ভজন সরকার: (১)
এক বিরাট জ্ঞানী-গুণী সাহিত্যবিশারদ ও দেশপ্রেমিক ভদ্রলোক বড় গর্ব ভরে বলছিলেন, “তিনি প্রায় এক যুগ ধরে প্রতি বছর নিউইয়র্ক-টরন্টো-লন্ডন-সিডনিতে আসেন। বাংলা সংস্কৃতি বিকাশের কথা বলেন। বইমেলাসহ নানান সাংস্কৃতিক আয়োজনকে উৎসাহিত করেন।”
অনেক ক্ষণ ধরে শুনছিলাম। শেষে ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। বিনীতভাবে বললাম, “জীবনে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জ-ধামরাই-নরসিংদী-মুন্সিগঞ্জ কখনো গেছেন বাংলা সংস্কৃতি বিকাশের কথা বলতে? বইমেলা বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সাথে জড়িয়েছেন কি ঢাকার বাইরে কখনো?”
ভদ্রলোক চমকে গেলেন। বললাম, “শুনুন, আমরা যারা আমেরিকা-কানাডা-ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রান্ট তাদের দিয়ে আর যাই হোক দেশের সংস্কৃতির বিকাশ হবে না, এটা হলফ করে আমি যেমন বলতে পারি, আপনারা যারা আসেন তাঁরাও জানেন। কিন্তু তবুও আপনারা আসেন ছেলেমেয়ে-আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে এবং ঘুরতে।”
ভদ্রলোক কমিউনিষ্ট। মহা ধুরন্ধর।আমার কথার টোন বুঝতে পেরে সরে গেলেন একপাশে। সেদিনই খুব মনে পড়ছিল এক ভদ্রলোকের কথা। তিনি প্রয়াত কমরেড জসিমউদ্দিন মন্ডল। আমার দেখা এক বিশুদ্ধ জননেতা।
কমরেড জসিম মন্ডল এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,
“যে কথা আমরা ঢাকায় বলি, সেটি যদি গ্রামে না নিয়ে যাই, আমতলা, বাঁশতলা, কাঁঠালগাছের নিচে, হাটে, ঘাটে, মাঠে, গ্রামের মানুষের কাছে না নিয়ে যাই, তাহলে কিভাবে হবে? সে জন্য ঢাকায় আসতে চাইনি।”
কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও তিনি কোনোদিন ঢাকায় স্থায়ী আবাস গাড়েননি, থেকেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে, প্রান্তিক মানুষের পাশেই। অথচ পাশ্চাত্যকে কমিউনিস্টরা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বলেন। সেই পাশ্চাত্যে এসে দেখছি, বাংলাদেশ ও ভারতের বাঘাবাঘা কমিউনিস্টদের ছেলেমেয়েরা এই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের আঁচলেই আশ্রয় নিয়েছেন। এমন দ্বিচারি এবং ধান্ধাবাজ আমাদের উপমহাদেশের অধিকাংশ কমিউনিস্ট। আজ বাংলাদেশে মৌলবাদ-জংগীবাদ-অপসংস্কৃতি, সা¤প্রদায়িকতা কিংবা স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থানের কথা বলি কিন্তু জসিম মন্ডলদের কথা কেউ মনে রাখি না।
’৭০ এবং ’৮০-র দশকে বাংলাদেশের প্রগতিশীল দলগুলোর শ্লোগান ছিল, “মার্কিনীদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও”, “সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও”। অথচ সেই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন দেশেই বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের শাখা আছে। সাম্রাজ্যবাদের স্বর্গরাজ্য দেখতেই এসব সংগঠনের নেতারা ভ্রমণে আসেন, ছেলেমেয়েদের অভিবাসনের জন্য পাঠিয়ে দেন, চাঁদা তুলে বাংলাদেশে সংগঠন পরিচালনা করেন। এই দ্বিচারিতাকে কী নামে অভিহিত করবো জানি না।
(২)
বাংলাদেশের বাতাসে আবার ভোটের গন্ধ। ভোটের সময় না এলে আওয়ামি লিগ এবং বিএনপি এইসব নন-কমিউনিস্ট দলগুলোর চরিত্রও বোঝা যায় না।
সারা মুল্লুক জুড়ে লাখ লাখ ভোট। সে সব পাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি। কিন্তু শহরতলিতে বাসকরা হতদরিদ্র শ’খানিক হিন্দুর ভোট যেন সবার পৌত্রিক সম্পত্তি। সবার অধিকার। সবার জোরজবরদস্তি, সবার রক্তচক্ষু ওই নগন্য ভোটেই।
আওয়ামি লিগ গোপনে বলে, “মালাউনের বাচ্চা, আমরা না থাকলে বিএনপি-জামায়েত তগো মাইরা তকতা বানাইতো। তাই ভুট আমাগো না দিলে তাকাইয়া তাকাইয়া দেখুম কেমনে বিএনপি-জামায়েত তগো ইন্ডিয়ায় পাঠায়।”
আবার বিএনপি প্রকাশ্যেই বলে, “হালার পুত মালাউন, এবারও যদি নৌকায় ভোট দিবার মন স্থির কইরা থাকস তবে কাউরে যেন ভুট কেন্দ্রে না দেহি। কেউ ভুট কেন্দ্রে গেলে যদি জিতবার পারি একটা একটা কইরা মুসলমানি করাইয়া দিমু। ৭১ এ বাঁচাইছি, বাবরি মসজিদের সময় বাঁচাইছি, ২০০১,২০১৪ সালে রেপ করছি কিন্তু জানে ত মারি নাই। এবার দেহি তগো কোন আম্লিগে বাঁচায়…”।
বলতে পারেন এ চিত্র হয়ত সর্বত্র নয়, তবে বাংলাদেশের অনেক জায়গারই। ‘৯২ সালের কাহিনি অনেকেরই মনে থাকার কথা। বরিশালের এক কেন্দ্রে বামের বাম, তস্য বাম রাশেদ খান মেনন সাহেব প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিলেন আওয়ামি লিগ প্রার্থী হরনাথ বাইনের সাথে। অভিযোগ আছে মেনন সাহেব সর্বহারাদের ভাড়া করে হিন্দু গ্রামে গ্রামে ভোটের দিন সকালে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলিয়েছিলেন, “ঘর থেকে বেরুলেই শেষ”। মেনন সাহেব ভোটে জিতেছিলেন।কথিত আছে যে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে সর্বহারাদের ভাড়া করেছিলেন। পরে সে টাকা দিতে অস্বীকার করাতেই ভোটের ক’মাস পরেই ঢাকায় গুলীতে আহত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে করে বেঁচে উঠেছিলেন মেনন সাহেব।
তাই বলছিলাম, গরীব মানুষের বউ যেমন সবার ভাবী, তেমনি হিন্দু ভোটারদের অবস্থাও। অনেকের কাছে শুনেছি, ‘৭৩-এ যদিও সবাই জানে নৌকা জিতবে, তবুও যে দু’দশ জন মাত্র ন্যাপ বা কমিউনিস্টের সমর্থক তারা যেন কুঁড়েঘর মার্কায় ভোট না-দিতে পারে, অনেক জায়গার আওয়ামি লিগের নেতারা ওই ভোটগুলোই সকালবেলায় নিজেরাই সিল মেরেছিল। তারপর জিয়া কিংবা এরশাদ? এদের ভোটের ইতিবৃত্তের কথা বলতে নিজেরই লজ্জা লাগে, গা গুলিয়ে আসে।
খালেদা-হাসিনা আর ভোট স্বর্গের মেওয়াফল তত্ত¡াবধায়ক সরকারগুলো? তাঁরা সবার জন্য লেবেল-প্লেয়িং ফিল্ড করলো কিন্তু অসহায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়? তাদের ভোট? তাদের ভোট পরবর্তী নিরাপত্তা?
সব রসুনের এক গোড়া। কেউ কথা রাখেনি। নিরাপত্তা দেয়নি কোন সরকারই। ২০০১ বা ২০১৪ সাল সবাই ভুলে গেছি। বরিশাল-ভোলা-মানিকগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ-যশোর-চাঁদপুর-কুমিল্লা কোথায় হয়নি অত্যাচার-ধর্ষণ-লুটপাট?
অনেকেরই মনে আছে, ২০০১ এর পরে সংসদে একজন বলেছিলেন, ভোলাতে ধর্ষণের ফলে অনেক নারী গর্ভবতী হয়েছেন। এর উত্তরে বিএনপির এক মন্ত্রী অসভ্যভাবে ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “আগে জানতাম না হিন্দু রমনীরা এতো উর্বর; এখন জানলাম।”
সরকার যায়, সরকার আসে।সবাই মুখে অসা¤প্রদায়িকতার বুলি কপচায়। অথচ ১৯৯২, ২০০১ কিংবা ২০১৪ সালের ঘটনার বিচার দূরে থাক ঠিক মতো তদন্ত পর্যন্ত হয় না। আর এখন? সে এক নির্লজ্জের উপাখ্যান!
গনতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্টের ভোটাধিকারের চেয়েও বেশী জরুরী সংখ্যালঘিষ্টের অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া। অথচ গনতন্ত্রের মুখোশপরা বাংলাদেশে যে কোনো ভোট আসা মানেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হাতের তালুতে জান-মান-ইজ্জত-সম্পদ নিয়ে বেঁচে থাকা। দ্বিচারিতায় আওয়ামি লিগ, বিএনপি, বামাতি-জামাতি সব এক।
(৩)
লেখা শুরু করেছিলাম বাঙালির দ্বিচারিতা দিয়ে। পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হ’তে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু।” অথচ নিজের দেশকে চিনি না, গ্রামকে চিনি না, মানুষকে চিনি না। নিজের মানুষের উপরে আস্থা নেই। নালিশ দেই বিদেশীদের কাছে। প্রতীক্ষায় থাকি বিদেশীরা ক্ষমতায় বসাবে। বিদেশীরা আমাদেরকে নাকে খত দিয়ে ভালো মানুষ বানাবে; নীতিবান মানুষ, সত মানুষ বানাবে।
জানি না, অনেকে সত্যিই জানি না, একটি জাতিসত্বার এমন অবক্ষয় হয় কীভাবে?
(ভজন সরকারঃ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)