সাজ্জাদ আলী : সেদিন ভোরে ফেসবুক খুলতেই দুঃসংবাদটা চোখে পড়লো। আমাদের চামেলীর বাবা আর নেই। আহারে, বেচারা চামেলী! এই তো গত মাসে বাংলাদেশে গিয়ে বাবাকে দেখে এলো। সুস্থ মানুষটা, মানে ওই বয়সের তুলনায় সুস্থ। রাতে ঘুমিয়ে সকালে আর জাগেননি। চামেলী তার একমাত্র সন্তান। সে যে কতটা ‘বাবা-অন্ত প্রাণ’, তা আমরা ওর বন্ধু স্বজনেরা সবাই জানি। বাবা হারানোর বেদনা কারোরই কম নয়, কিন্তু চামেলীরটা যেনো অন্যরকম। ওদের বাবা-মেয়ের এটাসমেন্টটা ছিলো অতি মাত্রায় কাছাকাছি। যে কদিন সে দেশে ছিলো, প্রাণ ভরে বাবার সাথে ছবি তুলেছিলো। হাটঁতে ছবি, বসতে ছবি, খাওয়ার ছবি, চলার ছবি, বলার ছবি। শুধু ছবি, ছবি আর ছবি। চামেলীর ছবিতে ফেসবুক তো একেবারে ছয়লাব। সে সব ছবি বন্ধুরা কেউ মিস করলে, মানে ‘লাইক’ না দিলে, চামেলী নাখোশ!
সকালে ঘুম থেকে জেগে বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাবাকে ফোন করবে। এরপরে কাজে যাবার সময়ে যতক্ষণ গাড়ি চালাবে, ততক্ষণ বাবা মেয়ের কথা চলবে। লা ব্রেকে একবার ফোন। আবার কথা বলতে বলতে রাতে ঘুমুবে। ভাগ্যিস চামেলীর বাবা অবসর জীবনে ছিলেন! নইলে সারাদিনের এত ফোন কল তিনি এটেন্ড করতে পারতেন না। দৈনন্দিন জীবনের রকমারি কথামালা মেয়ের পেটে জমে থাকে। এই যেমন, আব্বা, আইজ কয়ডা সিগারেট খাইছো, সত্যি কথা কবা কিন্তু? কাল বিকালে ভিজা লুঙ্গীডা ছাদে নাইড়া দিছিলা, তা মনে কইরা উঠাইছিলা তো? বড় খালারে তুমি আর ফোন কইরো না, সে খালি উল্টাপাল্টা কথা কয়। মোড়ের দোকানদার সব কিছুর দাম বেশি নেয়। টুকটাক যা কিছু লাগে, তা বাজার থেকেই কিনা আনবা ইত্যাদি সব কথা চামেলীর।
প্রতিটা মানুষেরই মনে-জমা কথা শোনানোর মানুষ চাই। এই জগত সংসারে বাবা ছাড়া চামেলীর কথা মন দিয়ে কেউ শোনে না। সে একটু পাগলাটে টাইপের। তার সাথে চলাটা খুব সহজ কাজও না। অতি মাত্রায় আবেগী। পানের থেকে চুন খসলে, হয় রেগে যাবে; নইলে কেঁদেকেটে একাকার। কথায় কথায় গাল ফুলায়। বলতে গেলে চামেলীর গাল সব সময় ফুলেই থাকে। ওরা স্বামী-স্ত্রী সংসার করছে বটে, তবে পরস্পরের চিন্তা জগতের মিল নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে রং ম্যাচ। দুজনেই ভাল মানুষ, কিন্তু দুই রকমের ভাল। একজন কথা বলতে পছন্দ করে, আরেকজনের পছন্দ নিরিবিলি। একজন সিনেমা দেখার পোকা, অন্যজন হিন্দি সিরিয়াল। একজন সন্তান চায়, কিন্তু আরেকজন তা ঝামেলা মনে করে। একজন ঘরে রাধা মাছ-ডাল খেতে চায়, আরেকজন দোকানের ফাস্টফুডের জন্য পাগল। এক কথায় বলা যায়, দুই মেরুর দুই বাসিন্দার এক বাড়িতে বসবাস।
তো চামেলীর এমন বিপদের দিনে তার পাশে দাঁড়াতে মন চাইলো। আধাবেলা অফিস কামাই করবো ঠিক করলাম। দুই প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানি কিনে ওর বাসার দিকে রওনা হলাম। গিয়ে দেখি বসার ঘর বন্ধু স্বজনে ভরপুর। চামেলীকে ঘিরে বসে আছে সবাই। কোহিনুরের ঘাড়ে মাথা রেখে পড়ে আছে চামেলী। প্রায় অচেতন সে। খানিক বাদে বাদে চেতন ফিরলেই হাউমাউ করে কাঁদছে। শম্পা আর দেবকী ওকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। অন্য সব বন্ধুদের প্রায় সবার চোখেই জল। সব মিলিয়ে এক বেদনা বিধুর পরিবেশ।
আমি ঘরে ঢোকার সময়ে দরজা খোলার শব্দ হলো। চোখ মেলে আমার দিকে চাইলো চামেলী। ওর এমন কষ্টমাখা মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি। হাঁটতে হাঁটতে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে ওর কান্নার বেগ বেশ খানিকটা বাড়লো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার হাতে ওটা কী?
বললাম, তেমন কিছু না। একটু খাবার এনেছিলাম তোমাদের জন্য।
কী আনছো? আবার বিরিয়ানি আনো নাই তো? সবাই খালি বিরিয়ানি আনতিছে!
বড়ই আশ্চর্য ঠেকলো! বাবার মৃত্যু শোক ছাপিয়ে সে খাবারের পোটলার খবর নিচ্ছে! প্যাকেটটি ওর হাসবেন্ডের হাতে দিয়ে চামেলীকে বললাম, তুমি যা খেতে চাও, তাই ব্যবস্থা করবো। এখন বলোতো কাকাজানের দাফন হচ্ছে কোথায়?
আমার প্রশ্নের জবাব না বলে চামেলী আবার কান্না জুড়ে দিলো। কাঁদছে আর বলছে, একটা টেলিভিশন চ্যানেলও আব্বার মরার খবর দিলো না। ওগো তো উচিত ছিলো আব্বার লাশ লাইভ দেখানো। ওই মানুষটা কত টকশো করছে ওদের জন্যি। সব বেইমান! এটুকু বলে আবার অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো চামেলী।
আমাদের বন্ধু কামরুল শান্তনা দিয়ে বললো, এত সব ভেবো না তো চামেলী। টেলিভিশন কী দেখালো আর না দেখালো, তাতে আর কী এলো গেল? মানুষটাই তো আর নেই। তুমি বরং দেশে ফোন করো। তোমার আত্মীয়রা দাফন কাফনের কতদূর কী করলো, সেই খবর নাও।
এ কথা চামেলীর মনঃপূত হলো না। কান্না থামিয়ে সে কামরুলকে বললো, ওইডা তুমি বুঝবা না। টেলিভিশনে লাইভ দেখানোর আলাদা একটা স্ট্যাটাস আছে। এটুকু বলে আবার শুরু করলো কান্না।
বেশ বিরক্ত লাগছে আমার। পিতৃশোকের মধ্যে টেলিভিশন স্ট্যাটাসের কথা কেমনে মানুষের মনে আসে? কিন্তু চামেলী আমাদের আপনারজন। বিরক্তি তো আর প্রকাশ করা যায় না। তাছাড়া, সংসারে কত রকমের মানুষ, শত রকমের তাদের ভাবনার জগত। কে সঠিক, আর কে বেঠিক, তা আমি বলার কে? চামেলীর স্বামী ইকবালকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাফন কাফনের কী হচ্ছে, সে খবর কিছু জানো? চামেলী কী দেশে যেতে চায়? টিকিটের ব্যবস্থা করবো?
আমার কথার জবাব দেবার আগেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্বজনদের মধ্যে কেউ একজন ফোন করে থাকবে, কথা শুনে তাই মনে হলো। ইকবাল বলছে, খাবারদাবারের দরকার নাই, শুধু আপনারা আসেন। চামেলীর সাথে কিছুক্ষণ থাকেন, সেটাই এখন দরকার আমাদের।
চামেলীর কান্না থেমে গেল। সে হাতের ইশারায় স্বামীকে কাছে ডেকে নিচু গলায় বললো, আরে এইগুলান কী কও? খাবার আনলে আনুক। ওনাগো মাছের আইটেম আনতি কও। গরুর গোস্ত, মুরগি, এগুলা সবাই আনছে, ফ্রিজ ভরা আছে। কও যে যদি পারে তো কাইল যেনো মাছের তরকারি পাঠায়। আইজ না আনাই ভাল, ফ্রিজে রাখার জায়গা নাই।
চামেলীর এই সব কথাবার্তা শুনে উপস্থিত সবার তো আক্কেল গুড়–ম। এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এতটা শোকাতুর মানুষের মনে গুরুর গোস্ত, মুরগির মাংস, মাছের ঝোলের ভাবনা ঢোকে কী ভাবে? মানুষ কতই না বিচিত্র!
ততক্ষণে আমি বসার ঘরের একেবারে দক্ষিণ কোণায় একখানা চেয়ার খালি পেয়ে বসেছি। পাশের চেয়ারেই মঞ্জু বসে মুখ টিপে হাসছে। ওর হাসবার কারণ বুঝতে কারোরই বেগ পাওয়ার কথা না। তবুও বললাম, ওই ফাজিল, মরা বাড়িতে মিটির মিটির হাসতেছিস ক্যান?
সামালে নিলো মঞ্জু। বললো, চেয়ে দেখ ওর মুখখানার দিকে? ভাবতে পারিস, আমাদের চপলা চামেলী আজ কতটা শোকাতুর?
আমি খানিকক্ষণ মাথা দুলিয়ে মঞ্জুর কথায় সম্মতি জানালাম।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)