শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
১০.
গুরপ্রীতের সব তথ্য লিপিবদ্ধ শেষে একটা লম্বা লিস্ট করলাম তাতে খাবার দাবারসহ দৈনন্দিন জীবনে আর যেসব জিনিস প্রয়োজন সব লিখলাম, হারপ্রীত আর আমি মিলে চলে গেলাম ওয়ালমার্টে। ঝাড়ু, মপ, বিছানার চাদর, টাওয়াল, কাপড় ধোয়ার সাবান এবং খাবারসহ আরো কত কি। এর মধ্যে অফিসে ফোন করে হারপ্রীতের সময় আরো ৩ ঘন্টা বাড়ালাম। ফিরে এসে পুরো রুমের সব কাপড় একটা বড় গারবেজ ব্যাগে ঢুকিয়ে হারপ্রীতকে পাঠিয়ে দিলাম লন্ড্রি করবার জন্য। বিল্ডিং এর অফিস থেকে ভ্যাকিউম এনে আমি ফ্ল্যাটটা ভ্যাকিউম করে দিলাম। হারপ্রীত কাপড় ওয়াসারে দিয়ে ফিরে এলে আমরা দু’জন মিলে গুরপ্রীতের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা ঝকঝকে করে পরিষ্কার করে দিলাম। হারপ্রীত সবজী রান্না করল আর ছোট্ট একটা রাইস কুকারে ভাত রান্না করে দিল, রেফ্রিজারেটর ভর্তি খাবার সাজিয়ে রাখলাম, দুধ, পাউরুটি, তৈরি চাপাতি, পরাটা, মাখন, জেলি ইত্যাদি, গুরপ্রীত ভেজিটেরিয়ান তাই ডিম, মাছ, মাংস নেই তালিকায়। এরমধ্যে গুরপ্রীতকে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে দিল হারপ্রীত। যাবার সময় গুরপ্রীত কে হারপ্রীতের নাম্বার দিয়ে বললাম প্রয়োজনে আশার ফোন দিয়ে ফোন করবার জন্য যদি জরুরি কোন প্রয়োজন হয়। সাথে এও বললাম যে ওর জন্য একজন পাঞ্জাবী সোসাল ওয়ার্কার নিয়োগের ব্যাবস্থা করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ততক্ষণে আশাও আবার এসে জুটেছে আমাদের সাথে। আশাকে আবারো অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বললাম গুরপ্রীতের দিকে নজর রাখতে। গুরপ্রীত এসে আমার হাত জড়িয়ে ধরে হাতে চুমু দিতে শুরু করল সাথে ফোঁপাতে থাকল আবার আমায় ছেড়ে হারপ্রীত কয়ে জড়িয়ে ধরল। আমি গুরপ্রীতকে একটা হাগ দিয়ে বললাম আর কোন ভয় নেই, আমরা আছি ওঁর সাথে। সেদিনের জন্য বিদায় নিলাম, হারপ্রীতকে বললাম আশার নাম্বারটা সেভ করে নিতে কারণ ওর ফোনে আশার কল এলে বুঝতে হবে গুরপ্রীত যোগাযোগের চেষ্টা করছে।
তখন শীতের প্রায় শেষ, হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে চারিদিকে, স্নো গলে গিয়ে চারিদিকের কেমন একটা বিবর্ণ অবস্থা। ন্যাড়া গাছগুলো কেমন আসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে নতুন পোষকের জন্য। বছরের এই সময়টা আমার খুব একটা প্রিয় নয়, সব কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে, যদিওবা প্রকৃতি বসন্তের আগমনী গান গাইছে কিন্তু বসন্তের রুপ ফুটবার আগ পর্যন্ত সবকিছুই কেমন খালি খালি লাগে। আমি হারপ্রীতকে বিদায় জানিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে হাঁটছিলাম। দিন আবার একটু একটু করে লম্বা হচ্ছে। ঘড়িতে দেখলাম বিকেল ৫টা এবং তখনও বাইরে অনেক আলো। নভেম্বরে বিকেল ৫টা মানে মনে হয় রাত ৮টা। বড় দিনগুলোর উচ্ছ্বাস একরকম আবার ছোট দিনগুলোর অন্যরকম আনন্দ। পার্কিং-লটটা বিল্ডিংয়ের পেছনদিকে আর তার ঠিক পেছনেই অনেক বড় মাঠ, সেখানে রয়েছে বাচ্চাদের খেলার জন্য একটা প্লে-গ্রাউন্ড। মাঠে দেখা গেল বেশকিছু ইন্ডিয়ান এবং জ্যামাইকান মহিলা দাঁড়িয়ে যে যার মত গল্প করছে আর বাচ্চাগুলো খেলছে। আমি গাড়িতে বসে কিছুক্ষণের জন্য অনেক ভাবনায় ডুবে গেলাম।
গুরপ্রীতের নাতনী একসময় বিদ্রোহ ঘোষনা করল যে তার নিজের রুম চাই। ছেলেকে গুরপ্রীত বলেছিল একটা বড় বাসা নেবার জন্য, শুনে ছেলে কিছু না বললেও বউ ধমকে উঠেছিল, বলেছিল বড় বাসার টাকা কোত্থেকে আসবে? গুরপ্রীত জানত যে ওরা খুব কষ্ট করে টাকা জমাচ্ছে বাড়ি কিনবে বলে। আশায় বুক বেঁধে ছিল যে বাড়ি কিনলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এর মধ্যে একদিন ছেলে এসে বলল যে ওঁকে কিছুদিন অন্য জায়গায় থাকতে হবে, বাড়ি কেনা হলেই সে এসে মাকে নিয়ে যাবে। গুরপ্রীত ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ছেলের কাছে কান্নাকাটি করেছিল ওঁকে একা কোথাও না ছাড়ার জন্য। বলেছিল সে বসার ঘরে থাকবে নাতি-নাতনীকে কোন কষ্ট দেবেনা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। গুরপ্রীত জানত যে জায়গাটায় ওরা থাকত সেটা জায়গাটার নাম স্কারবোরো। অনেকটা পথ গাড়ি চালিয়ে ছেলে ওঁকে এখানে এনে তুলেছিল। গুরপ্রীত পরে জেনেছিল যে জায়গায় সে এখন থাকে এ জায়গার নাম ব্র্যাম্পটন এবং এটা স্কারবোরো থেকে অনেক দূরে। ঘরের আসবাব আগেই ছিল। ১ সপ্তাহের মত বাজার করে দিয়ে আর মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে ছেলে বলেছিল সপ্তাহে একদিন করে এসে দেখে যাবে। এরপরে ৪ মাস কেটে গিয়েছে ছেলে আসেনি। গুরপ্রীত ঠিকানা দিয়েছিল একটা তবে সেখানে ওর ছেলেকে পাওয়া যায়নি। ছেলের নাম্বারে ফোন করে জানা গিয়েছিল সেটা ডিস্কানেক্টেড। গুরপ্রীত বুঝেছিল যে ও আর ছেলের দেখা পাবে না। কেঁদে কেঁদে কেটে গিয়েছে দিনগুলো। ছেলে প্রথম ও শেষ মাসের ভাড়া মিটিয়েছিল। ওর টেবিলের উপড়ে পরে ছিল ম্যানেজমেন্ট অফিসের চিঠি, তাতে ছিল ৩ মাসে ভাড়া পরিশোধ করবার তাগাদা। দরজায় শব্দ হলেই ভাবত এই বুঝি ছেলে এল। গুরপ্রীতের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল, মনে হয়েছিল; এও হয়, এও সম্ভব! অল্পকটা টাকা দ্রæত ফুরিয়ে গিয়েছিল, খাবার কষ্ট ছিল সব থেকে বড় কষ্ট। কাউকে কিছু বলতে ভয় পেত আবার কি থেকে কি হয় এই ভয়ে। মনটা ভারী হয়ে ছিল, অফিস আওয়ারও শেষ তাই কাজে ফোন করে বলে দিয়ে আমি সেদিনের মত বাড়ির পথ ধরলাম।
পরদিন অফিসে গিয়েই আমি গুরপ্রীতের ফাইল ডাটাবেইসে ঢোকালাম এর পরে হারপ্রীতকে ঠিক করে দিলাম যে সপ্তাহে ৩ দিন সে ২ ঘন্টার জন্য গুরপ্রীতের কাছে যাবে, ক্লিনিং, লন্ড্রি, বাজার রান্না করে দেবে এই সময়। গতকালের বাজারের রিসিট এবং গুরপ্রীতের সাপ্তাহিক বাজার খরচের একটা লিস্ট করে নিয়ে জমা দিলাম একাউন্টেন্টের কাছে। সাপ্তাহিক বাজারের একটা খরচ হিসেব করে একাউন্টেন্ট একটা ভিসা কার্ড দিল গুরপ্রীতের জন্য। আমি হারপ্রীতকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে গুরপ্রীতের সাপ্তাহীক বাজার খরচের কার্ডটা আমার কাছে আছে এবং এই সপ্তাহে যেদিন ওর নার্সিংহোমে ডিউটি পরবে সেদিন যেন সে এসে আমার কাছ থেকে কার্ডটা নিয়ে যায়। হারপ্রীত ২ বছর ধরে এই কোম্পানিতে কাজ করছে। সে এখনো পার্ট টাইম তাই ওকে ক্যমিউনিটিতে আওয়ার করতে হয় আর মাঝে মাঝে এর ওর সিক কলের শিফটগুলে পায় নার্সিংহোমে। সব মিলিয়ে ওর ২৫/৩০ ঘন্টা হয় আর তাতেই সে খুশী। এরপরে ফাইলটা নিয়ে আমি রুহা চোপড়ার কাছে গেলাম। সে এই কোম্পানির হিন্দি ও পাঞ্জাবী ভাষী সোসাল ওয়ার্কার। রুহাকে ফাইলটা বুঝিয়ে দিয়ে গুরপ্রীতের বিষয়ে বিস্তারিত সব বললাম। প্ন্যান হল যে হাম্বার হস্পিটালের কাছে একটা সরকারি সিনিয়ির হোম আছে এখানের ৭৫% রেসিডেন্ট সব ইন্ডিয়ান। আমরা চেস্টা করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে গুরপ্রীতের জন্য একটা ১ বেডরুমের বাসা নিতে এবং একটা মাসিক সরকারি ভ্রাতার ব্যাবস্থা করতে। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা