প্রশান্তিময় জীবনের এবং অনন্ত ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা। প্রার্থনার উৎস যদি শুধু আকাঙ্ক্ষা হয়ে থাকে তাহলে আমরা পার্থিব ফল পাই কেনো? এটা হয়তো আমাদের একটা ভ্রান্ত বীক্ষণ। ধরুন, আপনি চাকরিতে পদোন্নতির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং পদোন্নতি পেলেন। আপনার মনে হবে এটা প্রার্থনার ফল। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, আপনি প্রার্থনাটা করেছেন আপনার পদোন্নতি আসন্ন হলে। আপনি চাকরিতে যোগদানের পরদিন প্রার্থনা করে পদোন্নতি পেলে সেটাকে প্রার্থনার ফল বলতে পারা যেতো। অথবা ফেল করার মতো খারাপ পরীক্ষা দিয়ে প্রাণান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে প্রথম বিভাগে পাশ করা গেলে সেটাকে আমরা প্রার্থনার ফল বলতে পারতাম। তাহলে প্রার্থনায় প্রশান্তি পাই কেনো? এটা আসলে একটা আত্ম-প্রবোধন বা অভিভাবন। আমরা যখন কোনো মহাশক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করি তখন আমাদের নৈবেদ্য-নিবেদন-হোম-অর্ঘ্য তাঁর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বলে মনে করি। এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি, যেহেতু তিনি মহান তিনি আমাদের জন্য ভালো কিছু করবেন। এই আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের মনে প্রশান্তিময় স্থিরতা নিয়ে আসে। ধরুন, আপনার বাড়ির জমিজমা কিছু দুষ্কৃতকারী দখল করে নিয়েছে। আপনি এই সমস্যার বিস্তারিত লিখে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটা চিঠি লিখলেন। চিঠিটি পোস্ট করার পর আপনার কিছুটা নির্ভার লাগতে থাকবে। চিঠিটা প্রাপকের হাতে পৌঁছাবে কিনা অথবা পৌঁছালে কোনো কাজ হবে কিনা ততদূর না ভেবেই কিন্তু আপনি শান্তি পাচ্ছেন।

যারা প্রার্থনা করে এবং যারা করে না, সচ্ছলতা, বিত্ত-বৈভব বা অন্য পার্থিব সফলতার হিসেব করলে উভয় গোষ্ঠীর প্রাপ্তি সমান। কিন্তু মানসিক প্রশান্তিকে হিসেবে নিলে যারা প্রার্থনা করে তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায়। প্রার্থনা আসলে একটা মনঃসংযোগ। আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু অপূর্ণতার মধ্যে বাস করি। সংকটগুলো সমাধানের জন্য আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো চেতন বা অবচেতনভাবে ব্যস্ত থাকে। এই অনুভূতি তাদের জন্য অস্বচ্ছন্দ ও ক্লান্তিকর। কেউ যখন খুব গভীর অভিনিবেশ সহকারে প্রার্থনা করে এবং সংকট সমাধানের সকল দায়িত্ব ঊর্ধ্বলোকে কোনো মহাশক্তির কাছে প্রেরণ করে তখন কোষগুলো কিছু কষ্টকর কাজ থেকে নিষ্কৃতি পায়। বার্তাটি তারা স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের অনুভূতির সকল কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। ফলে অনিশ্চয়তার উত্তেজনা কমে গিয়ে শরীরে শৈথিল্য আসে; এবং অজ্ঞাত নির্ভরতা ও সম্ভাব্য প্রাপ্তির আশা তাকে মানসিকভাবে উজ্জীবীত করে। জ্বর হলে আমরা মাথায় পানি ঢালি। ঠান্ডা পানি শরীরের তাপ শোষণ করে নেয়। এতে আমরা আরাম বোধ করি। প্রার্থনাও এই শীতল জলের মতো আমাদের নিউরোন সেলে থাকা প্রদাহগুলোকে শুষে নেয়। দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদের ধর্ম তত্ত¡ মেনে প্রার্থনার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে চাইলে অন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যদিও সেটা কিছু মাত্রায় নেতিবাচক। আমাদের শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে আমরা সেখানে বরফ চেপে ধরি। এতে জায়গাটি বোধ শক্তি হারায় এবং আমরা ব্যথার অনুভূতি থেকে রক্ষা পাই। প্রার্থনা ঐ বরফের টুকরার মতো যা আমাদের অন্তহীন কষ্টের অনুভূতিকে অসাড় ও অক্রিয় করে দেয়। এবং ক্ষত না সারলেও আমরা নিষ্কৃতির অনুভূতি পাই (পাঠক হয়তো আফিমের গন্ধ পাচ্ছেন!)।

এলেক্সিস কেরেল তার দ্য সিক্রেট অব প্রেয়ার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন প্রার্থনা কীভাবে কাজ করে। তিনি লিখেছেন, “প্রার্থনা কেবল পুজা নয়; এটা এক অদৃশ্য ভক্তি উদ্দীপনা যা মানুষের হৃদয়ে ও শরীরে শক্তির সঞ্চার করে এবং দেহের অন্তক্ষর গ্রন্থিগুলোকে জাগ্রত, সুশৃঙ্খল ও পীড়ামুক্ত করে।” যে কোনো শৃঙ্খলা-ই পীড়নের বিপরীত। বাংলা ভাষায় ‘মাথা গরম করা’ বলে একটা বাগধারা প্রচলিত আছে। আমরা সব সময় কিছু অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে বসবাস করি। সেটা হতে পারে সংকটের সমাধান বা আকাঙ্ক্ষা পূরণ। মস্তিষ্কের কোষগুলো সমাধান বের করতে সর্বদা ব্যস্ত সময় কাটায়। সংকট বা আকাক্সক্ষা বেশি গভীর হলে এদের ক্রিয়াকর্ম বৃদ্ধি পায়। প্রার্থনার মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব যখন আমরা ঊর্ধ্বলোকে প্রেরণ করি তখন মস্তিষ্কের কোষদের কাজের বোঝা লাঘব হয়, তারা শান্ত হয় এবং আমাদের জন্য শান্তির অনুভূতি তৈরি করে।

মানুষ বুদ্ধিমান হবার সময় থেকেই অনানুষ্ঠানিক ও প্রাকৃতিক ধরণের কিছু প্রার্থনা শুরু করেছে। হোমো সেপিয়েন্সদের আগে আরও একটা মানব জাতির উদ্ভব ঘটেছিল। তাদের নাম নিয়ানডার্থাল। এ’ব্যাপারে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন নিয়ানডার্থালরা সেপিয়েন্সদের পূর্ব পুরুষ। আসলে নিয়ানডার্থাল মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রজাতি যারা প্লাইস্টোনিক যুগে (৬০০,০০০ – ৩৫০,০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলে বাস করতো। মাত্র ৩০ হাজার বছর আগে ইউরোপে এই প্রজাতিটির পরিপূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। গুহা চিত্র সহ বিভিন্ন প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে তারা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান, যেমন সূর্য, চাঁদ, পর্বত, হ্রদ এবং নিজেদের তৈরি প্রস্তর মূর্তির পুজা করতো। (তারা টিকে থাকলে পৃথিবীতে দু’টি মানব প্রজাতি বাস করতো। একই রকম বুদ্ধিমান দু’টি প্রাণি প্রজাতির উপস্থিতিতে পৃথিবীর অবস্থাটা কেমন হতো একবার ভেবে দেখুন!) মধ্য ও নি¤œ প্যালিলিথিক যুগে আমাদের আদি পুরুষরাও (সেপিয়েন্স) কিছু মাত্রায় ধর্মাচারে নিয়োজিত ছিলো। নি¤œ প্যালিলিথিক যুগে (মোটামুটি ৩ লাখ বছর আগে) আফ্রিকায় পাওয়া নিদর্শনগুলোর মধ্যে সিংহের মতো দেখতে মানুষ, শুক্রের মূর্তি এবং পাখাওয়ালা ঘোড়া বন্দনার খোদাইকৃত গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। উনিশ শতকের দুই প্রখ্যাত গবেষক এডওয়ার্ড বার্নেট এবং হার্বার্ট স্পেন্সার প্রাণি পুজার এই প্রথাকে নাম দিয়েছেন ‘অ্যানিমিজম’। প্রতœতত্ত¡বিদ জন লুবক নাম দিয়েছিলেন, ডিইটিজম (প্রতিমাবাদ)। মেসোপটেমীয় মহাকাব্য গিলগামেশে গিলগামেশের দেখা একটা স্বপ্ন ছিলো এরকম:

“আকাশ গর্জনে গর্জে উঠল এবং পৃথিবী কেঁপে উঠল,
তারপর এসেছিল অন্ধকার এবং মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা।
বজ্রপাত মাটিকে ভেঙে ফেলে এবং আগুন জ্বলে ওঠে;
আকাশ থেকে মরণ প্লাবিত।
যখন তাপ মারা গেল এবং আগুন নিভে গেল,
সমতলভূমি ছাই হয়ে গিয়েছিল।”

এরপর গিলগামেশ পরের রাতে স্বপ্ন দেখেন যে তিনি একটি দুর্দান্ত ষাঁড়ের সাথে কুস্তি করছেন যা তার নিঃশ্বাস দিয়ে ভূমিকে বিদীর্ণ করছে। এনকুডু (গিলগামেশের বন্ধু ও উরুক রাজা) গিলগামেশের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেন; স্বপ্নের অর্থ হলো, সূর্য দেবতা শামাস (যিনি ন্যায়বিচারের প্রতীক) ষাঁড়কে দিয়ে গিলগামেশকে রক্ষা করবেন। এভাবে যুগে যুগে মানুষ প্রার্থনার জন্য অজানা শক্তির প্রতীক-প্রতিভূ-প্রতিনিধি নির্মাণ করে এসেছে।

Archaeology Magazine (নভে.-ডিসে. ২০০৮, পৃষ্ঠা – ২৩) “The World’s First Temple” শিরোনামে একটা আর্টিকেলে তথ্য দিয়েছে, ‘গোবেকলি তেপে’ হলো তুরস্কের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রত্নক্ষেত্র। এটি-ই পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম ধর্মীয় স্থান এবং সর্ববৃহৎ মেগালিথ (প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্মৃতিস্তম্ভাদিতে ব্যবহৃত প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড)। কেন্দ্রে অবস্থিত প্রধান স্তম্ভের উচ্চতা ৪৯ ফুট – প্রায় ৫ তলা বিল্ডিং এর সমান। উপাসনালয়টির ব্যাস ৩০০ মিটার – তিনটি ফুটবল মাঠের দৈর্ঘ্যের প্রায় সমান। নির্মাণ শৈলী থেকে প্রতœতাত্তি¡করা অনুমান করেন যে কেন্দ্রে অবস্থিত প্রধান স্তম্ভটিকে ঘিরে আরাধনা করা হতো। এর বাইরে ২০টি বৃত্তে ২০০টিরও বেশি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে। যেগুলোর উচ্চতা ২০ ফুট এবং গড় ওজন ১০ টন; নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়।

শুধু প্রার্থনা করার জন্য এরকম একটা স্থাপনা তৈরির কাজে সে’সময়ের সীমিত সামর্থ্যের মানুষেরা বিপুল সম্পদ, সময়, প্রযুক্তি ব্যয় করেছিল। তার অর্থ মানুষের প্রার্থনার আকাঙ্ক্ষা প্রাগৈতিহাসিক অথবা চিরায়ত। কোনো আরোপিত আনুষ্ঠানিক আদেশ বা দৈব বাণী থেকে এর সূত্রপাত হয়নি। সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রস্তর যুগের গুহাবাসী প্রত্যেক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজেদের আলাদা প্রার্থনার কেন্দ্র (যেমন, অগ্নিকুণ্ড, বৃহৎ বৃক্ষ, হ্রদ, পশু, পাহাড়) ছিলো। আমরা আগের বাক্যে অনুমান প্রকাশ করেছি যে প্রার্থনার আকাঙ্ক্ষা চিরায়ত, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতঃপ্রবৃত্ত। তবে মানব সমাজের জন্য এটা একটা অপরিহার্য উপাদান কিনা তা পরিপার্শ্বের ফলাফল থেকে বুঝতে পারা কঠিন। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান তিনটি দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ এলাকা। এই অঞ্চলের খুব কম মানুষ প্রার্থনা করে। অন্যদিকে প্রার্থনায় বেশি সময় ব্যয় করা অঞ্চলের মানুষেরা গড়ে বেশি অরাজকতার মধ্যে বাস করে। সমাজ বিজ্ঞানীরা এই ধাঁধার একটা ভালো ব্যাখ্যা হয়তো দিতে পারবেন। আমরা অন্য একটা ছোট ধাঁধা তৈরি করে লেখাটা শেষ করি:

মিম ও মৌ সহোদরা। তারা এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছে। মিম প্রতিদিন অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম, যবের শিষ, বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল, দধিকরম্ব নিবেদন করে সরস্বতীর পূজা করে এবং পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে অনুনয় করে। মৌ এসবের কিছুই করে না। ফলাফল প্রকাশিত হবার পর দেখা গেলো দু’জন-ই ফেল করেছে। পরের বার পরীক্ষা দিয়ে দু’জন-ই পাশ করলো। প্রশ্ন হলো, এই দুই জনের মধ্যে কার বেশি লাভ হলো? উত্তর- ১। মৌ পুজা না করে সময়টাকে অন্য কাজে বা বিনোদনে ব্যয় করেছে। বাকি অর্জন মিমের সমান। ফলে সে বেশি লাভবান। উত্তর -২। মিম পরীক্ষা থেকে ফলাফল প্রকাশিত হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এক ধরণের মানসিক প্রশান্তিতে ছিলো। বাকি অর্জন মৌ এর সমান। ফলে তার লাভের পরিমাণ বেশি। আপনি কোন উত্তরের পক্ষে?
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা