শারমীন শরীফ : বিথীকা বিশ্বাস ১৯৪৮ সালে বরিশালের আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের বাস্তব-কাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষক বাবা গণেশচন্দ্র বিশ্বাস এবং মা যামিনী বিশ্বাসের এক ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
বিথীকার জন্মস্থান কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগান অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ পেশায় কৃষক ও পেয়ারা চাষী হলেও এরা ছিলেন সংস্কৃতি ও রাজনীতি সচেতন। এই পরিবেশে বেড়ে ওঠা বীথিকা বিশ্বাস ছোটবেলা থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে এদেশের বিপ্লবের ইতিহাস পড়তেন। আর মনে মনে ভাবতেন তিনিই একদিন প্রীতিলতা তানিয়া ইলা মিত্রদের মত বিপ্লবী হবেন। আর এসব চিন্তার প্রকাশ ঘটতো তার আচরণের মধ্য দিয়ে। স্কুলে কোন শিক্ষক শুধু মেয়ে বলে কাউকে অন্যায় শাসন করলে তিনি তার প্রতিবাদ করতেন। তিনি জোর গলায় বলতেন মেয়েরা ছেলেদেরকে কোন অংশে কম নয়। এটা শুধু বলার জন্যই তিনি বলতেন না, এটাও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতেন কারণ তিনি বড় হয়েছেন বড় ভাইসহ ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে। তিনি বিশ্বাস প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন নিজ গ্রামের স্কুলে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ঢাকার ফাইজুল হক কলেজ থেকে। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন এবং সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। কলেজ কম্পাউন্ডে ছাত্র ইউনিয়নের ক্যাম্পেইন করতেন, দেয়াল পত্রিকা করতেন, রাজনৈতিক ক্লাসে অংশ নিতেন, ছাত্রদের সংগঠিত করতেন।
১৯৭০ সালে বিথীকা বিশ্বাস ঢাকার ডিগ্রী কলেজে বিএ পড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের পরে হোস্টেল ছুটি হয়ে গেলে সবাইকে ফিরে যেতে হয় বাড়িতে। অতএব বীথিকাও ফিরলেন বাস্তবকাঠিতে। তখন গ্রামের সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে এই ভেবে যে, কখন হানাদার বাহিনী এসে আক্রমণ করে। চারিদিকে শত্রু আগমনের দুঃসংবাদ এমতাবস্থায় তিনি বড় ভাই সমীরণের সাথে দিনরাত ফলা পরামর্শ করছেন কি করা যায়। দুভাইবোন মিলে গ্রামে গোপনে মিটিং করে দল গড়লেন, সমীরণ পাশের গ্রামের পরিচিত বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে আনলেন দুটি রাইফেল। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনীর গান বোর্ড বরিশালে পৌঁছায়। বরিশালের উপর দিয়ে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার উড়ছে। শোনা গেল মিলিটারি গান বোর্ড নিয়ে আটঘর কুড়িআনায় আসছে। গ্রামের মানুষ তখন আশ্রয় নিলো পেয়ারা বাগানে। এ সময় বড় ভাই সমীরণ ট্রাঙ্ক থেকে রাইফেল দুটো বের করলেন, একটি রাইফেল তুলে দিলেন বীথিকার হাতে। গ্রামের ছাত্র যুবকদের নিয়ে তারা পজিশন নিলেন পেয়ারা বাগানে। সেদিন পাক বাহিনী পেয়ারা বাগানে আসেনি কিন্তু এপ্রিল মাসে কুড়িয়ানায় এসে ঘাঁটি করলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহমুদ আলম বেগ। ক্যাপ্টেন বেগের আগমনের কথা শুনেই দুই তরুণী বিথীকা বিশ্বাস ও শিশির কণা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন বেগ তাদের সঙ্গে দেখা করলেন না বারবার যাওয়া সত্তে¡ও। কিন্তু তরুণী দুজন নাছোড়বান্দা ছিলেন, তারা লেগে থাকলেন এবং শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন বে দেখা করতে বাধ্য হলেন। হালকা পাতলা ছিপ ছিপে তরুণী দুজনার কাধে রাইফেল। দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন কিন্তু ক্যাপ্টেন বেগ তাদের কথা উড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন তোমরা পারবেনা কিন্তু নির্বিকার চিত্তে বীথিকা বলে দিলেন, ‘মরতে হয় মরবো কিন্তু আমাদের দলে নিতেই হবে’। মেয়েদের দৃঢ? প্রতিজ্ঞা দেখে ক্যাপ্টেন বেগ তাদের দলে নিলেন। দেখাদেখি আসলেন শোভা, সাহানা। পারভীন সহ অনেক মেয়ে। ক্যাপ্টেন বেগ হরিয়ানা হাইস্কুলের মাঠেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন। এসময় প্রায় একশো সেখানে প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় ৯ নং সেক্টরের স্টাফ অফিসার ছিলেন ওবায়দুর রহমান এবং বেইজ কমান্ডার ছিলেন কুতুব উদ্দিন। কুড়িয়ানা গ্রামের পরিমল ঘোষ ও তোফাজ্জল হক ছিলেন দলনেতা।
মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার আগে বলে দেয়া হত ধরা পড়লে, ছেলেরা মেয়েদের গুলি করে মারবে,কিন্তু শত্রæর হাতে ছেড়ে আসবে না । মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সস্ত্রের পরিমাণ ছিল খুব অল্প এবং বুলেট ছিল আরো কম। বিথীকা যেদিন বুলেটের অভাবে বেওনেট দিয়ে দুজন দেশদ্রোহী রাজাকারকে মারলেন সেদিন ক্যাপ্টেন বেগ তাকে প্রথম শ্রেণীর যোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং তার দলের সদস্য করে নিলেন। এরপরে বীথিকা অংশ নিলেন একের পর এক অপারেশনে। সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন বেগ ও তোফাজ্জল হকসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা বিথীকা ও শিশির কণাকে কখনো মেয়ে হিসেবে মনে করেননি বরং তাদের সহযোগিতা হিসেবে তাঁদেরকে গ্রহণ করেছিলেন। তোফাজ্জল হক বলেন, মে মাসে কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে পজিশন নিলে বিথীকা ছিলেন ফ্রন্টলাইনে। সেদিন ক্যাপ্টেন বেগ বিথীকা শিশির এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে কমপক্ষে ১০ জন সেনাকে মেরেছিলেন।
বিথীকার মুক্তিযোদ্ধা জীবনের সবথেকে বড় অপারেশন ১৯৭১ সালের ১১ই জুলাই, পাক বাহিনীর গান বোটে গ্রেনেড চার্জ করবার ঘটনা। ঐদিন খবর আসে পাক আর্মি এসেছে স্বরূপকাঠিতে। বড় নদীতে নোঙ্গর ফেলেছে পাক সেনাদের গানবোট। ক্যাপ্টেন বেগ সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রেনেড চার্জ করতে হবে গান বোটে কিন্তু কে যাবে? আগ্রহ দেখালেন বিথীকা ও শিশির কণা। এর আগেও কয়েকটি অপারেশনে সাফল্যের সাথে লড়েছেন বিথীকা আর তাই আপত্তি করলেন না ক্যাপ্টেন বেগ। বৃষ্টি ভেজা রাত টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় করে নৌকায় উঠলেন বিথিকারা, দুজনেরই কোমরে বাধা হ্যান্ড গ্রেনেড। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতার দিয়ে গান বোটের দিকে এগিয়ে গেলেন দুই তরুণী মুক্তিযোদ্ধা। বৃষ্টির মধ্যে কচুরিপানার আড়ালে অন্ধকারে ভেসে ভেসে পৌছালেন লঞ্চের গায়ে। পাশাপাশি তিনটি লঞ্চ, বাতাসে তখন রান্নার গন্ধ, লঞ্চের মধ্যে খানাপিনার বিশাল আয়োজন চলছে। জোরে বৃষ্টি এলে বিথীকা শিশিরের কাঁধে চাপ দিয়ে বললেন, ‘আর দেরি করা যাবে না’। দাঁতে গ্রেনেডের রিং চেপে ধরে টান দিয়ে ছুড়ে মারলেন ব্রেনের লঞ্চের ইঞ্জিন লক্ষ্য করে। কেঁপে উঠল পাক বাহিনীর গানবোট আর মুহূর্তের মধ্যেই গানবোট থেকে দুই তীরের জমাট অন্ধকারের দিকে ছুটে গেল শত শত রাউন্ড গুলি। জীবন্মৃত অন্ধকারে লঞ্চের আড়ালে ভেসেছিলেন দুজন। অনেকক্ষণ পরে অন্ধকারে কচুরিপানার নিচ দিয়ে তীরে ফেললেন এবং হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলেন মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্পে।
এ সময় পশ্চিমবঙ্গের বাগেরহাট মহাকুমার টাকিতে ছিল ৯ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। এখানে মেজর জলিলের নেতৃত্বে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে বিথীকাসহ আরো শ’খানেক নারী গুপ্তচরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই ক্যাম্পটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রমা নামে একজন নারী। প্রথম দিকে এই ক্যাম্পে বিথীকার দায়িত্ব ছিল গেরিলা এবং গুপ্তচর বৃত্তির প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য মেয়েদের সংগ্রহ করে আনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েরা নানা রূপ ধরে রাজাকারদের সাথে মিশে যেতেন। বিভিন্ন ধরনের অভিনয় করে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ করত। মুক্তিযোদ্ধার নারীদের সাথে থাকতো সায়ানাইড, ধরা পড়লেই আত্মহত্যা করবেন। ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অপারেশনে অংশ নেন বিথীকা বিশ্বাস।
‘একাত্তরের নারী’ গ্রন্থের লেখক মালেকা বেগম বলেন, একাত্তরে বীথিকা বিশ্বাস বা শিশির কণা পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোট গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিলেও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তারা যথাযোগ্য বীরের মহিমায় অভিসিক্ত হননি। উপরন্তু তাদের ললাটে জোটে সামাজিক লাঞ্ছনা। যুদ্ধ শেষে বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণাকে তাদের পরিবার ও সমাজ মেনে নেয়নি। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে এমন উদাহরণ অসংখ্য।
যুদ্ধের পরে ১৯৭৫ সালে বিথীকা বিশ্বাস পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে, উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছেন।
বিজয়ের অর্ধ শতক পরও ইতিহাসে উপেক্ষিত দুঃসাহসী নারী বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণা। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ ইতিহাসে প্রতিফলিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এসব দুঃসাহসী নারীদের মূল্যায়ণ করা। বর্তমানে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাও দীর্ঘদিন ধরে নারীদের স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করছি।