সোনা কান্তি বড়ুয়া : সম্রাট অশোকের বিজয়া দশমী বা ধম্মবিজয় বেদাতীত কাল থেকেই চলে আসছে এই শারদ উৎসব। ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়। সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে এবং তার গুরু ভন্তে বিশ্বদার্শনিকতত্তে¡র মর্মভেদী দেবদূত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু মোগলীপুত্ত তিসস’র সভাপতিত্বে এই প্রচলিত শারদ উৎসবের সময় পাটলিপুত্রে সংঘটিত হয় তৃতীয় বুদ্ধধম্ম সম্মেলন “ধম্মবিজয়”। শোকাতুর রাজা ঘোষণা করেন, “’অসুপুত্ত পপৌত্ত মে নবম্ বিজয়ম বিজিতব্যম”। আমার পুত্র এবং প্রপৌত্ররাও কোন নতুন রাজ্য যুদ্ধবিজয় করবে না । যদি বিজয় করতে হয় তা হবে ধম্মবিজয় (১৩ নং রক এডিক্ট)। কলিঙ্গ অনুশাসনে তিনি লিখেছিলেন!
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে সম্রাট অশোকের হৃদয় স্পন্দনে শারদীয় বুদ্ধ পূজা প্রকৃতির অপরুপ রুপ নিয়ে বিজয়া দশমী বা শান্তির আনন্দধারায় এই জাগরণী ছুঁইয়ে দিল! ধম্মবিজয় বেদাতীত কাল থেকেই চলে আসছে এই শারদ উৎসব। সম্রাট অশোক এই ধারাকে বজায় রেখেই আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীর দিনে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন! ঘোষনষ করেছিলেন জীবপ্রেমের অমর বাণী। শারদোৎসব অনাদিকাল ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই সূচনা হল ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়। সমস্ত ধর্মের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত নীতিবোধ আছে সেই নীতিবোধকে জাগ্রত করাই ছিল সম্রাট অশোকের ধর্মের উদ্দেশ্য; সম্রাট অশোকের ধর্ম! এক কথায় তাঁর ধর্ম ছিল মানবতার প্রতি আবেদন সারা বিশ্ব জনে। অশোক ব্যক্তিগত জীবনে গোঁড়া বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু প্রজাসাধারণের কাছে তিনি যে উপদেশগুলি প্রচার করেন তা যে কেবলমাত্র বৌদ্ধধর্মের ই প্রচারপত্র ছিল তা বলা যায় না। সকল ধর্মের প্রতি উদার ও শ্রদ্ধাশীল অশোক সমস্ত ধর্মের মূল নীতিগুলোকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ধর্মের মূল কথা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। বিদেশে বৌদ্ধধর্মে প্রচারের এ ব্যবস্থাকে সম্রাট অশোক নাম দিয়েছিলেন ‘ধর্ম বিজয়’। এর ফলে শুধু ধর্মীয় যোগাযোগই নয়, ওই সব দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল!
বিশ্বমানবতায় উদ্ভাসিত জগতের মধ্যে শ্রেষ্ট সম্রাট অশোক চিরন্তন! শ্রেষ্ট সম্রাট অশোকের অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জগতের মধ্যে শ্রেষ্ট সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্র“তিগোচর করিতে চাহিয়া ছিলেন, তাহাদিগকে পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়া ছিলেন, পাহাড় কোনকালে মরিবে না, সরিবে না, অনন্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা প্রতিদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতেই থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কইবার ভার দিয়াছিলেন। তোমার কীর্তির চেযে তুমি যে মহৎ, / তাই তব জীবনের রথ,/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমারে,/ বারম্বার। / তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে,/ তুমি হেথা নাই।”
২৩০০ বছর পূর্বে সম্রাট অশোকের বুদ্ধ পূজার অমর এ্যালবাম গৌতম বুদ্ধের প্রথম ধর্মচক্র উপদেশ আজ ভারতের জাতীয় পতাকার কেন্দ্রস্থলে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায় ২৪টি দণ্ডযুক্ত (প্রতীত্যসমূৎপাদ বা সমগ্র কার্যকারণ প্রবাহ) ঘন নীল রঙের অশোকচক্র সংবলিত ভারতীয় গেরুয়া, সাদা ও ভারতীয় সবুজ এই তিন রঙের একটি আনুভ‚মিক আয়তাকার পতাকা। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই আয়োজিত গণপরিষদের একটি অধিবেশনে পতাকার বর্তমান নকশাটি গৃহীত হয় এবং সেই বছর ১৫ অগস্ট এটি ভারত অধিরাজ্যের সরকারি পতাকার স্বীকৃতি লাভ করে ।
সেলুলয়েডের পর্দায় ভারতসম্রাট অশোকের বিজয়া দশমী! বা ধম্মবিজয় বেদাতীত কাল থেকেই চলে আসছে এই শারদ উৎসব। ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। সম্রাট অশোকের রজত্বকাল ২৭৩, ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (B.C. before Christ) পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। মৌর্যসম্রাট অশোক ‘দেবানাং প্রিয়’ উপাধি ধারণ করেন। ‘দেবানাং প্রিয়’ শব্দের অর্থ হল দেবতাদের প্রিয়। সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন। সকল মানুষই আমার পুত্রতুল্য। আমার পুত্রেরা সকল মঙ্গল ও সুখের অধিকারী হোক। মানুষ ও পশুর জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়, বিশ্রাম গৃহ, ঔষধি ফলমূল, লতাগুল্ম রোপণ, পানীয় জল ও কৃষিকার্যের জন্য সরোবর খনন শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং এগুলিকে সুচারু রূপে পরিচালনার জন্য তৈরি করলেন বুদ্ধবিহার। তিনি ৮৪ হাজার জনকল্যাণকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সমস্ত জীব জগতের জন্য উৎসর্গ করলেন। কালজয়ী ধম্ম প্রচারকদের প্রেরিত করলেন সমগ্র বিশ্বে। মানব মনে প্রেম, ভক্তি, দয়া, করুণা স্থাপন করে সিঞ্চিত করলেন ভগবান বুদ্ধের চিরন্তন বাণী বসুধৈবকুটুম্বকম। দ্বিতীয় গিরিলিপিতে সমস্ত সত্তার সার্বিক কল্যাণের জন্য উৎকীর্ণ করলেন তার ধম্মানুভূতি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়
“আজি এ প্রভাতে রবির কর /কেমন পশিল প্রাণের ‘পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে / প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে / জাগিয়া উঠিল প্রাণ!
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,/ ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ / রুধিয়া রাখিতে নারি।”
২৬০০ বছর পূর্বে গৌতমবুদ্ধের ভাষা আন্দোলন! গৌতমবুদ্ধ সংস্কৃত ভাষাকে বাদ দিয়ে তাঁর ভিক্ষুসংঘ এবং জনতাকে পালি ভাষায় উপদেশ দিয়ে ছিলেন। সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ভারত গোলেমালে হিন্দু ইন্ডিয়া হল কেন? ব্রাহ্মণ শাসিত সংস্কৃত ভাষার ব্রাহ্মণ্যবাদে জাতিভেদ প্রথার দুর্বৃত্তপনা! সম্রাট অশোক ব্রাহ্মণ শাসিত সংস্কৃত ভাষা বাদ দিয়ে পালি ভাষা গ্রহন করেছিলেন। অশোকের সাম্রাজ্য! সম্রাট অশোক ব্রাহ্মণ শাসিত সংস্কৃত ভাষা বাদ দিয়ে বৌদ্ধ ত্রিপিটক পালি ভাষায় প্রকাশনা প্রচার ও প্রসার করার দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমা অশোকের রাজত্বকালেই সবথেকে বেশি প্রসারিত হয়। উত্তর পশ্চিমে তাঁর সাম্রাজ্যের সীমা তৎকালীন সিরিয়ার রাজার সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু দেশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ধর্মপ্রচার সাম্রাজ্যের বাইরে: ১ শুধুমাত্র নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যেই নয় সাম্রাজ্যের বাইরে ও ভারতবর্ষে অন্যান্য রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অশোক ধর্ম দূত পাঠিয়েছিলেন। তাই সুদূর দক্ষিণে চোল, পাণ্ড্য, কেরলপুত্র ,সত্যপুত্র প্রভৃতি রাজ্য এবং উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তিনি ধর্ম দূত পাঠিয়েছিলেন। জনহিতকর কাজ! শুধু ধর্মীয় ব্যাপারেই নয় জীবজগতের সার্বিক কল্যাণ সাধনেও অশোকের দৃষ্টি ছিল প্রখর। সর্বজীবে দয়া, অহিংসার যে বাণী তিনি প্রচার করেছিলেন তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা করেছিলেন।
যাগ যজ্ঞে এবং রাজপরিবারে আহারের জন্য পশুবধ তিনি বন্ধ করেন। শুধু মানুষের জন্যই নয় জীবজন্তুর চিকিৎসা র জন্যেও তিনি দেশময় দাতব্য চিকিৎসা লয় স্থাপন করেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ যাতে সহজলভ্য হয় সেজন্য তিনি সহজলভ্য নয় এমন সব গাছপালা সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্থানে চাষাবাদের ব্যবস্থাও করেছিলেন।
পথিকদের সুবিধার জন্য রাজপথ নির্মাণ করে তার দুই পাশে গাছপালা রোপণ করেছিলেন। ক‚প ও দীঘি খনন করিয়েছিলেন, বিশ্রামাগার ও পান্থশালা ইত্যাদি নির্মাণ করিয়েছিলেন। দীন দুঃখীদের ভিক্ষা দানের ব্যবস্থাও করেছিলেন; আর এই সমস্ত কাজে যথাযথ দৃষ্টি রাখার জন্য বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিযুক্ত করেছিলেন।
মহামতি সম্রাট অশোকের পিতা বিন্দুসারের মৃত্যু পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক সিংহাসন আরোহণ করে এবং ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল! দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ছাড়া ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলই তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট অশোকের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ এইসব অঞ্চলগুলিতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশগুলির সাংস্কৃতিক চেতনাকে গভীরভাবে অনুপ্রানিত করেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোক ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসেবে বিবেচিত। মৌর্য সাম্রাজ্যের FIRST সম্রাট ছিলেন CHANDRA GUPTA – THE GREAT.
বৌদ্ধ দার্শনিকতত্তে¡র মর্মভেদী দেবদূত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তের কাছে সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ভ‚পালে সাঁচীর তোরনদ্বারের দক্ষিন তোরণের পশ্চিমের স্তম্ভের মাঝের দুটো প্যানেলে সেই মহামতি সম্রাট অশোকের তীর্থভ‚মি বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিবৃক্ষে বুদ্ধ বন্দনার অমর এ্যালবাম আজ ও অম্লান হয়ে আছে। তাই অশোক প্রচারিত ধর্মে আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ নির্বাণ লাভ প্রভৃতি বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্যে সুস্পষ্ট অনুপস্থিতি সত্তে¡ও সকল জীবের প্রতি দয়া, অহিংসা, পরধর্মসহিষ্ণুতা, সত্য কথা বলা নিজেকে সত্য রাখা, সৎ রাখা, দান, পিতামাতা গুরুজন এবং সাধু সজ্জনদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, নিষ্ঠুর আমোদ প্রমোদ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি প্রধান আচরণবিধি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। অর্থাৎ ইহজগতের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের পারলৌকিক উন্নতি বিধান ছিল অশোকের ধর্মের মূল লক্ষ্য। অশোক নিজেকে “দেবানমপ্রিয় প্রিয়দর্শী” হিসেবে অর্থাৎ দেবতাদের প্রিয় রাজা ‘প্রিয়দর্শী’ হিসেবেই পরিচয় দিতেন।
বিহারের (মগধের) পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা) প্রাচীন ভারতের রাজধানী ছিল! এই মগধ হল ষোড়শ মহাজনপদের একটি GREA STATE পদ। মৌর্যসম্রাট বিন্দুসারপুত্র অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন খ্রিস্ট-পূর্ব ২৭৩ অব্দে। ২৩২ খ্রিস্ট-পূর্ব পর্যন্ত ৪০/৪১ বছর রাজত্ব করেন। সিংহাসনে বসার ১২ বছর পরে তিনি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দ্বারা উড়িষ্যার কলিঙ্গ জয় করেন। তখন যুদ্ধই ছিল রাজ্য জয়ের প্রধান ব্যবস্থা। সেই যুদ্ধে প্রচুর লোক নিহত হয়। বিন্দুসারের সাতাশ বছর রাজত্বকালের পর এবং তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্রদের মধ্যে ‘অশোক’, ”প্রিয়দর্শী” উপাধি নিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর রাজ্য অভিষেক হয় চার বছর পরে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দে। ইতিহাসের বিস্ময় পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক! শারদোৎসব অনাদিকাল ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই সূচনা হল ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়।
সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে এবং তার গুরু ভন্তে মোগলীপুত্ত তিসস’র (Third Buddhist Sanghyana) সভাপতিত্বে এই প্রচলিত শারদ উৎসবের সময় পাটলিপুত্রে সংঘটিত হয় তৃতীয় বুদ্ধধম্ম সম্মেলন “ধম্মবিজয়”। কথিত আছে, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে অনুষ্টিত তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির শেষদিকে সম্মেলনের সভাপতি মো¹ণিপুত্ত তিস্স স্তবির বিভজ্জবাদ বা থেরবাদ প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে কথাবত্থু প্রন্থ রচনা করেন। কথাবত্থু (৫) বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কীয় তর্কশাস্ত্র বিশেষ বলা যায়। খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধগোষ ২৩টি অধ্যায়ে কথাবত্থুর উপর ভাষ্য গ্রন্থ রচনা করেছেণ। প্রত্যেক অধ্যায়ে ৮ হতে ১২টি প্রশ্ন এবয় উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নগুলো সাধারণত বিধি প্রকার জটিল মিথ্যাদৃষ্টি সম্পর্কীয়।
২৫৬৭ বছর পূর্বে শ্রীলংকার মহাবংশ এবং দ্বীপবংশ শীর্ষক ঐতিহাসিক গ্রন্থদ্বয়ের মতে রাজা বিজয় সিংহ বাঙালি ছিলেন! এবংবৌদ্ধধর্ম ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মানসে সম্রাট অশোক ২৩০০ বছর পূর্বে ‘বৌদ্ধ ত্রিপিটক সহ সম্রাটের ভারতীয় বৌদ্ধ মিশন, সম্রাট অশোকের পুত্র বৌদ্ধভিক্ষু মহেন্দ্র (মহিন্দা) এবং কন্যা ভিক্ষুনী সংঘমিত্রা বঙ্গবীর বিজয় সিংহের সিংহল দ্বীপে (শ্রীলঙ্কা) প্রেরণ করেছিলেন! সম্রাট অশোকের বিশ্বমানবতায় উদ্ভাসিত ধরনীতল!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: “অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু। জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ঠ্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভ‚তে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ঠ্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে? দীনতম দীনের দুঃখ বিমোচনের জন্য তিনি সর্বত্যাগ করেছিলেন। সমস্ত মানুষকে একান্তভাবে জেনেছিলেন বলেই তিনি সত্য।”
শান্তির ললিত বাণী সম্রাট অশোকের ব্যথিত , অনুতপ্ত হৃদয়কে শান্ত করল; দিগ্বিজয় পরিণত হলো ধর্ম বিজয়ে; রণভেরি পরিবর্তিত হলো ধর্মভেরিতে। যুদ্ধপ্রিয় রাজা পরিণত হল এক পরম মানবপ্রেমিকে । শুরু হলো ধর্মপ্রচারের মধ্যে দিয়ে ‘এক ভারত ভাতৃত্ববোধ’ নীতির প্রচার । ২৩০০ বছর পূর্বে “নানা ষড়যন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর বিদীর্ণ করে গৌতমবুদ্ধের অহিংস নীতিতে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক মানবাধিকারের ঘোষণা ছিল “অহিংসা পরম ধর্ম” শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সম্রাট অশোক বৈদিক প্রাণী হত্যা মূলক যজ্ঞ এবং জাতিভেদ প্রথা আইন করে বন্ধ করে দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন। এ ঘটনার পরবর্তী কালে সুখে ,দুঃখে অনুতাপে এবং মনুষ্য জাতির প্রতি সমবেদনায় অশোক প্রতিজ্ঞা করলেন যে জীবনে আর কখনও যুদ্ধ করবেন না।
রাজত্বের প্রথম দিকে অশোক তার পূর্বপুরুষদের অনুসৃত যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য বিস্তারের নীতি অনুসরণ করেন। রাজ্য অভিষেকের আট বছর পর ওড়িশার বৈতরণী নদী থেকে গোদাবরি সন্নিহিত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত পরাক্রান্ত কলিঙ্গ রাজ্যটি তিনি আক্রমণ করেন এবং জয়লাভ ও করেন। তবে জয়লাভ করলেও যুদ্ধের পরিণতি অশোককে বিশেষভাবে ব্যথিত করেছিল। তার ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোক উল্লেখ করে গেছেন যে সেই যুদ্ধে দেড় লক্ষ সৈন্য বন্দি হয়, এক লক্ষ্য সৈন্য নিহত হয় এবং এর বহুগুণ মানুষ মারা যায়। এই যুদ্ধে বহু নগরগ্রাম ছারখার হয়ে যায়। যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে, মড়কে কলিঙ্গ শ্মশানে পরিণত হয়। যুদ্ধের এই ভীষণ অভিশাপে সম্রাটের মনে দুঃখের প্লাবন বয়ে যায়। জীবের দুঃখ একদিন যেমন গৌতমকে পরিণত করেছিল বুদ্ধে; তেমনি কলিঙ্গ যুদ্ধ ‘চণ্ডাশোক’ কে রূপান্তরিত করল ‘ধর্মাশোকে’।
১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টবর ঠিক ওই দশমী তিথিতে বাবাসাহেব আম্বেদকর নাগপুরে ৫ লাখ লোক নিয়ে (BUDDHIST MOVEMENT IN INDIA) প্রকাশ্য মাঠে এই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে ধমমে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যুদ্ধের দ্বারা জয় নয়। অহিংসার দ্বারা জয়। এটাকেই বলা হয় অশোকের ধম্মবিজয় দিনকেই বেছে গ্রহণ করলেন বুদ্ধের পঞ্চশীল এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আজ শারদ শুক্লা দশমী। এক মানবিক ধম্ম দিশার অমলিন দিন। ১৯৫৬ সালের এই দিনে বাবা সাহেব ডঃ বিআর আম্বেদকর নিপীড়িত, নিষ্পেষিত লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে স্বধম্মে পাবত্তন করেছিলেন। এই দিনে তার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। ভারতের প্রাচীন ধম্ম দেশনার এই মঙ্গলময় ও কল্যাণকারী শারদ উৎসবের শেষ দিনে আপনাদের সকলকে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করছি। স্বধম্ম পাবত্তনের জন্য। দলিত, নিপিড়িত, লাঞ্ছিত, শোষিত বহুজন মানুষকে সাংবিধানিক রক্ষা কবচের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রেমের উচ্চ মার্গে উন্নীত করলেন।
বহির ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, ধর্ম বিজয়! রাজর্ষি অশোক কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মধ্যেই ধর্মপ্রচার করে ক্ষান্ত হননি; বিদেশেও তিনি ধর্মপ্রচারে উদ্যোগী হন। এই উদ্দেশ্যে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, সুমাত্রা প্রভৃতি দেশে ধর্ম দূত তিনি পাঠিয়েছিলেন। সিংহলে (Sri Lanka) অশোকের পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে এবং মধ্য এশিয়ায় পুত্র কুণালকে ধর্মপ্রচারের জন্য পাঠান। সে সময় সিঙ্গল রাজ সিঙ্গল বাসীদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে বিশেষভাবে প্রচেষ্টা নেন। শোন ও উত্তর নামে দুজন দূতকে অশোক ব্রহ্মদেশে পাঠিয়ে ফেলেন। এছাড়াও অশোক সিরিয়ার রাজা, মিশরের রাজা, GREEK & মেসিডনের রাজা, এপিরাসের রাজাএবং উত্তর আফ্রিকার অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রিক রাজন্যবর্গের রাজসভায় ধর্ম দূত এবং BUDDHIST MONKS প্রচারক পাঠিয়েছিলেন। বিদেশে ধর্ম প্রচারের এ ব্যবস্থাকে অশোক নাম দিয়েছিলেন ‘ধর্ম বিজয়’। এর ফলে শুধু ধর্মীয় যোগাযোগই নয়, ওই সব দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল। এইভাবে অশোকের অক্লান্ত চেষ্টা ও কর্মকুশলতার জন্য একটি ক্ষুদ্র ধর্ম স¤প্রদায় পৃথিবীর বিশালতম ধর্ম সঙ্ঘে রূপান্তরিত হয়। বুদ্ধ বন্দনার যে সকল ধর্মমত শুধু মগধ ও তার নিকটবর্তী স্থানে প্রচারিত করেছিলেন তা কেবলমাত্র প্রচারক হিসেবে অশোক তাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মে পরিণত করেন ।
বৌদ্ধ দেশ এবং বৌদ্ধ ধর্ম দখল করার নাম ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্ম! ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজনীতি বৌদ্ধ ত্রিপিটকের পালি বর্ণমালা কে ব্রাহ্মী বর্ণমালা করেছিল! প্রসঙ্গত: হিন্দু শাসক শশাঙ্ক, আদি শঙ্করাচার্য্য এবং কুমারিল ভট্ট ফতোয়া দিলেন, বৌদ্ধ মাত্রই বধ্য বা বৌদ্ধদেরকে হত্যা কর (পৃষ্ঠা ১২, দেশ, কলিকাতা, ৪ মে, ২০০১)! সভ্যতার ইতিহাসে মানবজাতি অন্যায়কে পরাভ‚ত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি অসত্যকে পরাভ‚ত করে সত্য, অকল্যাণকে পরাভ‚ত করে কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রক্রিয়ায় মূর্খতা ও অজ্ঞতাকে পরাভ‚ত করেই জ্ঞানকে জয়ী হতে হয়েছে। মানবজাতি আদিম যুগ থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে পর্যায়ক্রমে নিজেদের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। প্রকৃতিতেই সৃষ্টি এবং প্রকৃতিতেই বেড়ে উঠেছে বিধায় অন্যান্য প্রাণিক‚লের মতোই মানবপ্রজাতিও বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি নির্ভরশীল ছিল। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য গাছের ফলমূল, ক্ষুদ্র প্রাণী, পশুপাখি, পানি, মাছসহ জলজপ্রাণী আহরণ ও ভক্ষণই ছিল আদি মানুষের প্রধান কাজ।
বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং বলেছেন জ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু অজ্ঞতা নয়, বরং তা হলো জ্ঞানের বিভ্রান্তি বা বিভ্রান্তিকর জ্ঞান। জর্জ বার্নাড শ’ মানবজাতিকে বিভ্রান্তিকর জ্ঞান থেকে সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এটা ভয়ংকর। জ্ঞান উৎপাদন পুনরুৎপাদনের বাহন হলো শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষা বিস্তার ব্যতীত জ্ঞান ও জ্ঞানের যথার্থ বিস্তার সম্ভব নয়। সে কারণেই রাষ্ট্রকে শিক্ষার সামগ্রিক দায়িত্ব নিতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘শিক্ষার বিষয়টি বাজার অর্থনীতির বাইরে নিতে হবে। শিক্ষা বাজারের বিদ্যাবস্তু পণ্যায়িত হতে পারে না।’
মহাকালের বিবর্তনের ধারায় বৌদ্ধ প্রধান দেশ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক মহানগরীর বিখ্যাত রাজকীয় এমারেল্ড (মরকত মনি) বুদ্ধ মন্দিরের চারিদিক জুড়ে আছে দশরথ জাতকে রামকীর্তির অভিনব চিত্রশালা। রামায়নের অযোধ্যা কান্ডের (অধ্যায়) বত্রিশ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে (যথাহি চৌর স তথাহি বুদ্ধ, তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি।) চোর বলে গালাগাল করার পর কি সেই মহাকাব্যটি কি বৌদ্ধ জাতকের আগে রচিত? The ancient Political Hinduism পালি বর্ণমালা কে ব্রাহ্মী বর্ণমালা করেছিল কেন? বৌদ্ধদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজনীতি তাদেরকে দলিত বানিয়ে হিন্দুধর্মের নামে নীচু জাত করে মনুষ্যত্ব কেড়ে নিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতারণার রাজনীতিতে বৌদ্ধদের ভারত ভ‚মি ও দেশ দখল করার নাম হিন্দু ধর্ম! ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজনীতি বৌদ্ধ ত্রিপিটকের পালি বর্ণমালা কে ব্রাহ্মী বর্ণমালা করেছিল! ২৬০০ বছর পূর্বে গৌতমবুদ্ধের ভাষা আন্দোলন! গৌতমবুদ্ধ সংস্কৃত ভাষাকে বাদ দিয়ে তাঁর ভিক্ষুসংঘ এবং জনতাকে পালি ভাষায় উপদেশ দিয়ে ছিলেন।
হিন্দুরাজনীতি বুদ্ধের দেহকে দেখে কিন্তু বুদ্ধের উপদেশ মেনে চলে না এবং বুদ্ধের উপদেশ ছিল, “যে আমার দেহকে দেখে সে আমাকে দেখে না, যে আমার উপদেশ মেনে চলে সে আমাকে দেখে ও মেনে চলে। “হিন্দুরাজনীতির বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের জন্যে বৌদ্ধগণ by force মুসলমান হয়েছিলেন এবং ইতিহাস চুরির চাতুর্যে রামায়নের তথ্য ফাঁস : গৌতমবুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুসংঘকে উপদেশ প্রসঙ্গে দশরথ জাতক সমাধান করতে গিয়ে বলেছেন, “তখন (পূর্ব জন্মে) শুদ্ধোধন রাজা ছিলেন দশরথ মহারাজা, মহামায়া ছিলেন সে মাতা, রাহুলমাতা (গোপা) ছিলেন রাজকুমারী সীতা, আনন্দ ছিলেন রাজপুত্র ভরত, সারীপুত্র ছিলেন রাজপুত্র লক্ষন, বুদ্ধ পরিষদ সে পরিষদ, আমি (বুদ্ধ) ছিলাম সে রাম পন্ডিত (দশরথ জাতক নম্বর ৪৬১, জাতক অট্টকথা, পালি টেক্সট সোসাইটি, লন্ডন)।”
বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), The AuthorÕs World famous and glorious New Book entitled ÒPRE – VEDIC MOHENJODARO BUDDHISM & MEDITATION IN THE NUCLEAR AGE , (516 Pages) “ সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি