সাজ্জাদ আলী
দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা কাদের মোল্লাকে “শহীদ” উল্লেখ করে বিজয়ের মাসে একটি খবর ছেপেছে? এই কাদের মোল্লা আর সংগ্রাম পত্রিকা’র কর্মপরিচয় পাঠকদের স্মরণে আছে নিশ্চয়ই। তবুও আপনাদের স্মৃতির আবরণটা সামান্য অনাবৃত করি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের সহযোগী আলবদর কমান্ডার ‘কাদের’ ঢাকার মিরপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। হত্যা, ধর্ষণ, খুন, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ে ২০১৩ সালে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
আর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দলটির মুখপাত্র হিসেবে সংগ্রাম পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ১৯৭০ সালে। জন্মলগ্ন থেকেই পত্রিকাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীতা এবং জামায়াতের কুকর্মগুলো মহিমান্বিত করতে তৎপর আছে। পত্রিকাটি ৭১’ এ রাজাকার আলবদরদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের সমর্থনে সাফাই গেয়েছে। আর স্বাধীনতা পরবর্তীতে নানা কৌশুলী প্রচারণায় বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে চলেছে।
সংগ্রাম খবরের কাগজটি কিন্তু তাদের বিশ্বাসের জায়গা থেকেই কাদের মোল্লাদের “শহীদ” বলছে। গোলাম আজম, মুজাহিদসহ অন্যান্য মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরাও ওদের দৃষ্টিতে শহীদ। তো এই “শহীদ” শব্দের তাৎপর্যটি আসলে কি? আরবি ভাষার এই শব্দটির ব্যবহারিক অর্থ “আত্ম উৎসর্গকারী”। তবে তো জানতে ইচ্ছা হয় কাদের মোল্লারা কি ধরণের আত্মোৎসর্গ করে “শহীদ” অভিধা পেল? এর জবাবও জলবৎ তরলং!
ওরা বাংলাদেশের জন্মই চায়নি। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীতা করে পাকিস্তানীদের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিলো। ১৯৭১ এ বাঙ্গালী নিধন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি কুকর্ম করেছে। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচেতনা ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে চলেছে। আর এই কাজগুলো ওরা সচেতনভাবেই করেছে, এ ওদের রাজনৈতিক দর্শন। তথাকথিত সেই দর্শন বাস্তবায়ন করতে যেয়ে ফাঁশিতে ঝুলেছে বলেই সংগ্রাম/ইনকিলাব কাগজওয়ালারা কাদের/গোলামদের আজ “শহীদ” বলে সম্মানিত করছে।
এক আজব দেশ আমাদের বাংলাদেশ! এ দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তি “দেশবিরোধী রাজনীতি” করতে পারে! বাকস্বাধীনতার নামে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রের জন্মচেতনার বিপরীতে মত প্রকাশ করতে পারে! ওরা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে! “স্বাধীনতা” নিয়ে কটাক্ষ করে ওরা পার পেয়ে যায়! মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেও ওরা বহাল তবিয়তে থাকে। তবে কি যার মুখে যা আসবে তাই উগরে দেবে? রাষ্ট্র কাঠামোতে নাগরিকদের কথা বলবার একটা লাগাম থাকতে হবে তো! রাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধ- এ সব বিষয়ে সব ধরণের নেতিবাচক কথা/কাজ প্রতিহত করার আইন এবং তা প্রয়োগ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। পৃথিবীর সব সভ্য দেশেই এ ব্যবস্থাটা পাকাপাকি রকমের আছে। ছোট্ট করে দুটো নমুনা বলি তবে।
এই তো বেশি দিন আগের কথা নয়, পাঠক বন্ধুদের নিশ্চয়ই স্মরণে থাকবে। খ্যাতিমান অষ্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক এবং উইকিলিকস এর প্রধান নির্বাহী জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জে’র কথা বলছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গোপন নথি প্রকাশ করার কারণে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আমেরিকা এবং ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপ একাট্টা হলো। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্র-চেতনা বিরোধী তথ্য ফাঁস করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় সাংবাদিক অ্যাসাঞ্জ কিন্তু কোন তথ্য বিকৃতি, পরিবর্তন বা পরিমার্জন করেননি; হুবহু প্রকাশ করেছেন।
তবুও যেহেতু সেই “সত্য প্রকাশ” রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে, তাই পাশ্চাত্যের সরকারগুলো জোটবেঁধে অ্যাসাঞ্জকে শায়েস্তা করতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে। বৃটেনের মতো উদার গণতান্ত্রিক ও ব্যক্তিমত প্রকাশের অনুকুল রাষ্ট্রও অ্যাসাঞ্জের এমনতর সাংবাদিকতা সহ্য করেনি। গ্রেফতার এড়াতে তাঁকে লন্ডনস্থ ভিন্ন আরেকটি দেশের দূতাবাসে ৭ বছর পালিয়ে থাকতে হয়েছে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। তাহলে ব্যপারটা দাঁড়ালো যে, সভ্য দেশগুলোতেও রাষ্ট্রের মূল চেতনাবিরোধী কাজকর্ম সাংবাদিকতার কর্মপরিধি অথবা বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে না।
আরেকটি নমুনা বলে ইতি টানবো। ১৯৪৫ সালের মে মাসে নাৎসি জার্মান ও তাদের সহযোগীদের পরাজয়ের মাধ্যমে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলো। বিজয়ী মিত্র শক্তির সৈন্যরা জার্মান অধিকৃত বিভিন্ন দেশের বন্দি শিবিরগুলোতে লাশের পাহাড়, হাড়গোড়, মাথার খুলি, মানুষ পোড়ানো ভষ্ম, -এমন অমানবিক সব বিভৎসতা আবিস্কার করলো! নাজি-জার্মানির নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞ বা হলোকাষ্ট দেখে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হলো!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ইউরোপের দেশে দেশে এই নাৎসিবাদীদের বিচারের সম্মুখীন করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। ১৯৪৬ সালের পহেলা অক্টোবর জার্মানির ন্যুরেমবার্গ শহরে ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইবুনালে ১২ জন পদস্থ নাৎসি কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ইতিহাসে এই বিচার ‘ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল’ নামে খ্যাত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরিচালিত ঐ বিচারিক ট্রাইবুনাল ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সাল অবধি বিভিন্ন ধরণের মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য ১৭৭ জন অপরাধীর বিচার কাজ সম্পন্ন করেছিলো।
এ দিকে ১৯৫০ এর দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে জার্মানিতে নাৎসিরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। পরাজিত শক্তির মাথা থেকে তখনও ‘নাৎসিবাদ’ ও ‘হিটলারের ভূত’ নামেনি। নানান ছলছুতোয় এই নব্য নাৎসিরা গণহত্যা বা হলোকাষ্টকে অস্বীকার করছিল, বা খাটো করে দেখাচ্ছিল অথবা ‘অতিরঞ্জণ’ বলে প্রচার করছিল। কৌশলী প্রচারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে ওরা এমন ধারণা দিচ্ছিল যে, নাজি-জার্মানি তথাকথিত “বিপুল সংখ্যক” ইহুদি হত্যা করেনি এবং এই হত্যাকান্ড পরিকল্পিতও ছিল না। যা কিছু ঘটেছে সবই ছিল যুদ্ধের অনিবার্য প্রয়োজন। বিজয়ী মিত্রশক্তি যে ৬০ লক্ষ ইহুদি নিধনের কথা বলছে, তা বানোয়াট গল্প বৈ অন্য কিছু নয়। বাক স্বাধীনতার সুযোগে নব্য নাৎসিরা এহেন কথাবার্তা নিয়ে ক্রমেই জার্মানিতে এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে জার্মানির তৎকালীন সরকার ঐ নব্য নাৎসিদের দমনকল্পে এবং ইতিহাস বিকৃতিরোধে “ল অ্যাগেন্স্ট হলোকাষ্ট ডিনাইঅ্যাল” (“হলোকাষ্ট অস্বীকার” প্রতিরোধে আইন) নামে একটি আইন প্রণয়ন সময়োপযোগী মনে করলো। এই আইনের আওতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ‘নাৎসি জার্মানি’র গণহত্যা অস্বীকার বা খাটো করে বলাকে অথবা এরূপ কোন চেষ্টাকে ফৌজদারী অপরাধ বলে বিবেচিত হলো ! এমনকি নাৎসি পার্টি, নাৎসিদের ব্যবহৃত ফ্লাগ বা চিহ্ন, নাৎসিবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন দল গঠন বা মত প্রচারও জার্মানিতে সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষিত হলো। পরবর্তীতে জার্মানির অনুকরণে অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, রোমানিয়া, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, প্রভৃতি দেশও “হলোকষ্ট ডিনায়েল” আইন প্রণয়ন করে।
ফিরে আসি আবার দেশের প্রসঙ্গে। আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত সব দেশগুলোতে যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হয় তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের অনুরূপ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না কেন? খোদ জার্মানীতে যদি “হলোকাষ্ট ডিনায়েল” এর মতো কঠোর আইন থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার, অবমাননা অথবা রাষ্ট্রচেতনার পরিপন্থি কাজকারবারের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনি বিধান থাকবে না কেন? মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগে আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদদের পবিত্র রক্ত কেউ যেন কাদের মোল্লাদের কু-রক্তের সাথে মিশিয়ে ফেলতে না পারে; রাষ্ট্রকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। (লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)