ডঃ বাহারুল হক : পৃথিবীটা নানা অঞ্চলে বিভক্ত। এক এক অঞ্চলের এক এক বৈশিষ্ট, এক এক রুপ। সেগুলোর প্রত্যেকটিতে আবার চক্রাকারে বছর ব্যাপি আবর্তিত হচ্ছে নানান রকম ঋতু। একটা ঋতুর নির্গমনের সাথে সাথে আগমন ঘটে আরেকটা ঋতুর। প্রতি বছর অঞ্চল ভেদে কোথাও তিনটি, কোথাও চারটি, কোথাও পাঁচটি, এমন কি কোথাও ছয়টি ঋতুর চক্রাকারে আগমন – নির্গমন ঘটে। এই যেমন বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আছে ছয়টা ঋতু- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, তারপর বসন্ত। প্রত্যেকটা ঋতুর আছে সুস্পস্ট কিছু বৈশিষ্ট। বৈশিষ্টগুলো উপস্থিত থেকে জানান দিয়ে যায় সে অঞ্চল কোন ঋতুর বন্ধনে এখন আবদ্ধ। তবে কোন কোন ঋতুর বৈশিষ্ট আবার বেশ প্রকট। কানাডার ঋতুগুলোর মধ্যে উইন্টার বেশ প্রকট। এ ঋতু এত প্রকট যে বছর ব্যাপি এ ঋতুর প্রভাব অন্য ঋতুগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। সে জন্য কানাডাকে বলা হয় শীত প্রধান একটা দেশ। বাংলাদেশে আবার বর্ষা অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে বেশি দাপুটে। বাংলাদেশে বৃষ্টি বাদল শুধু বর্ষা ঋতুতে সীমাবদ্ধ নয়। শীতসহ অন্য ঋতুগুলো বৃষ্টি মুক্ত নয়। সে জন্য বাংলাদেশকে বলা হয় বৃষ্টি বাদলের দেশ। কানাডায় ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করে অক্টোবর মাস থেকে। তাপমাত্রা ক্রমশঃ কমতে থাকে। ডিসেম্বরে তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে নেমে যায় এবং তুষারপাত শুরু হয়।

ভালোভাবে দেখা যায় জানুয়ারি মাসে; ফেব্রæয়ারি মাসে একেবারে বেহাল অবস্থা; তুষারপাত তো থাকেই, তার সাথে থাকে কখনো কখনো তুষার ঝড়। তুষারপাত চলে মার্চ হয়ে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। তবে মার্চ থেকে তুষারপাতও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। মে মাসে দু একদিন বরফ পড়লেও তা একেবারে অনুল্লেখযোগ্য। সে হিসেবে মে মাস মোটামুটি বরফ মুক্ত। তারপর জুন মাস আসে। প্রকৃতির তখন অন্য রুপ। ঠান্ডা তামন নাই। ফুস্প-পত্রহীন গাছগুলোতে বরফের কোন চিহ্ন নাই; গাছগুলো বরং পাতা ফুলে ভরে উঠতে শুরু করে। দিনগুলো রোদেলা হয়। মানুষ হয় গরম কাপড়ের ভার মুক্ত। তাহলে জলবায়ু নিয়ে ভাবলে দেখা যায় কানাডা বছরে সাত মাসই থাকে ঠান্ডার ছত্রছায়ায়। বরফে ঠান্ডায় প্রকৃতি থাকে একেবারে জেরবার। পত্রঝরা বৃক্ষ বলে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সব গাছ হয়ে পড়ে পত্র শূন্য। উইন্টারে পুষ্পপত্রহীন গাছ গুলো অসহায়ের মত শুধু ভার বহন করে অকেজো বরফের। বরফের আর ঠান্ডার অত্যাচারে প্রকৃতিতে নেমে আসে ত্রিসংকু অবস্থা।

এ অবস্থার উত্তরন ঘটে স্প্রীং বা বসন্তের আগমনে। আমি কানাডায় অটাম দেখি, উইন্টার দেখি, তারপর দেখি স্প্রীং। এই তিন ঋতুতে গাছগাছালির তিন রুপ। দেখি অটামে ঠান্ডা হাওয়ার আভির্ভাব, উইন্টারে পুষ্প-পত্র হীন গাছে বরফের চাপ, তারপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছগাছালির বরফ মুক্ত হওয়া তারপর ফুল পাতা গায়ে সে সব গাছের মনমোহন রুপ ফিরে পাওয়া। গাছগাছালির, তৃনগুল্মের পুষ্পাম্ভরিত রুপ সবাইকে জানান দেয় এখন বসন্ত কাল। আমি বৃক্ষ শুধু দেখিনা আমি বৃক্ষের সাথে কথা বলি। অটামে যখন পাতা ঝরা শুরু হয় তখনই শুরু হয় আমার আর বৃক্ষের মধ্যে কথোপকথন। সেই কথোপকথন কেউ শুনে না; কেউ বুঝে না।

সতেজ সুডৌল সবুঝ সব পত্রশোভিত নন্দিত অবয়বের বৃক্ষকে অটামে যখন দেখি এক এক করে পাতা ঝেড়ে ফেলে ভূষণহীন হওয়ার পথে চলছে তখন আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। ব্যকুল হয়ে প্রশ্ন করি- “কেন তোমরা বিবসনা হয়ে যাচ্ছ? কী হয়েছে তোমাদের”? বৃক্ষকুলের পক্ষ থেকে উত্তর আসে- “না, এমনি। বন্ধু উইন্টার ঠান্ডা হাওয়ায় খবর পাঠিয়েছে বিবসনা হয়ে তারই অপেক্ষায় থাকতে”। শুনে আমি আঁৎকে উঠি। বলি- “এ যে এক ভয়ংকর কথা, এক বড় নোংরা আবদার। খবরদার এ আবদার রক্ষা করতে যেওনা। তোমরা জাননা। উইন্টার একা আসবে না। কুৎসিত এক অভিলাস নিয়ে উইন্টারের হাত ধরে আসবে কালো মনের সাদা বরফ। তোমাদেরকে বিবস্ত্র বিবসনা পেয়ে দুর্মতি সম্পন্ন দেঁতো সাদা বরফ লাফিয়ে পড়বে তোমাদের গায়ের উপর। মেরুদন্ডহীন বোকা উইন্টার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে যাবে তোমাদের; তোমাদেরকে দুর্দশা মুক্ত, বিপদমুক্ত করতে এগিয়ে আসবে না দুর্বল বোকা উইন্টার। দিনের পর দিন মাসের পর মাস যাবে, তোমাদের ত্রিসংকু অবস্থা চলতে থাকবে। পরিত্রান পাবে না। উইন্টার তোমাদের দুঃখ গুছাতে পারবে না। তোমাদেরকে গভীর দুঃখ যন্ত্রনা নিয়ে ত্রাতা সামারের অপেক্ষায় থাকতে হবে। কখন সামার আসবে! কখন সামার আসবে”!

কিন্তু অপরিণামদর্শী বোকা বৃক্ষ আমার কথা শুনে না, আমার আশংকা বার্তা কানে নেয় না। বোধহীন বৃক্ষ ধীরে ধীরে তার সব বসন ভূষণ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কিসের আশায় যেন উদাম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয় দম বন্ধ এক অবস্থা। পাখির গান, মৌমাছির কোরাস, প্রজাপতির দোল নৃত্য, এসবই শেষ। বৃক্ষের গতি প্রকৃতি হাল চাল দেখে পাখি প্রজাপতি ঘর ছেড়ে পথে নামে যে পথ গিয়ে শেষ হয়েছে হাজার হাজার মাইল দক্ষিণে বরফের প্রাণঘাতি থাবা মুক্ত অঞ্চলে।

অটাম পার করে প্রকৃতি ডিসেম্বর মাসে পা রাখে উইন্টারে। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে চলে যায়। উত্তরের কন কনে হিমেল হাওয়া জানান দিয়ে যায় উইন্টার এসেছে। জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারিতে ঠান্ডা ভয়ংকরভাবে বেড়ে যায়। শুরু হয় প্রচন্ড বাতাসের গায়ে গায়ে বরফের প্রলয় নাচন। এ মদমত্ত বরফ উদাম বৃক্ষের সাথে তাই করে যা আমি আশংকা করি; যা আমি বৃক্ষকুলকে আগাম বলে রাখি। সে বরফ নাচতে নাচতে ঝরে পড়ে উদাম বৃক্ষ, অচেতন মাটি আর মাটির বুকে পড়ে থাকা অসহায় ঘাসের উপর। বরফের নির্দয় আচরণ চলতে থাকে। সাদা মদমত্ত বরফের প্রবল চাপে ভারে ঘর্ষনে মন্থনে দলনে নিপিড়নে উদাম বৃক্ষরাজি আর দম নিতে পারে না। অচৈতন্ব বেশে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা বুকে নিয়ে শুধু অপেক্ষায় থাকে কখন সামার আসবে। বীরবর সামার যদি তার চামরীর উষ্ণ হাওয়ায় গলিয়ে দেয় নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই অত্যাচারী বরফকে।

মার্চ থেকে ঠান্ডার দাপট কমতে থাকে। তাও তাপমাত্রা নেমে থাকে হিমাংকের নিচে। আসে এপ্রিল। তাপমাত্রা বেড়ে বার চৌদ্দ ডিগ্রি হয়ে যায়। তবে নিন্মতম থাকে চার ডিগ্রির মত। তারপর আসে মে মাস। এ সময়ও ঠান্ডার প্রকোপ অনুভুত হয় যদিও তাপমাত্রা দশের নিচে সাধারনত নামে না। জুন থেকে প্রকৃতি ঝক ঝকে রুপ ফিরে পেতে থাকে। বাতাসেও থাকে একটা চনমনে ভাব। ফুলে পাতায় বৃক্ষ সুশোভিত হয়ে যায়। এ সুসজ্জিত হওয়ার গতি অতি দ্রæত। দুর্বা ঘাস, লতা, গুল্ম থেকে শুরু করে মহীরুহ; ক্ষুদ্র পতঙ্গ থেকে বিশাল পক্ষি সবাই বুঝে হাতে সময় কম। দেরি করার কোন সুযোগ নাই। নেমে পড়তে হবে কাজে। কী কাজ? সেই আদি অকৃত্রিম কাজ; বংশ বিস্তারের নিবিড় নিপুন কাজ। জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আবহাওয়া বলা যায় মনোরম। এ মাসগুলোতে তাপমাত্রা চৌদ্দ থেকে আটাশ ডিগ্রির মধ্যে উঠা নামা করে। অক্টোবর থেকে আবার শুরু হয় তাপমাত্রার নিন্ম গতি। তাহলে কী দেখা গেল? দেখা গেল শীতটাই এখানে মুখ্য। শীতের কাছে অন্য সব ঋতু গৌন। এদেশে উইন্টারের আগমণ নির্গমন, বরফের নানা রুপ, বরফআচ্ছাদিত প্রকৃতি পরিবেশ এসব নিয়ে গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস কেমন লেখা হয়েছে বা এই প্রতাপশালী ঋতু ও এর উপাদান এদেশের মানুষের মনকে কিরুপে ছুঁয়েছে বা আদৌ ছোঁয় কিনা আমি জানি না। যদি এই শীত বরফ মানুষের অন্তরকে স্পর্শ না করে মানুষের মনকে নাড়া না দেয় তাহলে বুঝে নেব এদেশে শীত প্রকৃতির, জন- মানুষের নয়।

এবার বাংলাদেশে ফিরে যাই। আগেই বলেছি বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত বসন্ত এই ছয় ঋতু নিয়ে বাংলাদেশের ঋতুবৃত্ত গঠিত। তাই বলে কী বাংলাদেশে জমিদারের মত ছড়ি ঘুরায় না কোন বিশেষ এক ঋতু? ঘুরায়, অবশ্যই ঘুরায়। আর সেই প্রবল প্রতাপশালী ঋতুর নাম বর্ষা ঋতু যার বৈশিষ্ট হলো বৃষ্টি বাদল। বৃষ্টি কী শুধু বর্ষা ঋতুতে হয়? না, ভিন্ন চরিত্রের অন্য ঋতুতেও বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি সবচেয়ে বেশি হয় জুন, জুলাই আর আগষ্ট মাসে (৩০০ মিঃ মিঃ-এর অধিক)। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসের বৃষ্টিকে হিসেবের মধ্যে না আনা ভালো। এ তিন মাসে গড় বৃষ্টিপাত ৫০ মিঃ মিঃ-এর কম। এপ্রিল থেকে অক্টোবরের বৃষ্টিপাতকে হিসাবে আনতে হয়। কারণ এ মাসগুলোতে গড় বৃষ্টিপাত ১০০ মিঃ মিঃ-এর বেশি। অতএব, জুলাই-আগষ্ট এ দুই মাস নিয়ে বর্ষা কাল হলেও বর্ষা আসলে বিরাজ করে এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সাত মাস ব্যাপি। সেই জন্য বাংলাদেশকে বলে বর্ষার দেশ, বৃষ্টি বাদলের দেশ, যে কারণে কানাডা শীতের দেশ। বর্ষা বান আনে; নদী ভাঙ্গে; নদী তীরের মানুষ সর্বহারা হয়। সে বিচারে বর্ষা মানে দুঃখ। অথচ কী আশ্চার্য, বর্ষার সাথে বাংলাদেশের মানুষের সব থেকে বেশি সখ্যতা। বর্ষা মানুষের মনকে সব থেকে বেশি নাড়া দেয়; মনের মধ্যে নানা ভাব সৃষ্টি করে। সে সব ভাব অভিব্যাপ্ত হয়েছে গানে, গল্পে, কবিতায়, নাটকে, নৃত্যে, রাগে। বর্ষা বাংলা সাহিত্যকে, বাংলা সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু শীত প্রধান দেশ ভ্রমণ করেছেন। ঠান্ডার আক্রোশ দেখেছেন, তুষারপাত, তুষারঝড় দেখেছেন। কিন্তু তুষারপাত, তুষারঝড় তার লেখালেখির ভ‚মিতে কতটা বিস্তার লাভ করেছে? তার বিশাল সাহিত্য ভান্ডারে তুষারপাতের সৌন্দর্য বা অসৌন্দর্য নিয়ে লেখা কী পরিমাণ? তার গোটা সাহিত্য জগতে চোখ কান খোলা রেখে বিচরণ করলে দেখা যাবে তুষারপাত দেখে তিনি হয়তো সাময়িক চোখ জুড়িয়েছেন, কিন্তু ভিন দেশের তুষারপাতের দৃশ্য প্রকৃতপক্ষে তার মন ভরায়নি, তাকে সত্যিকার অর্থে বিমুগ্ধ করতে পারেনি।