শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

আজ ছুটির দিন সকাল। ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি কিছু কাজ সারলাম। আজ মাসিমাকে হসপিটালে দেখতে যাব, অরুণ বলেছে মাসিমার অবস্থা ভাল নয়। তাকে হয়তো আর নার্সিংহোমে স্থানান্তর সম্ভব হবে না। আমি অপরাধ বোধে ভুগতে ভুগতে আজ যাবই বলে পণ করেছি এবং সকাল সকাল গিয়ে হাজির হলাম হসপিটালে। গিয়ে দেখি একটি কংকালসার মানুষ বিছানায় মিশে আছে, মুখের হাসিটুকু না দেখেলে কিছুতেই বুঝাতাম না এটা মাসিমা। আমি মাসিমার হাত দু’টো ধরলাম, পানিতে আমার চোখ ভরে গেল। মাসিমা হেসে বললেন- “মনিরা এসেছো? এতদিন এলে না কেন? মরে গেলে তো আর দেখা হত না?” এর কোন উত্তর আমার জানা নেই, কোন অজুহাত না দিয়ে বললাম- “ভুল হয়ে গেছে মাসিমা, আরো আগে আসা উচিৎ ছিল।” আমার চোখে পানি দেখে মাসিমা আমার হাত ধরে বললেন- “কেঁদ না মনিরা, মন খারাপ কোর না, যাবার বেলা হল বলে আমি খুব খুশী, তাই তুমিও মন খারাপ কর না, আমি বুঝতে পারছি যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। জানি অরুণের বাবা আমায় নিতে আসবে। এই জীবন থেকে পালানোর জন্য আমি দু’হাত বাড়িয়ে বসে আছি”। আমি আর কান্না থামাতে পারলাম না। এই সময়ে নার্স এল, এসে জানতে চাইলো আমি আত্মীয় কিনা। মাসিমা বললেন যে আমি আত্মীয়র থেকেও বেশি।

নার্সের কাছে আমি আমার পরিচয় দিতেই সে বলল যে সে আমার নাম মাসিমার মুখে অনেক শুনেছে। নার্স আরো বলল যে আমাদের এই ফিল্ডে এমন অনেক হয়, আমরা কারো কারো সাথে ইমোশনালি অনেক এটাচড হয়ে যাই পরে অনেক কষ্ট হয়। খোলাখুলি সে বলল যে মাসিমা মানসিকভাবে অনেক শক্ত এবং মৃত্যুর জন্য সে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আমাকে বলল যে, মাসিমা চলে যাবার পরে আমি যেন আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে বলে কাউন্সেলিংএর জন্য এপয়েন্টমেন্ট করি। আমি খুব আস্তে জানতে চাইলাম মাসিমার হাতে কতটা সময় আছে। নার্স বলল যে, ক্যান্সার ছড়িয়ে পরেছে সারা শরীরে, সব অর্গানে তাই মাসিমার হাতে হয়ত একদিন অথবা ১ সপ্তাহ সময় আছে। মাসিমা যেহেতু একদমই বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছেড়ে দিয়েছেন তাই তিনি হয়ত ১ সপ্তাহ বাঁচবেন না, যে কোন সময়ে চলে যাবেন। আমার বুকটা ধক করে উঠল!

নার্স চলে গেলে আমি মাসিমার কানে কানে বললাম যে, আমার শরীরে নতুন মানুষের আগমনের খবর পেয়েছি। আনন্দে মাসিমার চোখ দু’টো জ্বলে উঠল। আমাকে বলল আমার মাথা তার কাছে এগিয়ে নিতে। আমার মাথায় হাত রেখে মাসিমা আশীর্বাদ করলেন আমার যেন একটা সুস্থ, সুসন্তান হয়, মায়া আর করুণায় যেন তার হৃদয়ে ভরে থাকে। মাসিমা বললেন যে, দুধে-ভাতে থাকবার চেয়ে ভাল মানুষ হওয়াটা অনেক বেশি প্রয়োজন মনিরা। এইটুকু কথা বলে মাসিমা হাঁপিয়ে গেলেন। আমি সায় দিলাম, বললাম আপনার আশীর্বাদ যেন সফল হয়; ভাল মানুষ হোক আমার সন্তান। আমি আর কথা বলতে বারণ করলাম মাসিমাকে। পাশে বসে আমি হোমের অনেক গল্প করলাম, মাসিমা চলে আসার পরে কি কি হল, ভিক্টোরিয়ার গল্প, এই গল্প, সেই গল্প। মাসিমাকে অনেক টায়ার্ড লাগছিল। ভাবছিলাম এখন যাই কিন্তু বলতে পারছিলাম না মাসিমাকে, বেঁধে যাচ্ছিল। মন বলছিল আর দেখা হবে না। মাসিমাই ধীরে ধীরে বললেন- “মনিরা আর দেখা হবে না তোমার সাথে। মাঝে মাঝে অরুণকে ফোন কোর আর অরুণ যদি পারে আজ রাতটা যেন আমার সাথে থাকে, একটু বোল ওকে। সকল সময়ে আনন্দে থেক মনিরা, আমি দূর থেকে তোমাদের সকলের জন্য প্রার্থনা করব।”

আমি মাসিমার হাত আমার গালে চেপে ধরলাম, দু’চোখ ছাপিয়ে পানি পরছে কারো মুখে কোন কথা নেই। আমার মায়ের কথা মনে পড়ছিল; বরফে চাপা দেয়া ঠাণ্ডা, শক্ত শরীরটা ধরে কত ডেকেছিলাম “মা” “মা” বলে, চোখ খোলেনি আমার মা, আমার অভিমানী “মা”, না বলে কয়ে টুপ করে চলে গিয়েছিল সে তার মায়ের কাছে আর বছর ঘুরতেই গেলেন বাবা। আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ফিসফিসিয়ে মাসিমাকে বললাম- “আমার মা-বাবার সাথে দেখা হলে ওঁদের বলতে যে আমি খুব ভাল আছি।” আমি উঠে দাঁড়িয়ে মাসিমার কপালে একটা চুমু দিয়ে আর একটি কথাও না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। সারাটা পথ কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেললাম। বাড়ি ফিরে ধাতস্থ হয়ে অরুণকে ফোন করে বললাম মাসিমার ইচ্ছের কথা। অরুণ বলল যে সে চেষ্টা করবে। আমি অরুণকে বললাম – শেষ সময়ে অরুণ যেন তাঁর হাত ধরে থাকে এটাই মাসিমার শেষ ইচ্ছে। অরুণ ওপাশে নিশ্চুপ! একটু পরে বলল, “আমি যাব নিশ্চই”!

সোমবারে অফিসে গিয়ে জানলাম যে মাসিমা আর নেই, রোববার সন্ধ্যায় ছেলের হাতে হাত রেখে তিনি বিদায় নিয়েছেন এই ধরাধাম থেকে। আমি অরুণকে কল করলাম, অরুণ এই প্রথম সব বাঁধা ভেঙ্গে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, কোন কথা নেই শুধু কান্না। একটু ধাতস্থ হতে ওর কাছ থেকে জেনে নিলাম ফিউনারেলের আয়োজন। অরুণ বলল সে একটা হিন্দু মন্দিরের সাথে কথা বলেছে এবং তারাই সব আয়োজন করে আজ সন্ধ্যায় মাসিমার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করবে। মাসিমার ইচ্ছে দাহ করার পরে তাঁর অস্থি-ছাই যেন এখানে কোন লেকে ছড়িয়ে দেয়া হয়…
“মৃত্যু অজ্ঞাত মোর, আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়
মৃত্যুরে আমি ভাল বাসিব নিশ্চয়।” -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাসিমা মৃত্যুকে ভীষণভাবে ভালোবেসেছিলেন, মৃত্যুর পরে কি হবে তা নিয়ে তাঁর কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না।

মনটা ভারী হয়ে রইলো সারাদিন, অনেকেই আমাকে সমবেদনা জানালো। অনেকেই অফার করল কথা বলার জন্য। জর্জ এসে বসে রইলো আমার পাশে কিছুক্ষণ। নিঃশব্দ কোন কথা নেই। জর্জকে ফ্যাঁকাসে লাগছিল। অনেক পরে সে বলল- “সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমি পড়ে আছি কেন মনিরা?”

আমি কিছু না বলে জর্জের হাত ধরলাম। আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে জর্জ উঠে চলে গেল। আমি ওইদিন ডিউটিরত নার্সকে বললাম জর্জের জন্য একটা কাউন্সেলিংএর এপয়েন্টমেন্ট করা উচিৎ, নার্স সায় দিল আমার কথায়। কিছুক্ষণ পরে সে জানালো যে সে আমার এবং জর্জ দুজনার জন্যই আপয়েন্টমেন্ট করেছে। আমি যদিও কোন কাউন্সেলরের সাথে কথা বলতে আগ্রহী ছিলাম না কিন্তু কিছু বললাম না। একটা বক্স নিয়ে মাসিমার রুমে গেলাম। মাসিমার স্যুটকেসটা বের করে ওতে ওর কাপড়গুলো আর অন্যান্য ব্যাবহার্য জিনিষ ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিলাম, বক্সে ক্যাসেট প্লেয়ারটা আরো অন্যান্য টুকিটাকি সব ভরে গুছিয়ে রাখলাম। কাল থেকে শুরু হবে এইরুম পরিষ্কার অন্য কারো জন্য। জানিলার ধারে মাসিমার খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে মনে হল মাসিমা ওখানে বসে ইশারায় আমাকে ডাকছেন, বুকটা খালি খালি লাগল। মাসিমার প্রয়াণে তিনি একা নন অরুণও মুক্তি পেয়েছে বটে, দুজনার জন্য এই বেশ ভাল হল! মাসিমা হয়ত স্বর্গে গিয়ে এতক্ষণে মেসোর সাথে নতুন সংসার পেতে বসেছেন, এইভেবে মনটা হালকা হল খানিকটা। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা