শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
আজকে ভিক্টোরিয়ার শাওয়ার ডে ছিল। এই আরেক সমস্যা ওকে নিয়ে। কিছুতেই সে শাওয়ার করতে চায় না। ভিক্টোরিয়ার যেদিন শাওয়ার করবার দিন সেদিন ওই শিফটের মেয়েটার যে কি কষ্ট হয় সে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। কারো একার পক্ষে ওকে সামলে নিয়ে শাওয়ার করতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই যে নার্স ভিক্টোরিয়াকে খাওয়াতে আসে ওকে সেদিন তাড়াতাড়ি আসতে বলা হয় এবং দু’জন মিলে ওকে শাওয়ারে নিয়ে যায় ওর চিৎকার, চেঁচামেচি, লাত্থি, খামচি সব উপেক্ষা করে ওকে হুইলচেয়েরে বসিয়ে শাওয়ার রুমে নিয়ে যায়। এই হোমে প্রতি উইংসে শাওয়ারের জন্য একটা করে বড় বাথরুম বানানো আছে প্রতি তলায়। ভেতরে ঢুকলে অনেক বড় প্রশস্ত একটা জায়গা, মাঝে একটা দেয়াল দিয়ে দু’ভাগ করা আছে যাতে একসাথে দু’জনকে শাওয়ার দেয়া যেতে পারে। এই ব্যাবস্থাটা শুধু তাদের জন্য যারা হাটতে পারে না হুইলচেয়ারে চলাচল করে এবং তাদের জন্য ও নার্সের সুবিধার্থে বিশেষভাবে এই বাথরুম বানানো। যারা ইন্ডিপেন্ডন্ট তারা তাদের রুমের সাথে লাগালো বাথরুম ব্যাবহার করে। ব্রেকফাস্টের পর থেকেই আজ শুরু হয়েছে ভিক্টরিয়ার চেঁচামেচি। সে জানে আজ তার শাওয়ারের দিন।
ভিক্টোরিয়ার লাঞ্চের মেয়েটা আজ ১০টায় চলে এসেছে। এলিভেটর থেকে বেরিয়েই ভিক্টোরয়ার চীৎকার শুনে আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে রুমের দিকে চলে গেল। বেচারির মাথা নাড়া আর চেহারা দেখে আমরা হেসে ফেললাম যদিও এটা মোটেই মজার কোন বিষয় নয়। হোমের নার্স ফ্লোরা কিছুক্ষণ পরে এসে গ্লাভস আর টুকিটাকি সংগ্রহ করতে করতে গজগজ করতে থাকল। আমাদের দিকে ফিরে বলল যেকোন দিন সে কাজ ছেড়ে দেব সে শুধু ভিক্টরিয়ার যন্ত্রণায়। আমি আর ফ্লোর জচঘ আমাদের যথাসাধ্য মুখ গম্ভীর করে বসে থাকলাম। জানি মুখ খুললেই হেসে ফেলব। আমাদের গম্ভীর মুখে চুপ দেখে আর কিছু না বলে সে গজগজ করতে করতে চলে গেল। আমরা দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্টে যুদ্ধের দামামা ভেসে আসছে আর দেখছি রুম থেকে জিনিসপত্র ছিটিকে ছিটকে রুমের বাইরে পড়ছে।
আমি বসে বসে বিপিনবাবুর কেয়ারপ্ল্যানটা বানাচ্ছিলাম। ওর অবস্থা অনিযায়ী সেটা সাব্যস্ত করলাম সেটা হল, সপ্তাহে ২ দিন ৪ ঘণ্টার জন্য একজন নার্স যাবে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার, লন্ড্রী, বাজার, রান্না করে আলাদা করে বক্স করবে পরের ৩ দিনের জন্য এবং বিপিনবাবু এই সময়ে শাওয়ার করবে। তিনদিন পরে আবার ফ্রেস বাজার এবং রান্না হবে। দু’দিন একজন যাবে রেসপাইট কেয়ারের জন্য। এই সময়ে নার্স শুধু ওর সাথে গল্প করবে, ওর সাথে বাইরে বা মলে হাটতে যাবে, কফি খাবে। মোট কথা বিপিনবাবুকে সঙ্গ দেবে আর একদিন ৪/৫ ঘন্টার জন্য একজন ভলান্টিয়ার যাবে (যদি পাওয়া যায়) ওর সাথে গল্প করবার জন্য। এবং রুহা খেয়াল রাখবে সব কিছু ঠিক আছে কিনা।
বিপিনবাবুর ছেলেকে কল করে পুরো বিষয়টা জানালে সে খুব খুশী হল বলল যে এভাবেই চলুক আপাতত তারপরে ওঁর মানসিক অবস্থার উন্নতি হলে পরে আওয়ার কমিয়ে দেয়া যাবে। আমিও এতে সায় দিলাম। এরপরে আমি খুব সাবধানে নার্স পছন্দ করলাম বিশেষ করে রেসপাইট কেয়ারের জন্য। এমন একজন যে কিনা ওঁর সাথে বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারবে এবং ড্রাইভ করে যাতে সে ইচ্ছে হলে কোন মলেও বিপিনবাবুকে নিয়ে যেতে পারবে শপিং করবার জন্য। এমন একজনকে খুঁজে পেতে আমার বেশ কষ্ট হল।
সুনিতা দিল্লির মেয়ে। বেশ চটপটে, দিল্লিতে থাকতে প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিল। এখানেও সে টিচিং লাইনেই যেতে চায় এবং প্রাথমিকভাবে সে দু’বছরের একটা কোর্স শুরু করেছে এবং পাশাপাশি কাজ করে স্বামীকে সাহায্য করছে। ওর পড়াশুনা শেষ হয়ে ওর লাইনে কাজ পেলে তখন ওর স্বামী আবার পড়াশুনায় ঢুকবে যে কিনা সফটওয়্যার ডেভেলপার এবং অলরেডি সে একটা ভাল কাজ করছে। সুনিতা সব বিষয়ে কমবেশী খবর রাখে। সুশ্রী হাসিখুশী একটা মেয়ে এবং সে থাকেও ব্র্যাম্পটনে। সবদিক থেকেই পারফেক্ট হবে, সমস্যা হল ওই দিনে ওর এরেকজন ক্ল্যায়েন্ট আছে একই সময়ে। আমি সুনিতার সাথে কথা বলে ওর ক্লায়েন্টকে কল করে দিন বদল করলার এবং ওকে বিপনবাবুর শিডিউওলে বসালাম। সুনিতাকে আবার কল করে পুরো শিডিউলটা বুঝিয়ে দিলাম এবং সেই সাথে বিপিনবাবুর সম্বন্ধে ওকে একটা ধারণা দিলাম। উনি কি পছন্দ করেন কি পছন্দ করেন না এইসব বিষয়ে। সুনিতা খুশী হল এমন একজন ক্লাটেন্ট পেয়ে। বললাম সামারে শেষ হবার আগে যতটা সম্ভব বিপিনবাবুকে বাইরে বা মলে হাটাহাটি করতে নিয়ে যাবার জন্য। সুনিতা সব বুঝে নিয়ে জানালো যে সে পরদিন থেকেই কাজ শুরু করতে রাজি। আমি সুনিতাকে জানালাম সে যেন প্রথমদিনের শিফট শেষে আমার কল করে বিস্তারিত জানায়।
আমি রুহা কে জানালাম যে কাল থেকে সুনিতা যাচ্ছে এবং সে যেন যায় সুনিতাকে বিপিনবাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। ভলান্টিয়ার কোর্ডিনেটর কে বললাম সপ্তাহে দু’দিনের জন্য একজন একজন ভলান্টিয়ার ঠিক করে দেবার জন্য। সব কাজ হয়ে গেলে বেশ একটা উৎফুল্ল ভাব এলো। আমি প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকে প্রতি সকালে কিচেন থেকে জন্য কিছু না কিছু একটা খাবার আমার জন্য আসে, একটা মাফিন অথবা ২ স্লাইস টোস্ট জ্যাম মাখানো। আজ দিয়ে গিয়েছিল ২ স্লাইস টোস্ট মাখন আর গোল মরচ মাখানো আর একটা ডিম সেদ্ধ। আমি বারণ করলেও ন্যান্সি শোনে না। বলে এত খাবার বেঁচে যায় যে ওগুলো ফেলে দিতেই হবে তাই আমাকে দিলে কোন ক্ষতি নেই। আমারও অনেক ক্ষিদে পায় আজকাল, সকালে খেয়ে আসি সাথে কিছু একটা থাকে সেটাও খাই কিন্তু লাঞ্চের আগে আবার ক্ষিদে পায়, তাই এখন ন্যান্সিকে আর বারণ করি না। কাজ শেষ করে খাবারটা টেনে নিয়ে বসলাম। ১৫ মিনিটের পেইড ব্রেক।
বাথরুমের থেকে ভিক্টোরিয়ার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ঘন্টাখানেক কসরতের পরে ওরা বেরিয়ে এল ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে। শাওয়ার গাউন পড়ানো ভক্টোরিয়াকে রুমে নিয়ে লোশন লাগিয়ে কাপড় পড়িয়ে দেবে ওরা। হঠাৎ করে ফ্লোরা ছুটে এল বলল ভোক্টোরিয়া হয়ত স্ট্রোক করছে, ওর মুখ বেঁকে গিয়েছে আর গোঁ গোঁ শব্দ করছে। জচঘ নাতাশা ছুটে চলে গেল, সাথে আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে ভিক্টোরিয়া কিছু একটা বলার চেস্টা করছে কিন্তু কিছু বোঝা যাচ্ছে না, ওর প্রাইভেট নার্সের হাত এত জোরে ধরে রেখেছে যে বেচারী হাত ছোটাতে পাড়ছে না, ব্যাথায় কাতড়াচ্ছে। আমি হাত ছোটাতে গেলে নাতাশা বারণ করল বলল লাত্থি দিলে আমার পেটে লাগতে পাড়ে। ও কুইক বøাড প্রেসার চেক করে আমাকে বলল ৯১১ কল করতে। নাতাশা আর ফ্লোরা মিলে সুজির হাত ছোটানোর চেস্টা করতে থাকল। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা