শারমীন শরীফ : ‘কত ভাগীরথী, কত রাবেয়া, সুফিয়ার বীরত্ব ও আত্মদানে এই বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি। কত বীরকন্যার শরীর, সম্ভ্রম, রক্ত আর চোখের জলে সিক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশ। এ মাটিকে পবিত্র করেছেন আমাদের কন্যা-জায়া-জননীরা। ভাগীরথীর মতো বীরকন্যারাই দেশের শ্রেষ্ঠতম মুক্তিযোদ্ধা।’

স্বাধীনতার লাল সূর্যের প্রতীক্ষায় যিনি নিজেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন সেই নারী আমীনা বেগম মীনা। তিনি নিজে ও স্বামী উভয়ই নিজেদের জীবনকে উপেক্ষা করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৬২- সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ১৯৬৬- সালে ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯- এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭০- এর সাধারণ নির্বাচন ইত্যাদির সাথে তিনি ওতপ্রুত ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে ছাত্র সংসদের যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ছাত্রলীগ সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার মহিলা সম্পাদিকা ছিলেন এবং দক্ষতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-৭০ সালের গণ-আন্দোলনে পাক সরকারের অত্যাচারে তৎকালীন ছাত্র সংসদের ছাত্র নেতৃবৃন্দ যখন কারাগারে, তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তিনি নিজ দায়িত্বে ও নেতৃত্বে সহকর্মীদের সহায়তায় আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি সফলতার সাথে পালন করেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয় বিজ্ঞান ভবনে রিজার্ভ পুলিশ দ্বারা অনেক ছাত্রীর সহ তিনিও নির্যাতিত হয়েছেন।

যাদের নেতৃত্বে তিনি এই আন্দোলন করেছিলেন তারা হলেন আ. স. ম. আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, সিরাজুল আলম খান, শাহজাহান সিরাজ, সিরাজগঞ্জের আব্দুল লতিফ মির্জা, আমির হোসেন ভুলু, আমিনুল ইসলামসহ আরো অনেকে। আমীনা বেগম মীনা ১৯৫১ সালের পহেলা জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলা ও থানাধীন খোকসাবাড়ি, সিরাজগঞ্জে পড়ালেখা শুরু করেন। ১৯৬৭-৬৯ সাল পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়াশোনা করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৯-৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞানের স্নাতক উত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৪ই মার্চ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আজিজুল হক বকুলের সাথে বিয়ে হয়। ২৫ শে মার্চে তিনি তার গ্রামের বাড়ি কুশ্যাহাটায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই অন্যদের সঙ্গে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ২/১দিনের বেশি এক গ্রামে থাকতে পারেননি। কখনো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের সঙ্গে কখনো সহকর্মীদের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর রায়গঞ্জ থানার বিভিন্ন স্থানে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে সব খবরা খবর রাখতেন। সিরাজগঞ্জ মহাবিদ্যালয় প্রায় এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। মুজিব বাহিনীতে কাজ করেছেন, রাকসুর প্রাক্তন জি এস আব্দুস সামাদ ও বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ মির্জার সঙ্গেও কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে দেশপ্রেম, বিবেক এবং শামীম মোঃ আজিজুল হক বকুল ও তার সহকর্মীরা সবথেকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। এছাড়া নিজের পরিবার ও স্বামীর পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন। তার চাচা যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর কাজ ছিল বিভিন্ন ইউনিটের জন্য ভারত থেকে চাহিদা মোতাবেক অস্ত্র এনে তাদের সরবরাহ করা। এই কাজে মাঝে মধ্যে স্বামীকে তিনি সহযোগিতা করতেন।

আমীনা বেগম মীনা

১৯৭১- এর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে স্বামীর সাথে অস্ত্র আনার জন্য নৌকাযোগে ভারত যাওয়ার পথে একসময় তারা দেখতে পান যে একটি গান বোট নৌকাকে অনুসরণ করছে। নৌকায় তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তড়িৎ বুদ্ধিতে আমীনা বেগম মীনার স্বামী প্রয়োজনীয় টাকা এবং খবর পৌঁছানোর ঠিকানা দিয়ে নৌকা পারে ভিড়িয়ে অন্য মুক্তি যোদ্ধাদের নামিয়ে দেন। সেই দলে ছিলেন সিরাজগঞ্জ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষিকা মিসেস জোসনা সাহা। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকা থেকে নেমে প্রাণপণ দৌড়াতে শুরু করেন গান ভোটের চোখের আড়ালে যাবার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের নামিয়ে দিয়ে আমীনা বেগম ও তার স্বামী নৌকা আবার মাঝ নদীতে নিয়ে যান, তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রয়োজনে গান ভোটকে আক্রমণ করা ও শহীদ হওয়া,যাতে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। গান বোটটি তাঁদের কাছাকাছি এসে যখন দেখে নৌকোটা খালি এবং তাঁরা দুজন ছাড়া কেউ নৌকাতে নাই তখন তারা গানবোট ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যায়।

আন্দোলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সিরাজগঞ্জ পৌর মিলনায়তনে (বর্তমানে ভাসানী মিলনায়তন) – এ নবীনবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। তখন খবর পেলেন পুলিশ মিলনায়তন টি ঘেরাও করবে। নেতৃবৃন্দ যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ছিল তারা মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে চলে গেলেন। কিন্তু আমীনা বেগম মীনা সেখানে থেকে গিয়েছিলেন দ্বায়িত্ব অনুষ্ঠান শেষ করবার প্রয়াসে। তিনি শঙ্কিত ছিলেন গ্রেফতারের জন্য, ভীত ছিলেন এই ভেবে যে তিনি গ্রেফতার হলে মা-বাবার অসহায় বিপন্ন অবস্থার কথা ভেবে, কিন্তু দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হননি। সৌভাগ্যবশত তিনি সেদিন গ্রেফতার হননি।

এর মাঝে তিনি স্বামী স্বামীর সহ মা-বাবাকে দেখার জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু পরদিন ভোরেই রাজাকার ও পাক বাহিনী দ্বারা ঘেরাও হলেও সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। এরপরে তাঁরা ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁরা রংপুরের রৌমারী ইউথ ক্যাম্পে ও পলাশডাঙ্গা গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে সংগঠকের কাজ করেছেন। তাঁদের অস্ত্র, খাবার জমা রেখেছেন এবং প্রয়োজনে পৌঁছে দিয়েছেন।এই আন্দোলনে-সংগ্রামে যে নারী সহকর্মীরা সাথে তাঁর সাথে ছিলেন তাঁরা হলেন – এলিজা সিরাজী, বিলকিস আর তাহমীনা মিনি, সাফিনা লোহানী, পারভীন, আনোয়ারা, নাহারসহ আরো অনেকে।

স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭২-৭৩ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ও স্বামী পিতা সন্তান হারানো মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, পাক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলাদের গ্রামে গ্রামে ঘুরে খুঁজে বের করে নারী পুনর্বাসন বোর্ডের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা, আবাসিক সুবিধা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখনও সেই ব্রত নিয়েই আছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থাকার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়নি।