হাসান গোর্কি : রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো ফলাফল নির্ধারিত হচ্ছে না কেনো? কারণ হলো রাশিয়া জয় চাচ্ছে না; আর ইউক্রেন জয় পাবার মতো শক্তিধর নয়। কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও ব্যাপারটা এ’রকম-ই। পৃথিবীর দ্বিতীয় সামরিক শক্তি রাশিয়া, ইউক্রেন দখল করে নিতে পারে যদি তারা তাদের অত্যাধুনিক সমর প্রযুক্তি ব্যবহার করে। হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্র, চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান এবং প্রায় অপ্রতিরোধ্য আর্টিলারি ব্যবহার না করে রাশিয়া এ পর্যন্ত পুরো যুদ্ধে ব্যবহার করে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেঁচে যাওয়া পুরনো অস্ত্রপাতি। তারা এখনও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। আক্রমণ শুরুর সময় তারা এটাকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নাম দিয়েছিল। এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জয়-পরাজয় নির্ধারিত না হবার কারণ। যুদ্ধ শুরুর ৪ দিনের মাথায় রাশিয়ার ৭০ কিলোমিটার লম্বা ট্যাঙ্ক বহর যখন কিয়েভের উপকন্ঠে পৌঁছে গেলো তখন অজ্ঞাত বাঙ্কার থেকে বিবৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছিলেন, “আগামী ৭২ ঘন্টা খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ।” সবার ধারণা ছিলো রাশিয়া এ’রকম সময়ের মধ্যে কিয়েভ দখল করে নেবে। কিন্তু ঐ ট্যাঙ্ক বহর রহস্যময় কারণে কয়েকদিন দাঁড়িয়ে থেকে ফেরত গেলো। বিশ্ব-গণমাধ্যম ও সমর- বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার এই অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি। সে’সময় নিউইয়র্ক টাইমস এর নিচের সাড়ির কলামিস্ট ফরহাদ মনজো লিখেছিলেন, “আসলে এটা ছিলো রাশিয়ার একটা কৌশল। তারা তাদের মূল লক্ষ্য (দনবাস দখল) আড়াল করে প্রতিপক্ষের মনোযোগ অন্যখানে নিয়ে যাওয়া এবং পুরো ইউক্রেন জুড়ে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশলীতা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।” ফরহাদ কম খ্যাতিমান (গ ক্যাটাগরি) কলামিস্ট। এতদিনে এসে তার সেই ব্যাখ্যা লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কিয়েভ দখল করে নিলে রাশিয়ার কাঁধে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র দখল করে নেওয়ার অভিযোগ চাপতো। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সে দখল টিকিয়ে রাখা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যাটা কম ছিলো। কারণ এই ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়ে বিতর্ক ছিলো।

এবারের অভিযানে রাশিয়ার মূল লক্ষ্য ছিলো দু’টি উর্বর কৃষি জমি ও খনিজ সম্পদে পূর্ণ দনবাস অঞ্চলকে নিজ ভূখণ্ডের সাথে একীভূত করা এবং এই আগ্রাসী ভূমিকার মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে নিজ ভূখণ্ডে প্রশ্রয় দেওয়া ইউক্রেনের মতো বিপদজনক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এই লক্ষ্য দু’টির প্রথমটি প্রাথমিকভাবে অর্জিত হয়েছে। রাশিয়া চাচ্ছে চলমান যুদ্ধ কয়েক বছর প্রলম্বিত করতে। তাতে এক সময় ইউক্রেন নিজের থেকে দনবাসের অধিকার ছেড়ে দিয়ে আপস করতে চাইতে পারে। যুদ্ধ প্রলম্বিত করার অন্য কারণ ‘দ্বিতীয় লক্ষ্য’ অর্জন করা। পশ্চিম ইউরোপে ন্যাটো সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র মোতায়েন করতে গিয়ে ইউক্রেনের মতো পরিণতির কথা ভাবতে বাধ্য হবে।

আজ থেকে তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে একক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের। ওয়ারশ জোট ভেঙে যাবার বিপরীতে স¤প্রসারিত হয়েছে ন্যাটো। সাবেক কম্যুনিস্ট দেশ হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক; এমনকি সোভিয়েত ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসা ইস্তনিয়া, লিথুনিয়া, লাটভিয়াও ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। সংস্থাটির মোট সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৩০। ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং ইউক্রেনের সদস্যপদ লাভের প্রক্রিয়া ন্যাটোর বিবেচনাধীন আছে। ট্রাম্প নির্বাচিত হবার আগে বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি নির্বাচিত হলে ন্যাটো জোটে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে ফেলার বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাববেন। তার বক্তব্য ছিল এই সামরিক জোটের খরচ যোগাতে যুক্তরাষ্ট্র অন্য সদস্যদের তুলনায় যুক্তিহীনভাবে অনেক বেশি টাকা খরচ করছে। জয়ী হওয়ার পরও মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটকে ‘বাতিল’ ও ‘সেকেলে’ বলে এর সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরপর-ই ব্রাসেলস এ ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বৈঠকে ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র একা কেনো ন্যাটোর মোট খরচের এক চতুর্থাংশ বহন করবে! বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি ও সামরিক দর্শন আবার বদলে গেছে। ফলে রাশিয়াকেও তা মোকাবিলায় মনোযোগ দিতে হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ আসলে কোনো আঞ্চলিক সংঘাত নয়; দুই পরাশক্তির আধিপত্যের লড়াইয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া রাশিয়ার পক্ষ থেকে মরিয়া প্রতিক্রিয়া। স্মরণ করুন পুতিনের বক্তব্য — “যে পৃথিবীতে রাশিয়ার জায়গা হয় না, সে পৃথিবী থাকার দরকার কী!”
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে ন্যাটো পৃথিবীর কোথাও কোনো সামরিক অভিযান চালায়নি। অপেক্ষা করেছে চার দশক, ওয়ারশ জোট ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত। অপারেশন এঙ্কর গার্ড নামে তাদের প্রথম অভিযান শুরু হয়েছিল ইরাকের বিরুদ্ধে, দেশটি ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে যখন কুয়েত আক্রমন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে না গেলেও তার ভাঙন প্রক্রিয়া ততদিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে; ওয়ারশ জোটও তখন রয়েছে অবশ্যম্ভাবী বিলুপ্তির পথে। এর পরের ইতিহাস বড়ই মসৃণ। বসনিয়া হার্জেগোভিনা (১৯৯৩), কসোভো (১৯৯৯), আফগানিস্তান (২০০১), সোমালিয়া (২০০৯) এবং লিবিয়াতে (২০১১) পর্যায়ক্রমে সফল সামরিক অভিযান চালায় ন্যাটো। সবগুলো অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ছিল নিরঙ্কুশ; যেখানে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র প্রতীকী অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামরিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দান করেছে মাত্র। লক্ষণীয় বিষয় হল নিরাপত্তা পরিষদ থেকে এই অভিযানগুলোর অনুমতি সংগ্রহ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে একটুও বেগ পেতে হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিতে যে পার্থক্য তৈরি হয়েছিল তা বিগত কয়েক বছরে আরও কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগ্রহে থাকা পরমাণু অস্ত্র এবং আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের হিসেবে দুই পরাশক্তির শক্তির মোটামুটি একটা ভারসাম্য টিকে থাকলেও প্রচলিত অস্ত্রের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে তার প্রধান প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে বিমান এবং নৌ শক্তিতে অত্যাধুনিক কৌশলগত সক্ষমতা সংযোজনের ফলে পার্থক্যটা বেড়ে গেছে অনেকখানি।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল মার্কিন একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার দিন সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে; হয়তো এ বাস্তবতা টিকে থাকবে আগামী কয়েক দশক। রাষ্ট্রনীতি বিশারদদের বেশিরভাগ ধরেই নিয়েছিলেন একুশ শতক হবে মার্কিন প্রভাব বলয়ের স¤প্রসারণ-শতাব্দী। কিন্তু সে ধারণা ধীর গতিতে হলেও পাল্টাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের হিসেব অনুযায়ী ২০.৮৯ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি নিয়ে চীনের (১৪.৭২ ট্রিলিয়ন) তুলনায় এগিয়ে থাকলেও, ২০৩০ সালের মধ্যেই চীন এক নম্বরে চলে যাবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। চীনের আভ্যন্তরীণ বাজার স¤প্রসারণের বর্তমান হার বজায় থাকলে এর ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্য ইতিহাসে প্রথমবারের মত পদানত হবে এমন একটা দেশের কাছে যারা মাত্র অর্ধ শতাব্দী কাল আগেই দরিদ্রদের কাতারে ছিল। আর সোভিয়েত পরবর্তী যুগে মার্কিনীদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রথমবারের মত চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছিল ক্রিমিয়া ইস্যুতে। কোনরকম কার্যকর বিরোধিতা ছাড়াই রাশিয়ার সাথে ক্রিমিয়ার একীভবন মেনে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যরা (যদিও রাশিয়া এই ভূখণ্ডের সাথে তার অভেদত্ব-প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যুক্তি দিতে পারেনি)। তাদের নমনীয় ভূমিকাকে প্রলেপ দিয়ে আড়াল করার জন্য বলা হয়েছিল, এই আগ্রাসনের জন্যে রাশিয়াকে চরম মূল্য দিতে হবে। কিন্তু কোনো মূল্য দেওয়া ছাড়াই কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটিকে রাশিয়া তার অংশ বানিয়ে ফেলেছে। ক্রিমিয়ার একীভবন ছিলো শীতল যুদ্ধ পরবর্তী যুগে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত।

আমাদের মনে থাকার কথা রাশিয়ার সাথে ক্রিমিয়ার একীভূত হবার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফলও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখকর হয়নি। পক্ষে ৯৯টি ভোট পড়লেও চীন ও ভারতের মত গুরুত্বপূর্ণ দেশ সহ ৫৮টি দেশ ভোট দানে বিরত থেকেছে। সরাসরি বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ১১টি দেশ। বাকি দেশগুলো অনুপস্থিত ছিল। এ প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে গিয়ে টেলিগ্রাফের কলামিস্ট বেনেডিক্ট ব্রগান ‘রাশিয়া এন্ডস হাইবারনেশন এরা’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, “যে ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্র ভোট দানে বিরত থেকেছে তারা আসলে রাশিয়াকে সরাসরি সমর্থন করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। কিন্তু অচিরেই এই অবস্থার অবসান হবে- কারণ রাশিয়া তার শীতনিদ্রা ত্যাগ করেছে।” যুক্তরাষ্ট্রের সা¤প্রতিক নমনীয়তার আরও কিছু উদাহরণ আছে। ইউরোপ ও আমেরিকা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরাপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে ছিল। অবরোধে কাজ না হলে শক্তি প্রয়োগের বিকল্পও তারা মাথায় রেখেছিল। কিন্তু তারা রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বরং ইরান-ছয় জাতি চুক্তির মাধ্যমে যেভাবে সংকটের সমাধান করা হয়েছে সেটাকে ইরানের স্বার্থের অনুক‚লে বললেও বেশি বলা হবে না। সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র আসাদকে সরিয়ে দেওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে সিরিয়া সংকটে যুক্ত হয়েছিল সেটা অর্জন করতে পারেনি আসাদের পক্ষে রাশিয়ার অবস্থানের কারণে।

তাহলে কি বিশ্ব নতুন মেরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? যদি তা-ই হয় তাহলে কেমন হবে সেই মেরুকরণ? দু’টি-ই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও চীনের সাথে রাশিয়ার বন্ধুত্ত¡ কখনও খুব গভীর পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আবার সেই অর্থে তেমন বৈরিতাও কখনও ছিল না। তবে সংকটের সময় চীন রাশিয়ার পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। ১৯৬২ সালে কিউবা মিসাইল ক্রাইসিসে চীন প্রকাশ্যেই রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করেছিল; সোভিয়েত ইউনিয়নকে হুমকি দিয়ে রেডিওতে কেনেডির ভাষণ (২৩ অক্টোবর, ‘৬২) প্রচারিত হবার পর পিপলস ডেইলি শিরোনাম করেছিল, “৬৫ কোটি চীনা নরনারী কিউবার পাশে আছে।” এবারের ইউক্রেন ইস্যুতে তারা অনেকটা দৃষ্টিকটুভাবে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে সম্ভাব্য বড় কোনো বৈশ্বিক বৈরিতায় তারা রাশিয়ার পাশে থাকবে, এমনকি সেটা যদি কিছু মাত্রায় নীতি- বিগর্হিতও হয়। এর কারণ, চীনের নিজেরও কিছু সমস্যা আছে। তাইওয়ানকে চীন বরাবরই নিজ ভূখণ্ড বলে মনে করলেও যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো বিরোধিতার কারণে চীন বেশিদূর অগ্রসর হবার চিন্তা থেকে দীর্ঘদিন বিরত থেকেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে আরও এগিয়ে গেলে তাইওয়ান ইস্যুটি তারা নতুন করে ভাবতে পারে। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পিপলস ডেইলির এক জরিপে দেখা গিয়েছিল বেশিরভাগ চীনা নাগরিক মনে করে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের উচিত সামরিক ব্যাবস্থা গ্রহন করা। সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে সৃষ্ট সংকটে চীনের ভূমিকা থেকে এটা অনুমান করা দোষের নয় যে চীনও তার খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে বিস্ময়কর নমনীয় এবং যৌক্তিক আচরণ করেছে। ২০১৬ সালে চীন পূর্ব চীন সাগরকে উড্ডয়ন প্রতিরক্ষা সনাক্তকরণ এলাকা ঘোষণা করে পরোক্ষভাবে সেন কাকুর ওপর তার অধিকার পাকাপোক্ত করার উদ্যোগ নিলেও যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে বড় ধরণের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; যদিও জাপানের সাথে বিরাজমান সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রতি সন্মান দেখিয়ে শুরুতে বার দুই ঐ এলাকায় সামরিক বিমান পাঠিয়েছিল। এখনও তারা কিছু সামরিক বেসামরিক নজরদারি ধরে রেখেছে। তবে আখেরে চীনকে যে ছাড় দেওয়ার নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হচ্ছে সেটা মোটামুটি স্পষ্ট।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে একীভূত করার প্রস্তাব রাশিয়ান পার্লামেন্ট দ্যুমায় পাশ হবার প্রায় সাথে সাথেই পুতিন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহনকে ফোন করেছিলেন। ভাল ফলাফলও পেয়েছেন; সাধারণ পরিষদে ভোট দানে বিরত থাকার পাশাপাশি রাশিয়ার বিপক্ষে যে কোনো ধরণের অবরোধ মানবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল ভারত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রও ভারত প্রায় মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। যতদূর জানা যায় ভারতকে পরমাণু বোমা হামলার ভয়ও দেখিয়ে নিক্সনের পাঠানো একটা বার্তাও পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধির কাছে। এ পরিস্থিতিতে যদি পৃথিবীর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সামরিক শক্তি- রাশিয়া-চীন-ভারত কেন্দ্রিক একটা সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বলয় গড়ে ওঠে তাহলে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তাই মার্কিন নীতি নির্ধারকরা এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে দিতে আপাতত রাজি নন যা পৃথিবীতে নতুন শক্তি বলয় গড়ে ওঠাকে উৎসাহিত করে। সে কারণেই দফায় দফায় তাদের পিছু হটা। তবে এ পরিস্থিতি কতদিন চলতে থাকবে সেটা অনেকখানি নির্ভর করছে সদ্য শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠা রাশিয়া নিকট ভবিষ্যতে তার রাজনৈতিক-সামরিক প্রভাব স¤প্রসারণের নতুন কোনো উদ্যোগ নেয় কিনা তার ওপর। ইউক্রেন আক্রমণ রাশিয়ার সে’রকম একটা উদ্যোগ বলে অনুমান করা চলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত পাঁচ কোটি মানুষের দুই কোটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। স্ট্যালিনগ্রাদ, কুরস্ক বা মস্কো যুদ্ধের ডকুমেন্টারি যারা দেখেছেন তারা জাতি হিসেবে রাশিয়ানদের সজাত্যাভিমানের বিষয়ে ধারণা রাখেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে জিঙ্গইস্টিক জাতি হিসেবে জার্মানরা পরিচিত। এ অভিধাটি আসলে রাশানদের প্রাপ্য ছিল। অশ্বারোহী পুতিন কথা কম বলেন। কিন্তু তার কাজকর্ম থেমে নাই। তার দৃষ্টি শীত নিদ্রায় থাকা মেরু ভল্লুকের মত শীতল কিন্তু লক্ষ্যাভিমুখী। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ডের স্বপ্ন দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে যেতে পারে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। আবার একটা শীতল যুদ্ধ শুরুর লক্ষণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। সেটা হয়তো শুরুও হয়ে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে। রাশিয়া চায় একটা অরাজক পরিস্থিতি প্রলম্বিত করতে যাতে বিশ্বে স্পষ্ট রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাও কিছুটা সে’রকম। তারাও চায় ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান থাকুক এবং উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকুক। এতে করে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো বেশি করে ন্যাটোর কাছে আশ্রয় নেবে এবং রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ঘনিষ্ঠ হবে। এ’রকম হবার সম্ভাবনা আছে। তবে এর বিপরীত কিছু ঘটার সম্ভাবনা-ই বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে এই অর্বাচীনের একটা ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক— রাশিয়া যুদ্ধটা শেষ করবে না; বিভিন্ন অজুহাত খুঁজে আরও কয়েক বছর টেনে নেবে, যাতে ইউরোপ জুড়ে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা টিকে থাকে এবং ইউরোপের দেশগুলো একসময় অনুধাবন করে যে রাশিয়ার সাথে সামরিক বৈরিতা তাদের জন্য লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে, যা ন্যাটোতে তাদের সক্রিয়তাকে নিরুৎসাহিত করবে।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা