শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
বহু কষ্টে সুজির হাত ছাড়ানো হল, বেচারীর হাত লাল হয়ে গিয়েছে। ভিক্টোরিয়া তখনো কিছু বলে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টায় বোঝা গেল সে বলছে, “ঙ’ ঔবংঁং ফড়হ’ঃ ষবধাব সব.” সে ওই একই কথা বার বার বলে যাচ্ছে। আর থেকে থেকে মম মম বলে ডাকছে। খুব মায়া লাগল ওর অবস্থা দেখে। দূর্দান্ত ভিক্টোরিয়াকে কত আসহায় লাগছে এখন।
একটা জায়গায় আমরা ভীষণ আসহায়, আমরা জানিনা পরের মুহূর্তে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। আমি নিয়তি মানি কিন্তু নিজে চেষ্টা করে যাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। যেখানে একান্তই আমি আসহায় সেখানে নিয়তিকে মেনে নেয়া ছাড়া আর গতি থাকে না।
প্যারামেডিক্স চলে এল ঝটপট। এসে ভিক্টোরিয়াকে দেখে একজন অবাক হয়ে জানতে চাইলো ভিক্টোরিয়া এখন এখানে থাকে কিনা। নার্স সম্মতি জানালে, অন্যজন জানতে চাইল সে ভিক্টোরিয়াকে চেনে কিনা, প্রথম জন বলল যে সে ওকে খুব ভালভাবে চেনে কারণ মাসে অন্তত দু’বার কেউ ৯১১ কল করত যখন ভিক্টোরিয়া নিজের বাড়িতে থাকত। সে ভিক্টোরিয়ার কাছে মুখ নিয়ে জানতে চাইলো ওকে চেনে কিনা। ভিক্টোরিয়া ঘোলা চোখে চেয়ে রইলো, কিছু বলল না। ওরা সব কিছু চেক করে জানাল যে ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আরো কিছু চেকআপ করে কিছু স্যালাইন দিয়ে ওকে চাঙ্গা করে ১ সপ্তাহের মধ্যে ফেরত পাঠাবে, কোন স্ট্রোক কিছু করেনি, অনেক ডিহাইড্রেশন হয়েছে ওর। চট করে আমার চোখ গেল সুজি আর ফ্লোরার দিকে, ওদের চোখ ওলটানো দেখার মত ছিল। এত কিছুর মধ্যেও আমার ভীষণ হাসি পেল, আমি মুখ চেপে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। প্যারামেডিক্স ভিক্টোরিয়াকে প্যাকেট করে নিয়ে গেল কারণ যাবে না বলে ভীষণ হাতপা ছুঁড়ছিল আর চিৎকার করছিল সে। যাবার সময় প্রথমজন চোখ মটকে বলল, “গুডলাক”- আমরা সবাই বুঝলাম ও কি বলতে চাইছে। সাধারনত কোন রেসিডেন্ট হসপিটালে গেলে সবাই মন খারাপ করে কিন্তু ভিক্টোরিয়ার বেলায় হল উলটো, ফ্লোরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল যে এ সপ্তাহে তাকে কাজ ছাড়তে হবে না তাতেই সে খুশী, বলে দাত কেলিয়ে চলে গেল।
আমি ফ্লোরাকে বললাম রুমটা গুছিয়ে লক করে আমার কাছে চাবি দিতে। সুজিও নিজের জিনিসপত্র ঘুছিয়ে চলে গেল।
আমি একটু বাইরে বেড়িয়ে এলাম খোলা বাতাসের জন্য। গিয়ে দেখি ন্যান্সি আর জন হাত ধরে হাটছে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাই বলতেই ন্যান্সি এগিয়ে এসে আমাকে জনে সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। অনেক অনেক ভাল কথা বলল আমাকে নিয়ে, আমি সরাসরি নিজেকে নিয়ে এত ভাল কথা শুনতে অভ্যস্ত নই তাই বেশ লজ্জা পেলাম। ন্যান্সি জনকে বলল যে মা হতে যাচ্ছি, জন আমার হাত ধরে খুব করে একটা ঝাঁকি দিয়ে অভিনন্দন জানাল, সাথে এও বলযে আমার কথা ন্যান্সির কাছে অনেক শুনেছে।
আমি ধন্যবাদ দিয়ে ওদেরকেও অভিনন্দন জানালাম। জন হেসে বলল যে জীবনের এই প্রান্তে এসে যখন সে আর কোন সম্পর্ক বা ভালবাসা আশা করেনি ঠিক তখনই সব থেকে মধুরতম সম্পর্ক ওর জীবনে এসে হাজির। আমি একটু ফিলোসফিক্যাল হয়ে বলে ফেললাম, ‘জীবন একটা গোলকধাঁধার মত, কখন কি হয় বোঝা মুশকিল, ভালো খারাপ যেটাই হোক যুদ্ধ না করে হাসি মুখে মেনে নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়াই ভাল’। আরো বললাম যে, ‘এই ভালোবাসা প্রকৃতির পক্ষ থেকে তোমাদের দু’জনার জন্যই একটা উপহার। এনজয় কর’।
জন বলল, ন্যান্সি ঠিকই বলেছে তোমাকে নিয়ে মনিরা। তোমার মাঝে অনেক গভীরতা রয়েছে। কথাটা শুনে আমার জর্জের কথা মনে হল। সেও ঠিক একই কথা বলত আমাকে নিয়ে। বুকের মাঝে চিন চিন করে উঠল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ধন্যবাদ দিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম। বেরোবার সময় লাঞ্চ ব্যাগটা নিয়ে এসেছিলাম। বিন্ডিংয়ের পিছনদিকে গিয়ে আমার প্রিয় কর্নারে বসে লাঞ্চের ব্যাগটা খুললাম।
আজ কেন যেন খুব নস্টালজিক লাগছিল। ইউনিভার্সিটির কথা মনে এল। ঢাকা ইনিভার্সিটিতে আমার পড়ার কথাই ছিল না। বোনদের ইচ্ছা আমি ফিলোসফি নিয়ে ইডেন কলেজে পড়ি আর আমার ইচ্ছা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। আমি বান্ধবিদের সাথে গিয়ে চুপি চুপি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং খবর পেলাম এগারোশো ছাত্র-ছাত্রী যারা সুযোগ পেয়েছে আমি তাদের মধ্যে একজন। আমাকে আর পায় কে, বাবাকে জানালাম ইচ্ছের কথা এবং সাথে সাথে উত্তর এল, “তুমি নিজের যোগ্যতায় এখানে সুযোগ পেয়েছো, অবশ্যই পড়বে”। শুরু হল আরেক নতুন অধ্যায়! আমি আমার বাবার কাছে কতটা কৃতজ্ঞ বলে বোঝাতে পারবো না। আজকে এই আমি এর সবটুকু কৃতিত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আমার শিক্ষক ও সহপাঠিদের, যাদের দেখে আমার সকাল শুরু হত আর যাদের দিয়ে শেষ হত আমার দিন। ওদের ভালবাসা, সহযোগীতা আমার জীবনের পাথেও হয়ে থাকবে। এখনো যেমন অমলিন আছে ওদের সাথে আমার সম্পর্ক। মাস্টার্স শেষ করেই আমি দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলাম এরপরে ওদের সাথে কেমন একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছিল, সে অবশ্য কেবল যোগাযোগের কারণে। একটা চিঠি আসতে তখন প্রায় এক মাস লাগত। তখন প্রেমে পড়াটাও কত সহজ ছিল।
আমাদের ওই সময়টা কিছুটা প্রগতিশীল হলেও প্রেমটা তখনও যেন শুধু হাত ধরা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রেমে আমিও পড়েছিলাম তবে ছ’মাস পরে সে গায়েব হয়ে গেল। ওদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে এক বন্ধুকে পাঠালাম খোঁজ নিতে, সে এসে জানাল যে সে চট্রগ্রামে কোন এক হাসপাতালে ভর্তি। শুনে তো আমার মাথা নষ্ট। অনেক খুঁজে ওর কাজিনকে বের করলাম যার সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছিল। কাজিনের কথা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছে। সে নাকি মাদকাসক্ত এবং সেটা নাকি এমন খারাপ পর্যায় গিয়েছিল যে তাকে চট্রগ্রামের এক রিহ্যাবে ভর্তি করা হয়েছে। মানুষ প্রেমে পড়ে মাদক ছেড়ে দেয় আর আমার বেলায় হল উলটো? হয়ত সে আগে থেকেই এমন ছিল,…নব্য প্রেমের জটিলতায় বোকা আমি বুঝতে পারিনি। কাজিন মানুষটা খুব ভাল ছিল। সে আমাকে বলল এই সুযোগে কেটে পড়তে, বলল ওর সাথে লেগে থাকলে জীবন বরবাদ হয়ে যাবে আর আমার বন্ধু, বান্ধবীদের ও একই মত। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি, অনেক কেঁদেছি তবে ছ’মাসের প্রেম ভুলতে সময় লাগেনি। প্রেম আবার এল এবার সহপাঠির সাথে কিন্তু সেটা বেশি এগোল না বিভিন্ন কারণে কিন্তু তার জন্য বন্ধুত্ব কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি। বছর খানেক পরে সেই ভদ্রলোকের সাথে একবার দেখা হয়েছিল পলকের জন্য। কথা বলার কোন সুযোগ হয়নি, তবে সে ফোন করে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল বটে কিন্তু আমি সাড়া দেইনি। এখন খুব মনে হয়ৃ কোথায় আছে কেমন আছে সে?
ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতে কখন ১ ঘন্টা পেরিয়ে গেল টের পেলাম না। তড়িঘড়ি কাজে ফিরে এলাম। তবে গ্রীস্মের উষ্ণ বাতাসের ছোয়াটা কেমন জড়িয়ে রইলো গায়ে। ফিরে এসে বসতেই খবর এল যে এঞ্জেলা আবার বেরিয়ে যাবার চেস্টা করেছে কিন্তু এবার সে সফল হয়নি বলে খুব কাঁদছে এবং তার বাবার কাছে যেতে চাচ্ছে। আমি স্টেশন ছেড়ে আর গেলাম না। জচঘ আঞ্জেলার সাথে রয়েছে এবং হোমের ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে। আঞ্জেলার একটা পুরো এসেসমেন্ট দরকার। ওর অবস্থা এত খারাপ ছিল না, ডেমেনশয়ার আর্লি স্টেজে ছিল সে কিন্তু মনে হচ্ছে ওর অবস্থা খুব দূত খারাপের দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে হয়ত ৩ তলায় ডেমেনশিয়া ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। শুরুতে আমি ২/১ দিন কাজ করেছিলাম ৩ তলায়। ওখানে ঢুকলে মনে হয় ওটা পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা কোন একটা জায়গা। দিনের বেলা সব ক্লায়েন্টা এখানে ওখানে বসে ঝিমাচ্ছে, কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছে না। ওদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর পাওয়া যায় না। সবাই একটা ঘোরের মধ্যে, যে যার মত। সন্ধ্যা বেলা থেকে শুরু হয় চেঁচামেচি, কান্না, চিৎকার। এটাকে বলে সান-ডাউনিং। সূর্য ডুবে গেলেই ডেমেনশিয়ার রোগিরা কেমন আস্থির হয়ে যায়, এলোমেলো, এগ্রেসিভ, এংজাইটি সব এসে ভর করে ওদের মধ্যে। ৩ তলায় এলিভেটর থেকে বেড়িয়ে এক বিশাল দরজা সেটা লক করে দেয়া হয় সন্ধ্যে হলেই। রেসিডেন্টরা সেই দরজায় গিয়ে বাইয়ে যাবার চেস্টা করে, খুলতে না পারলে জোড়ে জোড়ে কিল মারতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে। একবার ভাবুন ৫/৬ জন মিলে ওই দরজা খোলার চেস্টা করছে, কাঁদছে, কি একটা অবস্থা। ৩ তলায় যারা কাজ করে ওদের সবার ডেমেনশিয়ার উপরে কোর্স এবং ট্রেনিং করে সার্টিফিকেট নিতে হয় আর ওদের বেতনও বেশী। এঞ্জেলা এখনো অতটা এগ্রেসিভ নয়,সে আমাদের এখনো চিনতে পারে, স্বাভাবিক কথপকথন চালাতে পারে এখনো তবে হঠাৎ করে ভুলে যায় সব। এখন পুরোটাই নির্ভর করছে ডাক্তারের এসেসমেন্টের উপরে। এঞ্জেলার জন্য খুব কষ্ট হতে লাগল আমার। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা