ইচক দুয়েন্দ : (১৯৬০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেন ইচক দুয়েন্দে। জীবনের অধিকাংশ সময় বসবাস করেছেন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পদ্মা-বিধৌত নগরী রাজশাহীতে। কাজ করেছেন কৃষি খামার পরিচালক, গ্রন্থ সম্পাদক এবং ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক হিসেবে। ইচক দুয়েন্দে’র অন্য বই: We Are Not Lovers (ইংরেজি উপন্যাস) এবং টিয়াদুর (মহাগপ্প)। ‘লালঘর’ একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয়েছে।)

১.
রাত তিনটার ঘণ্টা বাজে। চিকচাক রুই-এর মনে হয় জীবনে সে প্রথমবারের মতো স্পষ্ট করে দেয়ালঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শুনছে।
টিক টিক টিক করে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা বিরতিহীন মন্থর ঘুরছে। চিকচাকরুই-এর মনে পড়ে না যে কখনো সে এভাবে এক এক সেকেন্ড সময়কে যেতে দেখেছে।
এদিকে তার বুকটা উঠছে এবং নামছে। এরকম একটা ব্যাপার ঘটে সে জানত। কিন্তু এটাও সে ল করে জীবনে প্রথমবারের মতো। পাকস্থলীটা একটু বা বেশ ফুলে যাচ্ছে ও সঙ্কুচিত হচ্ছে। এটা যে ঘটে সেটা তার এক্কেবারেই জানা ছিল না। এটাও একটা লক্ষ করার মতো ব্যাপার।

আজ রাতে সে নিজের নরম বিছানায় নেই। মাথার তলে বালিশ নেই। থাকার প্রশ্নও নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে। রুই দাঁড়িয়ে আছে একটা বর্গাকৃতি ঘরে। হবে ৯ ফুট x ৯ ফুট। উচ্চতা ১২ ফুট। ইটে তৈরি দেয়াল, ঢালাইকরা ছাদ। পলেস্তরা লাগানো, চুনকাম করা দেয়াল ও ছাদ। ফ্যান ঝোলাবার আঙটাটা কাটা। ঘরটিতে ঢুকবার বা বেরুবার জন্য আছে একটি মাত্র এক পাল্লা বিশিষ্ট দরজা। লোহার শিক বা গরাদযুক্ত। প্রায় ৩ ফুট চওড়া, ৭ ফুট দীর্ঘ। গরাদ-দরজা এখন বাইরে থেকে তালা লাগানো।

ঘরটার এক কোণে একটি ছোট্ট চৌকো ঘর। ৩ ফুট x ৩ ফুট। শৌচাগার। প্রকৃতির ডাকে সেখানে যাওয়া যায় একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে। শৌচাগারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বাল্ব নেই।
বাইরে একজন সান্ত্রি দাঁড়িয়ে। চিকচাকরুই এই ঘরটিতে আটক। ঘরটিতে সে একা দাঁড়িয়ে, কিন্তু সে একা নয়। তার আরও দশজন সঙ্গী আছে। তারা সব্বাই শুয়ে আছে ঘরটার মেঝেতে। অলৌকিকভাবে একটা কম্বল জুটেছে। নীল রঙের সেই কম্বলটা মাটিতে বেছানো। সেই কম্বলটা টায়টোয় আশ্রয় দিতে পেরেছে দশজনকে। তাও খুব কসরত করে। এদিকে সরে ওদিকে সরে। এপাশ ফিরে ওপাশ ফিরে। কিছুটা ধাক্কা মেরে। কাত হয়ে। অবশেষে দশজন জায়গা পেয়েছে। কিন্তু একজন বাড়তি থেকে যায়। সে বেচারা চিকচাকরুই দাঁড়িয়ে।
সান্ত্রিরও বসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

এই আধ ঘণ্টা আগেও তারা টুকটাক কথা বলেছে। এখন নীরব।
জনাকীর্ণ শহরটায় দিনের কর্মব্যস্ততার শেষে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। দূরে দ্রুতগামী যানবাহনের শব্দ এখন ভীষণ প্রকট হয়ে কানে বাজছে, যা দিনে অন্যসব শব্দের ভিড়ে থাকে ঝাপসা। ঘড়ির টিক টিক ঠিক ঠিক ধ্বনি, বুকের ভেতরের ধুকপুক ধ্বনির সঙ্গে একাকার হয়ে ছলাত ছলাত করে বাজে।

অলংকরণ : উদাস আব্দুল্লাহ

পাশের হাজতঘরে তালা খুলবার টকাং শব্দ হয়। শব্দ হয় খটখটাং গরাদ-দরজা টানার। কাউকে বের করা হয়। কয়েকজন মানুষের পায়ের শব্দ শোনা যায়। কয়েকটি বলিষ্ঠ পায়ের ধপ ধপ শব্দ। এক জোড়া অনিচ্ছুক পায়ের ছেঁচড়ে চলার শব্দ।
পায়ের শব্দগুলো নিকটেই কোথাও বাঁক নেয়। শুধুই শব্দ, কিছুই দেখা যায় না।
৪০ ওয়াটের বাল্ব-জ্বলা নীরব ঘরটায় শুধু চিকচাকরুই একা শোনে না শব্দগুলো। শোনে সব্বাই। শুয়ে থাকা দশজনের দেহগুলো হয়ে ওঠে একটু বেশি টানটান। আর তাদের কানগুলো হয়ে ওঠে সজাগ। যা তারা সরাসরি দেখতে পায় না, তাকে তারা অতি মনোযোগী কান দিয়ে যথাযথভাবে কল্পনা করে নিতে চায়। শোনা যায় এমন সব কথা:
‘মার খাতে নাই চাইলে স্বীকার র্ক।’
‘মায়ের কিরা স্যার, আমি চুরি করি নাই।’
‘আমরা সব জানি, বল্।’
ঠাস ঠাস থাপ্পরের শব্দ হয়। ‘মারে বাবারে’ চিত্কার ভেসে আসে।
‘বল্ কে কে ছিল তোর সঙ্গে?’
‘আমি চু-উ-রি করি নাই।’ এই কথার সঙ্গে সঙ্গে লাথির শব্দ শোনা যায় এবং চিত্কারজড়িত কান্না, ‘মারে বাবারে মরে গেলাম রে। মারে বাবারে মরে গেলাম রে।’ এবং কোঁকানির শব্দ।
আবার সপাং সপাত শব্দ শোনা যায় এবং সজোর চিত্কার ও কান্না।
‘আপনার পায়ে পড়ি, স্যার। আমি জানি না, স্যার।’
কান্নার শব্দ ও কণ্ঠস্বর থেকে মনে হয় ছেলেটির বয়স সতের কী আঠার। আবারো ছেলেটির জোর চিত্কার ও কান্না শোনা যায়।
অবশেষে সে বলে ফেলে, ‘জী, আমি চুরি করছি স্যার।’
আবার মারের শব্দ শোনা যায়।
ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে এবারে বলে, ‘আমি চুরি করি নাই স্যার।’
‘যা। ভাব্। ঠিক র্ক। কী বল্বি।’

ছেলেটির গোঙানি ও কাতর কান্না শোনা যেতে থাকে। পরের সব শব্দ শুনে মনে হয় তাকে সরানো হয় অন্য কোনো ঘরে। কিছুক্ষণ কাতর কান্নার হুহু শব্দ শোনা যায়। তারপর রাত্রির নীরবতায় হারিয়ে যায় ঐ শব্দটুকুও।
যতক্ষণ ধরে ঐ ধ্বনি ও কথাগুলি তাদের কানে পৌঁছায়, তারা মনে মনে তার ছবি দেখে। শব্দ ধ্বনি থেমে যায়, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না।

২.
‘ইংরেজি প্যাটর প্যাটর করতেছিল কে? এখন বোঝ্। যা ঘানি টান লালঘরের,’ গরাদ-দরজার ওপারে পৌঁছেই সহাস্যে বলে দিল আনচান ভাই।
‘দিনের বেলায় কোন্ পাগলায় ড্রিংক করে? তোরা ড্রিংক করা কবে শিখলি? তোরা কী করছিলি? পিকনিক? ধরল কেন? অফিসারের সঙ্গে ইংরেজিতে প্যাটর প্যাটর করছিল কে?’ তুনির চুমক জিজ্ঞেস করে তামাশার সুরে।
‘আপনিও এর মধ্যে?’ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে ইন্টুম কাসকেট, পুঁই চুলভি’র দিকে তাকিয়ে।
‘ড্রিংক করলাম আমরা। ধরা পড়লি তোরা। আমরা তো এখনি ড্রিংক কর‌্যা আসতেছি,’ দিল আনচান ভাই সহাস্যে বলে আবার।
কে আদেশ দেয়, সেটা এক রহস্য। সান্ত্রি বিনা বাক্যব্যয়ে গরাদ-দরজার তালা খোলে।
তুনির চুমক একটা বিরাট বাক্স বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘খাও।’
তখন বাজে রাত ৪টা। বাক্সে সাত পদের চাইনিজ। দুই ডজন লোক খেতে পারে এত্তো খাবার। বারো ঘণ্টা তারা পানিছাড়া আর কিছু খায় নাই, তবুও ঐ খাবারগুলো দেখে তারা নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে থাকে। তাদের জিহ্বায় কোনো রস আসে না।

এদিকে মিয়ান টিনটুই ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে, ‘অফিসার আসল। ফিজ ফ্যাল উঠে দাঁড়িয়ে তাকে একটা সালাম দিল। তারপর ফিজ একটাও বাংলা বলল না। অনর্গল ইংরেজি ঝাড়ল। অফিসারও ঝাড়ল। অফিসার রজেট চিনচুই-এর কাছে গেল। রজেট চিনচুই-ও ইংরেজি ঝাড়ল। কী থেকে কী হয়ে গেল তারপর আল্লা মালুম। ওরা কী বলেছিল, আমি বলতে পারব না।’

‘ছোট ভাইরা, তোমরা দুধের শিশু, তোমাদেরকে কেন ধরল, বুঝেছ? তোমরা জ্ঞান ফলাচ্ছিলে। বুঝলে আর কনো জ্ঞান ফলাবে না। কনো কোনো অফিসার দেখলে ইংরেজি বাতচিত দেবা না। ইংরেজি বলতে চাও ইংল্যান্ডে যাও, আমেরিকায় যাও। যাও ইন্ডিয়ায়, ওখানে মুচিরাও ইংরেজি বলে। কিন্তু মদ খাও এই দেশে আরাম করে। বত্রিশ বছর ধরে ড্রিংক করি। দেখা হলে, জিজ্ঞেস করে। বলি, অভ্যাস। ছাড়ে দেয়। আমার সোনার দেশ।
‘কিন্তু আমেরিকায় যাও। ড্রিংক করবা। অত সহজ না। বেটি বারবার করে বলে, আব্বু আসো, আসো। শেষে গেলাম আমেরিকায়।

‘একদিন গেছি একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরে। দেখি বিয়ার। কিনলাম একটা। বের হলাম। সামনে রেলিঙওয়ালা বারান্দামতো। চমত্কার জায়গা। রেলিঙে হেলান দিলাম। টান মারলাম। এক চুমুক দিছি।
‘আর সাইরেন বাজে উঠল। তাকায়ে দেখি ইয়া বড় এক মটর সাইকেলের পিঠে চড়ে এক সার্জেন্ট হাজির।
‘শালা এক ঘণ্টা ইংরেজিতে কী ঝাড়ল ও শালাই জানে। আমি এক বিন্দুবিসর্গ বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম পাবলিক প্লেস, ড্রিংক করা যাব না।
‘দোকানের এক দেশি কর্মচারী এসে বাঁচাল। জরিমানা হল না। প্রথম বার তো। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল।
‘বেটিক বললাম, তোদের বেহেশতে তোরা থাক, আমি দোজখে ফিরে আগুন খাই। সাত দিন পর চম্পট।’
দিল আনচান ভাই তার গল্প শেষ করে।
‘ছোট ভাইরা, তোমরা ভেব না। তোমাদেরকে খামাখা ধরছে। সকাল নয়টা বাজতে বাজতে তোমরা বাড়ি যাবা,’ বলে ইন্টুম কাসকেট নিশ্চিত করে।
তারা চলে যায়।
রেখে যায় সাহস।
তাদেরকে মনে হয় ফেরেশতা।
আশ্বস্ত বোধ করে তারা, একটু আধটু খাবার খায়।

৩.
‘তুই ড্রিংক করিস, এটা তো জানতাম না। একটু আধটু শুকনো খাস, তা জানতাম। দিনে দুপুরে কী করতে ড্রিংক করছিলি? এই দ্যাখ আমার হাতে বোতল, বল্ এদেরকে ধরতে,’ হ্যাংলং ব্রিংলার তার হাতের জনি ওয়াকারের বোতলটি সান্ত্রির দিকে তাক করে বলে মিয়ান টিনটুইকে।

‘দোস্ত, ব্যাপারটা ভুয়া। কে এই ভুয়া ব্যাপারটা রটাচ্ছে?’ মিয়ান টিনটুই আহত স্বরে বলে।
‘ভুটক নন্দনচাট। চিনিস তো, দৈনিক সজীব সন্দেশের রিপোর্টার। আমি আর উবাব রহনাং মোটর সাইকেলে চড়ে পার্কের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। রাত তিনটা। ভুটক জোরে চিত্কার করে আমাদেরকে থামাল। থামলাম। ও ওর গাড়ি থামাল।
‘নেমেই ওর ফার্স্ট কথা, ‘মিয়ান, জিয়াফ, রজেট গ্রেফতার হয়েছে। দিনে দুপুরে চরে বসে মদ খাচ্ছিল। বোতলসহ ধরে ফেলেছে। সঙ্গে মহিলাও থাকতে পারে।’
‘ভুটকের মুখ থেকে তখন যে গন্ধটা পাচ্ছিলাম, সে কথা তোদেরকে আর বললাম না। উবাব রহনাং তোদেরকে কতটা সম্মান করে তোরা তা কল্পনা করতে পারবি না। সে বলল, ‘কোনোদিনও ওরা ড্রিংক করতে পারে না। ওরা খুব ভাল মানুষ। তোমরা ইচ্ছে করে ওদের চরিত্রহনন করছ। নিশ্চয়ই ধরলে অন্য কোনো কারণে ধরেছে।’
‘ভুটক বলল, ‘আমি নিজের কানে বড় কর্তার কাছে শুনে আসছি।’
‘উবাব বলল, ‘আমি বিশ্বাস করি না।’
‘তারপর প্রায় একটা হাতাহাতির উপক্রম হল।’

শহরময় যে এরকম একটা গুজব রটে গেছে সেটা জেনে সব্বার মন কেমন হয়ে যায়।
‘তোরা ভাবিস না। আমি গুরুর কাছ থেকে এুনি এলাম। আমি গুরুকে বলতেই তো গুরু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। উনি তুনি ডিসি সাহেবকে ফোন করলেন। ডিসি সাহেব জজ সাহেবকে ফোন করে দেবেন। জজ সাহেব এসপি সাহেবকে বলে দেবেন। একটা সিস্টেম আছে, তোরা ছাড়া পেয়ে যাবি। জানিস তো গুরু কোত্থাও যান না। ব্যাপারটা রাজনৈতিক দিকে বাঁক নিতে পারে। আচ্ছা তোরা থাক্। চিন্তা করিস না। এই ছাড়া পালি বলে। আমি চলি। মন খারাপ করিস না,’ এসব কথা বলতে বলতে হ্যাংলং ব্রিংলার তার মাথার মাঝখানে লাল রিবনে বাঁধা খাড়া চুলের ঝুঁটি নাচিয়ে তার হাতের জনি ওয়াকারের বোতলটা ঘোরাতে ঘোরাতে উপস্থিত সান্ত্রিটির বিব্রত কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়।
তখন আসে সুদর্শন তিনাশ দ্রিপ্রাড়। এসেই বলে, ‘মিয়ান ভাই শুধু একবার আমাকে খবর দিতেন। তাহলে আমি এতক্ষণে…। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি উকিল খুঁজতে বেরুলাম। জরিমানার টাকাও করতে হবে জোগাড়। আর দেখতে হবে তদবিরে কী ফল ফলল। ইস্ কালকেই যদি জানতে পারতাম। ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না।’
তিনাশ দ্রিপ্রাড় চলে যায়। কিন্তু ফিরে আসে না কেউ।
(চলবে)