শারমীন শরীফ : ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর কালিকাপুর গ্রামে জন্ম ড. এস এম আনোয়ারা বেগমের? পিতা শরীফ হোসেন সরদার এবং মা সোনা বানু? পাঁচ বোন, এক ভাই? পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তাঁরা? বড় ভাই সরদার আবদুর রশীদ তখন পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন? বড় ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন দুই বোন আনোয়ারা এবং মনোয়ারা? পাড়ার লোকেরা তাঁদেরকে অনু আর মনু নামে ডাকত?

মুক্তিযুদ্ধের আগেই দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন সংগ্রামে নিজেদের সক্রিয় কর্মকাণ্ডের কথা জানালেন ড. এস এম আনোয়ারা বেগম? তিনি বলেন, ‘‘ভাইয়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি আমাদের মনে নাড়া দেয়? দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে? তখন ভাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি রাজনীতিতে? ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ছিল রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি? এলাকার সবার মুখে মুখে তখন আমাদের দুই বোনের নাম? আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেওয়ার কারণে আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি আসে? তবু থেমে থাকিনি? বড় ভাইকে প্রায়ই কারাগারে যেতে হতো? আইয়ুব খানের মার্শাল কোর্টে তাঁকে সাজাও দেওয়া হয়? ১৯৬৮ থেকেই আন্দোলন সংগ্রামে মেতে ছিলাম আমরা? মিছিলে মিছিলে যখন প্রকম্পিত হতো রাজপথ? আমরা তখন মিছিলের সামনে অবস্থান করে স্লোগান দিতাম?”

দেশকে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন পটুয়াখালীর বীর সাহসী দুই বোন আনোয়ারা বেগম এবং মনোয়ারা বেগম? সশস্ত্র যুদ্ধে পাকবাহিনীর সদস্যদের পরাস্ত করেছেন তারা। বড় ভাই আবদুর রশিদসহ দুই বোন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ায় পাকসেনারা তাদের মাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু তার পরও পিছু হঠেননি এই বীর দুই মুক্তিযোদ্ধা বোন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি ছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য এলাকায় মানুষের কাছে গিয়ে সাহায্য চান এবং সাধ্য অনুযায়ী বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা পাঠান তাঁরা? ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর নির্বাচনের আগে দক্ষিণাঞ্চলের অবস্থা দেখতে যান? বঙ্গবন্ধু সরদার আব্দুর রশীদ এবং তাঁর দুই বোনের আন্দোলন সংগ্রামের কথা জানতে পেরে তাঁদের বাসায় যান এবং দুই বোনের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন?

১৯৭১ সালে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্রী আনোয়ারা এবং মনোয়ারা? ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এলাকার তরুণদের সাথে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন তারা? এলাকায় বেশ কিছু বাংকার তৈরি করেন? তিন ভাইবোন পটুয়াখালী জুবিলী কলেজের মাঠে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ২৬ মার্চ থেকে প্রায় এক মাস অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন? এ খবর পাকিস্তানি হানাদার ও শান্তি বাহিনীর লোকদের কাছে পৌঁছায়? তারা এই দুই বোনকে ধরতে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে?
একাত্তরের ১১ এপ্রিল পটুয়াখালী আক্রমণ করে পাকবাহিনী? পাকিস্তানী মেজর নাদের পারভেজ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে? মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়? মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অনু ও মনু?
এক আত্মীয়ের বাসায় মাকে রেখে ওই রাতেই তারা অন্যত্র চলে যান? সে রাতেই হানাদার বাহিনী তাদের মাকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে প্রথমে গলাচিপা থানা এবং পরে পটুয়াখালী সদর থানায় চালান করা হয়? তখন এলাকায় ঘোষণা করা হয় অনু ও মনুকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ ভরি স্বর্ণ পুরস্কার দেওয়া হবে?

এই পরিস্থিতিতে এই দুই বোনকে আশ্রয় দিতে অনেকেই আপত্তি জানায়? তবে নিশানবাড়িয়ার সফিউদ্দিন বিশ্বাস নামের একজন পীর তার মুরিদদের নির্দেশ দেন তাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য? তারাও আশ্রয় দিতে ভয় পাচ্ছিল? একদিন তারা এই দুই বোনকে আগুনমুখা নদীর তীরে একটি গভীর জঙ্গলে রেখে আসে? সেখানে তিন দিন না খেয়ে অবস্থান করেন তারা?

আনোয়ারা অনু এবং মনোয়ারা মনু

তাদের খুঁজতে খুঁজতে ওই জঙ্গলেও হানাদার বাহিনী এবং রাজাকাররা গিয়ে হাজির হয়? একদিন প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন তারা? পীরের মুরিদ হেলাল নামের এক যুবক জানত তারা কোথায় লুকিয়ে আছে? হেলালকে সঙ্গে নিয়ে পাকসেনারা জঙ্গলের ভেতর যায়? খুঁজতে খুঁজতে তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গায় এসে পড়ে? হেলাল তখন ওখানে বিষধর সাপ আছে বলে পাকসেনাদের মিথ্যে বোঝায়? হেলালের কথা পাকসেনারা বিশ্বাস করে ফিরে যায়? পরে পীরের লোকজন ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন সাব সেক্টরের প্রধান মেজর জিয়াউদ্দিনের কাছে তাদের বিপদের খবর পৌঁছে দেয়? অস্ত্রশস্ত্রসহ তিনটি বোটে করে একদিন রাত ২টার দিকে মেজর জিয়াউদ্দিন একদল মুক্তিযোদ্ধা পাঠান? তারা এসে অনু ও মনুকে উদ্ধার করে নিয়ে যান?
এ সময় দুই বোনের অল্প বয়সের কারণে তাদের যুদ্ধে না যাওয়ার পরামর্শ দেন মেজর জিয়াউদ্দিন? কিন্তু তার সেই পরামর্শ তোয়াক্কা না করে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে নিজেদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে দেন তারা? দীর্ঘ নয় মাস নানা প্রতিক‚ল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মাঝে যুদ্ধ করেন আনোয়ারা এবং মনোয়ারা বেগম?

৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন তারা দু’বোন? প্রথমে সৈনিক ইসমাইল মিয়া ও পরে মেজর জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন দুজনে? প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল গ্রেনেড নিক্ষেপ, স্টেনগান, স্টেন মেশিন কারবাইন, স্টেন মেশিনগান, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, লাইট মেশিনগান চালনা প্রভৃতি? মূলত স্টেন মেশিন কারবাইন বহন করতেন তারা?
বড় ভাই আরো প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান? দুই বোন সুন্দরবনে সেন্ট্রির কাজ, অপারেশনের রেকির কাজ করেন? সুন্দরবন, শরণখোলা, রায়েন্দ, নামাজপুর, তুশখালী, কাকছিঁড়া, ডোবাতলা, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধ করেন তারা?
যুদ্ধের সময়ের একদিনের করুণ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘ সাত মাস সুন্দরবন এলাকায় যুদ্ধ করেছি আমরা? সেখানে প্রায় ১১ শ’ মুক্তিযোদ্ধা ছিল? ঈদের দিন আমাদের কোনো খাবার ছিল না? আমরা সারাদিন না খেয়ে ছিলাম? এতগুলো মুক্তিযোদ্ধা না খেয়ে থাকবে তা হয় না? তুশখালীতে অভিযান চালিয়ে গুদাম থেকে চাল নিয়ে আসি? এরপর রান্না করে খাবার খাই সবাই?’

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একদিন আনোয়ারা বেগমরা জানতে পারেন, বেশ কয়েকজন মেয়েকে ফাতরারচরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে? এ তথ্য জানামাত্রই তারা হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন? প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর ৩৫ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে? রাজাকারদের তিনটি ক্যাম্প দখল করে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ নির্যাতিত মেয়েদের সেখান থেকে উদ্ধার করেন তারা?
দেশে স্বাধীন হলে দুই বোন আবার পড়াশোনা শুরু করেন। মনোয়ারা বেগম মনু ৭২ সালের পটুয়াখালী মহিলা কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় এসে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে হত্যার সাথে সাথে এই দুই বোনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং তারা পুলিশি হয়রানির শিকার হন। কিছুদিন ঢাকায় লুকিয়ে থাকার পরে মনোয়ারা পটুয়াখালী চলে যান এবং এরপরে তাঁর আর ডাক্তারি পড়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাটক করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালে তিনি একই বিষয়ে নাটক উত্তর পাশ করেন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আনোয়ারাকে ২০১৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্বর্ণপদক দেয় ‘ড. এমএ ওয়াজেদ মিঞা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।’ মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পান একাধিক সম্মাননা পদক।
১৯৮৪ সাল থেকে মনোয়ারা বেগম সমবায় অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। সমবায়ের মাধ্যমে তিনি আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য মহিলাদের সচেতন করে তোলেন এবং নিজের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পটুয়াখালী জেলায় ২৫টি বৃত্তহীন মহিলা সমবায় সমিতির গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি বয়স্ক শিক্ষার প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। ১৯৮৯ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় কিন্তু ছ’মাস পরে তিনি আবার তার চাকরি ফিরে পান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ারা মনু ২০১৯ সালের ১৩ই অক্টোবর মৃত্যবরণ করেন। আমৃত্যু এই সাহসী যোদ্ধা বাংলাদেশের নারীদের জন্য এবং মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটির সাথে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে থেকে সমাজসেবা করে গিয়েছেন।