অনলাইন ডেস্ক : প্রায় পুরো আফগানিস্তানই দখল করে নিয়েছে তালেবান। এখন রাজধানী কাবুলেও ঢুকে পড়েছে তারা। মাত্র কয়েক সপ্তাহে তাদের নজিরবিহীন অগ্রগতি অনেককেই বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। তালেবানের অভিযানে গত কয়েকদিনে অনেকটা ডোমিনো বা তাসের ঘরের মতো প্রায় দুই ডজন প্রাদেশিক রাজধানীর পতন হয়েছে। ডোমিনো হচ্ছে শিশুদের একটা প্রিয় খেলা। চারকোণা কিছু বাক্স একটার পর একটা সাজানো থাকে। একটায় ধাক্কা দিলেই একে একে সবকটা বাক্সই ধসে পড়ে। প্রশ্ন উঠেছে, তালেবান কীভাবে এত দ্রুত পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিল। উত্তরে বেশ কিছু কারণ নির্দেশ করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আফগান সেনাবাহিনীর দুর্বল মনোবল ও সীমাহীন দুর্নীতি, তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের গোপন সমর্থন ও তাদের নতুন নতুন রণকৗশল গোষ্ঠীটিকে দুর্বার এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

আফগান সেনাবাহিনীর দুর্নীতি ও দুর্বলতা : গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো বন্ধুরা মিলে আফগান বাহিনীকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়েছে। গোলাবারুদ, ভারী অস্ত্র ও অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জামে সজ্জিত করেছে। মার্কিন ও ব্রিটিশ জেনারেলরা গর্বভরে ক্রমাগত বলে এসেছেন, এমন শক্তিশালী আফগান আর্মি ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। খাতাপত্রে আফগান সরকার এখনো খুব ক্ষমতাবান। আর্মি, এয়ারফোর্স ও পুলিশ মিলিয়ে আফগান সিকিউরিটি ফোর্সেও আছে প্রায় তিন লাখ সেনা। স্পেশাল ফোর্স আছে আরও ১০ হাজার। কিন্তু আফগান সরকারের মতো দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীও দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং গুরুতর আমলাতন্ত্রের ডামাডোলে ভুগছে। প্রকৃতপক্ষে আফগানিস্তানে একটি কার্যকরী রাষ্ট্র ও সামরিক বাহিনী তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিমারা।

বিবিসির এক প্রতিবেদন মতে, আফগান বাহিনীতে নিয়োগে মোটেও আগ্রহ দেখায় না দেশটির তরুণরা। এর মধ্যে যারা নিয়োগ পায় তাদেরও মতলব বিশেষ সুবিধার থাকে না। ভালো বেতনের লোভ, ঘুস খাওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সুযোগ বুঝে পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া তাদের নিয়মিত চর্চা। দুর্নীতিটাও এমন পর্যায়ে যে, সেনা নিয়োগ না দিয়েও বেতন তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে। সুতরাং আফগান বাহিনীর ওই তিন লাখ সেনা মানে আদৌ কতজন, এ প্রশ্ন করা যায় সবার আগে। এমন দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে মার্কিন কংগ্রেসের হালনাগাদ প্রতিবেদনে। তাতে স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান (সিগার) জানিয়েছে, ‘আফগান বাহিনীর দুর্নীতিটাই দেশটিকে ক্ষয় করে ফেলছে। তাদের বাহিনীর শক্তিমত্তাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ।’ আবার রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের মুখপাত্র জ্যাক ওয়াটলিংও বলেছেন, আফগান আর্মি নিজেরাও জানে না যে তাদের লোকবল কত। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যাক ওয়াটলিং বলেছেন, আফগান সেনাদের নীতিবোধের মতো তাদের যন্ত্রপাতিতেও (অস্ত্র বুঝিয়েছেন) ঘুণ ধরেছে। যে কারণে তালেবান আসার খবর শুনেই পোস্ট ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে। কিছু শহর দখলে তাই তালেবানকে লড়তেই হয়নি।

তালেবানের শক্তি-সামর্থ্য : তালেবানের শক্তি কতটা সেটা মাপা বেশ কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস কমব্যাটিং টেরোরিজম সেন্টারের তথ্য মতে, তালেবান যোদ্ধা আছে কমপক্ষে ৬০ হাজার। এদের সঙ্গে অন্য জঙ্গি গ্রুপ ও সমর্থক মেলালে সংখ্যাটা দুই লাখ ছাড়াবে। আবার তালেবান মানেই একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা, এমনটাও ভাবতে বারণ করেছিলেন আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ড. মাইক মার্টিন। যে কেউ যখন-তখন তালেবান বনে যেতে পারে। তিনি এও বলেছেন, আফগানিস্তানের সরকারও স্থানীয় অনেক গোষ্ঠীর মতামতে ঘন ঘন প্রভাবিত হয়। সেসব গোষ্ঠী তো বটেই, সরকারি লোকজনও নিজের জান বাঁচাতে দ্রুত পক্ষ বদলায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তান সরকার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, ইরান এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে তালেবানদের সমর্থন ও সহযোগিতা করার অভিযোগ এনেছে। যদিও তারা সবাই এটা অস্বীকার করে আসছে। তালেবানদের অগ্রযাত্রায় পাকিস্তানের সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

কার হাতে কত অস্ত্র : এদিকে অর্থ ও অস্ত্র, দুটো দিক দিয়ে এখনো আফগান সরকার শক্ত অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেনাদের বেতন ও অস্ত্র কেনার জন্য কোটি কোটি ডলার পেয়েছে তারা। ২০২১ সালের সিগার-এস প্রতিবেদন অনুযায়ী এ পর্যন্ত আফগানিস্তানের নিরাপত্তাতেই যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে আট হাজার আটশ কোটি ডলারের বেশি। সিগার এও বলল, ওই অর্থ আদৌ ঠিকমতো ব্যয় হয়েছে কি না তা লড়াইয়ের ময়দানেই বোঝা গেছে।

অকার্যকর আফগান বিমান বাহিনী : আফগান বাহিনীকে এখনো তাদের ২১১টি এয়ারক্রাফট সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে আবার তালেবানরাও টার্গেট করে হত্যা করছে পাইলটদের। সুইডিশ ডিফেন্স রিসার্চ এজেন্সির (এফওআই) আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হেলেন ল্যাকেনবাউয়ার বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আফগান সেনাবাহিনীর কার্যকরী কোনো বিমান বাহিনী নেই। আফগানিস্তানের নিজস্ব যে বিমান বাহিনী রয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা গঠিত এবং অর্থায়নে কাজ করত। কিন্তু তারা যখন আফগানিস্তান ত্যাগ করে, তখন বিমান বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ এবং অর্থায়ন স্থগিত হয়ে যায়। এ ছাড়াও তালেবানরা আফগান বিমান বাহিনীর পাইলটদের বিশেষভাবে টার্গেট করে হামলা এবং হত্যা করেছে।

মর্মাহত মালালা

মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের ক্ষমতার দখল নিতে যাচ্ছে তালেবান। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের নারী শিক্ষা অধিকার কর্মী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী মালালা ইউসুফজাই। রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় তিনি আফগানিস্তানের নারী, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীর সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানান। রোববার সকালের দিকে তালেবানরা চার দিক থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল ঘিরে ফেলে। এরপর কাবুলের এআরজি প্রেসিডেন্ট প্যালেসে তালেবান এবং আফগান সরকারের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর মালালা ইউসুফজাই এক টুইটবার্তায় বলেন, তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করায় আমরা পুরোপুরি ধাক্কা খেয়েছি। আমি আফগানিস্তানের নারী, সংখ্যালঘু এবং মানবাধিকারের সমর্থকদের ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। টুইটে পাকিস্তানের এই মানবাধিকার কর্মী বলেছেন, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং স্থানীয় শক্তিকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পাশাপাশি জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদান এবং শরণার্থী ও বেসামরিকদের রক্ষা করতে হবে। এদিকে, তালেবানের একজন মুখপাত্র নারীদের অধিকারের প্রতি যোদ্ধারা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মাত্র ১০ দিনের দ্রুতগতির আগ্রাসী অভিযানের মাধ্যমে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় নারীদের অধিকারের ব্যাপারে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশটিতে ইসলামি শরিয়াহ আইন কার্যকর করে তালেবান। ওই সময় ব্যভিচারের শাস্তি হিসাবে পাথর নিক্ষেপ, চুরির জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা এবং মেয়েদের স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ জারি করে তালেবান। তবে রোববার নারী অধিকারের ব্যাপারে যে বিবৃতি দিয়েছে তা বিশ্বজুড়ে এই ইস্যুতে তৈরি হওয়া উদ্বেগ সাময়িক নিবারণের চেষ্টা বলে মনে করছেন অনেকে। তালেবানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, নারীরা একাই বাড়ি থেকে বের হতে পারবেন এবং শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকবে।