ফরিদ আহমেদ : ১৫৯১ সালে ব্রুনো ছিলেন জার্মানিতে। ভেনিসের একজন অভিজাত ব্যক্তি জিওভানি মচেনিগো তাঁকে আমন্ত্রণ জানান ভেনিসে। এই আমন্ত্রণের পিছনে দু’টো কারণ ছিলো। এক, তিনি ব্রুনোর কাছ থেকে শিক্ষালাভ করতে চান। দুই, তিনি শুনেছিলেন যে পাদুয়া ইউনিভার্সিটিতে গণিত চেয়ারের পদ খালি রয়েছে। সেটার জন্য ব্রুনো চেষ্টা করতে পারেন।
ভদ্রলোককে পড়ানোর চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়ানোটা বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিলো ব্রুনোর কাছে। ফলে, তিনি প্রথমে পাদুয়াতে যান। গণিতের পদের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু, ব্যর্থ হন তিনি সেটা পেতে। পরের বছর ওই পদে গ্যালিলিও যোগ দিয়েছিলেন।
পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাখ্যাত হবার পরে তিনি ভেনিসে আসেন। সেটা ১৫৯২ সালের মার্চ মাস। জিওভানি মচেনিগোর ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তিনি। পড়ানোর মতো নিরীহ এই সিদ্ধান্তটা ভয়ংকর এক পরিণতি বয়ে আনে ব্রুনোর জীবনে।
মচেনিগোকে পড়ানোর সময়ে ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন অনেক কথাই তিনি তাঁকে বলে ফেলেছিলেন অসতর্ক অবস্থায়। হয়তো আলোচনা প্রসঙ্গেই বলেছিলেন। কিন্তু, সেগুলো মচেনিগোর অনুভূতিতে আঘাত হেনেছিলো। সেই আঘাতের কারণে শিক্ষক হিসাবে ব্রুনো যে সম্মান পাবার কথা ছিলো, সেটা তিনি তাঁকে দিতে অস্বীকৃতি জানান।ভেনেটিয়ান ইনকুইজিশনের কাছে গিয়ে তিনি ব্রুনোর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার নালিশ জানান। এর ফলাফল হিসাবে ব্রুনো গ্রেফতার হন মে মাসে।
১৫৯২ সালের বাকিটা সময় জুড়ে ভেনিসে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার চলতে থাকে। ব্রুনো দোষ স্বীকারের পরিবর্তে বিচারকদের সাথে তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন। বিচারকরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে তাঁর বিরুদ্ধে কী রায় দেবেন।
ব্রুনোর ধর্মদ্রোহিতার খবর রোমেও পৌঁছে গিয়েছিলো। রোমান ইনকুইজিশন থেকে ভেনেটিয়ান ইনকুইজিশনের কাছে বার বার চিঠি আসতে থাকে ব্রুনোকে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য। এর পিছনে যুক্তি দেখানো হয় যে ব্রুনো ভেনিসের লোক না, নেপলসের অধিবাসী। নেপলস এবং রোমে প্রচুর ধর্মদ্রোহিতামূলক কথাবার্তা সে অনেক আগেই বলেছে। কাজেই, রোমেই তার বিচার হওয়া দরকার।
ব্রুনোর মতো একজন অসম্ভব মেধাবী মানুষকে বিচার করার জন্য ভেনিসের ইনকুইজিশন এমনিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলো না। রোমের এই যুক্তি শুনে নিজেদের গা বাঁচাতে ব্রæনোকে রোমের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। হাতে পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় প্রথমে তাঁকে সমুদ্রপথে পাঠানো হয় আংকোনাতে। সেখান থেকে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রোমে। ১৫৯৩ সালের জানুয়ারি মাস সেটা।
রোমে একটা বদ্ধ এবং অন্ধকার সেলে আটকে রাখা হয় তাঁকে। তাঁর বিচার ঠিক কবে শুরু হয়েছিলো, সেটা বলা মুশকিল। বিচারের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটা ১৫৯৯ সালের জানুয়ারি মাসের। অর্থাৎ, রোমের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ছয় বছর কাটানোর পরে বিচার পর্ব শুরু হয় তাঁর।
১৬০০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের আট তারিখে ব্রুনোকে শেষবারের মতো সুযোগ দেওয়া হয় দোষ স্বীকারের। পনেরোজন কার্ডিনালের উপস্থিতিতে ব্রুনোকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়। ব্রুনো দোষ স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। কার্ডিনালরা তখন সেকুলার কোর্টের উপর ছেড়ে দেয় তাঁর বিচারের রায় ঘোষণার। একই দিনে বিচারকদের মুখোমুখি হন তিনি। নামেই সেটা সেকুলার কোর্ট ছিলো। রোমের গভর্নরের অফিস থেকে চাপ ছিলো ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারার। শুধু ব্রুনোকেই এই পৃথিবী থেকে মুছে দিতে হবে না, তাঁর সমস্ত কাজকেও মুছে দিতে হবে। বিচারকরা সেই রায়ই ঘোষণা করেন ধর্মদ্রোহীর বিরুদ্ধে। আদালতে শুধু রায় ঘোষণাই করা হয় না। প্রকাশ্যে ব্রুনোকে অপমান এবং অপদস্থও করা হয়। সবশেষে হয়তো সামান্য দয়া থেকেই জিজ্ঞেস করা হয় ব্রুনোর কিছু বলার আছে কিনা।
মেঝেতে পড়ে থাকা বিপন্ন, বিপর্যস্ত এবং চরমভাবে অপদস্থ ব্রুনো মাথা তুলে তাকিয়েছিলেন। সমস্ত রুমের উপরে চোখ বুলিয়েছিলেন তিনি। তারপর শক্তিশালী কণ্ঠে বলেছিলেন সেই অবিস্মরণীয় কথাটা, “দণ্ড পেতে আমি যতোটা না ভয় পাচ্ছি, আমাকে দণ্ড দিতে তার চেয়েও বেশি ভয় পাচ্ছেন আপনারা।”
ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখে বধ্যভূমি প্রস্তুত করা হয়। খুব সকালবেলা শৃঙ্খলিত ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে বধ্যভূমির দিকে। অতো সকালেও রাস্তায় মানুষের ভিড়ের কোনো অভাব ছিলো। নিউজ লেটার ছাপিয়ে জনগণকে আগেই জানানো হয়েছে যে ‘দারুণ একটা আগুনে পুড়িয়ে মারার বিচার হতে যাচ্ছে।’ ফলে, সেই দারুণ বিচার দেখার জন্য মানুষ উৎসবের আয়োজনে রাস্তার দুই পাশে জড়ো হয়েছে ব্যানার হাতে নিয়ে।
ব্রুনোকে বধ্যভূমির দিকে মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে। রাস্তার দুই পাশ থেকে অসংখ্য অপমানজনক বক্তব্য ভেসে আসতে থাকে। সেগুলো শুনেই হয়তো মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল ব্রুনোর। হাত-পা ছুড়ে তিনিও প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। সেটাকে বন্ধ করতে ব্রুনোর চিবুকের একপাশ দিয়ে লোহার স্পাইক গেঁথে দেওয়া হয়। আরেকটা স্পাইক ঠোঁট ভেদ করে নামিয়ে দেওয়া হয় আনুভূমিকভাবে। দু’টো স্পাইক ক্রশের আকার ধারণ করে। রক্তে ভেসে যেতে থাকে ব্রুনোর সমস্ত শরীর, কাপড়-চোপড়।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিছিল পৌঁছে যায় বধ্যভূমিতে। একটা মোটাসোটা কাঠের খুঁটি গাড়া হয়েছে সেখানে। সেই খুঁটির সাথে ব্রুনোকে শক্ত করে বাঁধা হয় দড়ি দিয়ে। তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাঁর গায়ে। এর মধ্যেও একজন দয়া করে এগিয়ে যান। বেচারা ঈশ্বরে অবিশ্বাস করে মারা যাচ্ছে, তাঁর আত্মা চিরকাল নরকের আগুনে জ্বলবে, সেটা থেকে মুক্তি দিতে আগুনের মধ্যেই ক্রশ নিয়ে ব্রুনোর দিকে এগিয়ে যান। ব্রুনো সেটা দেখে মাথা ঘুরিয়ে নেন। মৃত্যুর এতো কাছে এসেও মিথ্যার কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নন তিনি। আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যান তিনি। উল্লাসধ্বনিতে মেতে ওঠে দর্শকেরা।
ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার যে রায় হয়েছিলো, সেটা ব্যতিক্রমী কোনো রায় ছিলো না। আগুনে পুড়িয়ে হত্যার রায় অনেককেই দেওয়া হতো তখন। খুবই বর্বর একটা রায় ছিলো এটা। প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক এক দীর্ঘ মৃত্যু হতো আসামীদের। এই ধরনের রায় যাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হতো, তাদের আত্মীয়স্বজনরা সাধারণত ব্যাকুল হয়ে একটা কাজ করতো। সেটা হচ্ছে জল্লাদকে যথেষ্ট পরিমাণে ঘুষ দেওয়া।
জল্লাদকে ঘুষ দেওয়া হতো তাকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য নয়। বরং উল্টো কারণে দেওয়া হতো। আগুনে পোড়ার আগেই দণ্ডপ্রাপ্তকে হত্যা করার জন্য তারা জল্লাদকে অনুরোধ জানাতো। যাতে করে তাদের প্রিয়জন কম কষ্ট পেয়ে মারা যায়। এর জন্য তারা জল্লাদকে টাকা দিত। খুঁটিতে বাধার সময়ে জল্লাদ এবং তার সহযোগীরা হাতের মোচড় দিয়ে দণ্ডপ্রাপ্তের ঘাড় ভেঙে দিতো। ফলে, গায়ে আগুন লাগলেও দণ্ডপ্রাপ্ত আর আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা সইতো না।
ব্রুনোর ক্ষেত্রে এই কাজটা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আগুনে পোড়ার আগেই তাঁর মৃতু নিশ্চিত করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে, জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে দীর্ঘ এক কষ্টকর মৃত্যু তিনি বরণ করেছিলেন। আগুনে পোড়ার সময়েও তিনি ছিলেন দুর্বিনীত, সত্যের প্রতি অবিচল। ক্রশ এগিয়ে দিয়ে তাঁকে বলা হয়েছিলো ঈশ্বরের কাছে অনুশোচনা প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে। সেই প্রস্তাব তিনি আগুনে ঝলসাতে ঝলসাতেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আমাদের দেশে আগুনে পুড়িয়ে মারার ক্ষেত্রে আদালতের কোনো রায় না থাকলেও, আগুনে পুড়িয়ে মানুষকে হত্যার রেকর্ড কিন্তু আছে। সেই হত্যা করা হতো ধর্মের নামে। হিন্দুরা এক সময় বিধবা নারীদের সহমরণের নামে তাদের স্বামীর চিতায় তুলে দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারতো। সহমরণের জন্য ধর্মীয় এবং সামাজিক চাপ এতো বেশি প্রবল ছিলো যে নারীরা নিজেরাই সহমরণে যাবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতো। এদেরকে কেউ দয়া দেখিয়ে আগুনে পোড়ার আগেই মেরে ফেলতো না। জীবন্ত অবস্থাতেই তাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হতো। গায়ে আগুন লাগার পরেই স্বামীর প্রতি সুগভীর প্রেম কিংবা অন্ধ ধর্ম-ভক্তি এক নিমেষেই উবে যেতো তাদের। পাগলের মতো চিতা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করতো তারা। সেই সময়ে তাদের আত্মীয় স্বজন এবং পাড়া প্রতিবেশীরা বড় বড় বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কিংবা গুঁতিতে বাঁচতে চাওয়া সেই নারীকে চিতার মধ্যে আটকে রাখতো। মানুষের চেয়েও কাল্পনিক ধর্ম যখন মানুষের কাছে অনেক বড় হয়, তখন এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
আগুন নেভার পরেও তাঁর রেহাই মেলেনি ব্রæনোর। শরীরের যে সব অংশ পুড়ে একেবারে ছাই হয়নি, সেগুলোকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ছাতু করা হয়। সমস্ত ছাই এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ অংশগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে করে কেউ তা সংরক্ষণ করে রাখতে না পারে। এর মাধ্যমে ইনকুইজিশন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলো ব্রæনোর সামান্যতম অস্তিত্বও যেনো পৃথিবীতে না থাকে। ব্রুনো থাকবে না, তাঁর দেহ থাকবে না, তাঁর স্মৃতি থাকবে না, থাকবে না তাঁর কোনো চিন্তা-ভাবনা এবং কাজের অস্তিত্ব।
বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। ইনকুইজিশনের সেই সব লোকেরাই মুছে গিয়েছে ইতিহাস থেকে। ব্রুনো টিকে গিয়েছেন। শুধু টিকেই যাননি। পৃথিবীটাকে এক মহা মিথ্যা থেকে মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন তিনি। অমন সাহসিকতা তিনি না দেখালে আজও হয়তো আমরা বিশ্বাস করতাম যে পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-তারা সব ঘুরছে।