রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
ঊনপঞ্চাশ.
দ্বাদশ অধ্যায়
নতুন কিছু উদ্ভাবন না করলে আপনি মারা যাবেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) সেদিনের সেই ঘোষণাটি ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানিতে নতুন কিছু উদ্ভাবনের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকল। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গতানুগতিকভাবে চালু রাখার জন্য আমরা আমাদের সমর্থন অব্যাহত রাখব। এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে যতদিন তারা একটা মানানসই মূনাফা উপার্জন করতে পারবে। আর সারা বিশ্বের সিনেমা হল গুলোতে আমরা আমাদের চলচ্চিত্রগুলো বড় পর্দায় প্রদর্শন অব্যাহত রাখবো। কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি এখন সম্পূর্ণরূপে কোন মধ্যস্থতা ছাড়া সরাসরি ভোক্তাদের কাছে আমাদের সিনেমাগুলো আমরা নিজেরাই পরিবেশন করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। সার কথা আমরা এখন আমাদের নিজেদের ব্যবসার সমস্যা নিজেরাই দ্রæতগতিতে সামাধানের পথে এগিয়ে যাবো যেখানে স্বল্পমেয়াদী লোকসান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রতিয়মান হবে। উদাহরণ হিসাবে আমরা যখন আমাদের সমস্ত টিভি শো এবং সিনেমা (পিক্সার এবং মার্ভেল এবং স্টার ওয়ারসহ) নেটফ্লিক্স এর প্ল্যাটফর্ম থেকে স¤প্রচার বন্ধ করে নিজস্ব সাবস্ক্রিপশন পরিষেবা থেকে স¤প্রচার করবো তখন লাইসেন্সিং ফি বাবদ কয়েক মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যায় করতে হবে।
কয়েক বছর ব্যাপী আমি একটা ধারণা পর্যবেক্ষণ করেছি, সেটা হচ্ছে ‘প্রেস রিলিজ ব্যবস্থাপনা’ – অর্থাত আমি যদি জনসমক্ষে খুব দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে কিছু বলি, তবে সেটা আমাদের কোম্পানির অভ্যন্তরে সকলকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৫ সালে বিনিয়োগকারী স¤প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে অকপট উচ্চারণ আমাদের বিবৃতিগুলোকে ভুল প্রমাণিত করেছিল। কারণ অকপট উচ্চরণগুলো ডিজনির ভিতরের ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা চিন্তা করেছিলেন প্রতিষ্ঠান প্রধান এই বিষয়ে শংকিত, সতরাং তাদের এই বিষয়ে আরও শতর্ক হতে হবে, আরও গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে, আরও ভালভাবে কাজ করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন। ২০১৭ সালের প্রেস ব্রিফিং একইভাবে সর্বত্র চাঙ্গা প্রভাব ফেলেছিল। আমার দল জানত আমি প্রেসব্রিফিং-এ প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। কিন্তু আমি শুনেছি এটি আরও ব্যাপকভাবে মানুষের মাঝে প্রচার পেয়েছে, বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের মাঝে এবং এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমি প্রত্যক্ষ করেছি সকলে নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েছে এবং এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যাক্ত করেছেন।
ঘোষণার আগে আমি ধরে নিয়েছিলাম আমরা ধীরে ধীরে শিশুর ধাপে নতুন মডেলে রূপান্তরিত হবো। নতুন অ্যাপ তৈরি করতে হবে এবং অ্যাপে কোন বিষয়বস্তু সরাসরি স¤প্রচার করা হবে তা নির্ধারণ করা ইত্যাদি অনেক সময় সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু ঘোষণার পরে যেহেতু প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক ইতিবাচক ছিল তাই সমগ্র কৌশল বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে সকল মানুষের কাছে জরুরি কাজ হিসেবে গুরুত্ব পায়। কারণ এটি ডিজনির বাঁচা মড়ার প্রশ্ন। সকলের প্রত্যাশা ছিল আমাদের বাঁচতে হবে। অতিরিক্ত চাপ নিয়ে সকলে কাজ করছে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত এবং ব্যাপক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কোম্পানির অভ্যন্তরে বিরোধ দেখা দেবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি বরং কোম্পানির অভ্যন্তরিণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি একটা শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে।
ডিজনির ব্যবসাগুলো বর্তমানে মৌলিকভাবে চালু আছে কিন্তু ব্যবসাগুলির ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ সমস্ত ব্যাবসার কাঠামো ভেঙ্গে ফেলে নতুন ব্যাবসায়িক কাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির আশায় স্বল্পমেয়াদী লোকসান মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এমন সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিশাল সাহসিকতার প্রয়োজন? এমন ক্ষেত্রে কর্মীর কাজের রুটিন এবং অগ্রাধিকার পরিবর্তন হয়ে যায়, কাজের ধরনে পরিবর্তন আসে, দায?িত্ব পুনরায় বন্টন করা হয়। কর্মীবৃন্দ সহজেই অস্থির হয়ে উঠতে পারে কারণ তাদের কাজ করার ঐতিহ্যগত পদ্ধতি পাল্টে যায় এবং কাজ করার নতুন একটা মডেলের আবির্ভাব হয়। কর্মীদের দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন পদ্ধতিতে কার্য সম্পাদন করা অনেক কঠিন এবং বিভ্রান্তিকর। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে আপনাকে আপনার কর্মীবৃন্দের প্রয়োজনে উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয়তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনও পরিস্থিতিতে কর্মীবৃন্দের পাশে থাকা নেতৃত্বের একটা বড় গুণ।
এত কিছু এক জন মানুষের পক্ষে সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন। এত ব্যাস্ততা সত্বেও আপনাকে আপনার কর্মীবৃন্দের প্রয়োজনে সবসময় হাজির থাকতে হবে। আর যে কোনো পরিস্থিতিতে কর্মীবৃন্দের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া নেতৃত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেতার উপস্থিতি আরও জরুরী হয়ে উঠে। নেতারা খুব সহজেই কর্মীবৃন্দের কাছে একটা সংকেত পঠাতে পারেন যে তাদের সময় খুব মূল্যবান, তারা নানান ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাতিব্যস্ত। একজন নেতার পক্ষে প্রত্যেকের কাছে যাওয়া এবং প্রত্যেকের সমস্যা এবং উদ্বেগগুলো আলোচনা করে সমাধান করে দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু আপনার কর্মীবৃন্দের কাছে উপস্থিত থাকা এবং নিশ্চিত করা যে তারা জানে যে আপনি তাদের কাজের জন্য অত্যন্ত সচেতন। এটি তাদের মনোবলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কোম্পানির কার্যকারিতাও বৃদ্ধি করে। ডিজনির মতো একটা বৃহদাকার কোম্পানির ক্ষেত্রে একজন নেতার উপস্থিতি বজায় রাখার অর্থ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করা, বিভিন্ন ব্যবসায়িক ইউনিটের সাথে নিয়মিত টাউন হল-স্টাইল মিটিং করা, আমার চিন্তাভাবনা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং তাদের উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া জানানো। আবার এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো ঠিক সময়মত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার কাছে আনা যে কোন সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা করে সঠিক সমাধান দেওয়া। ফোন কল রিটার্ন করা এবং ইমেলের উত্তর দেওয়া। সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য কথা বলার সময় নির্ধারণ করা, মানুষ যে চাপ অনুভব করছে তার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। এই নতুন অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করার কারণে উপরোক্ত কাজগুলো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ।
আমাদের আগস্টের ঘোষণার প্রেক্ষিতে আমরা অবিলম্বে দুটি ফ্রন্টে কাজ শুরু করি । প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিএএম-টেক-এর একটা দল আর ইতিমধ্যেই ডিজনিতে কর্মরত আর একটা দল আমাদের নতুন ইন্টারফেস পরিষেবা নির্মাণ শুরু করে একটা ইএসপিএন+ এবং অন্যটা ডিজনি+। পরবর্তী বেশ কয়েক মাস কেভিন এবং আমি নিউ ইয়র্ক এবং লস এঞ্জেলেসে বিএএম-টেক দলের সাথে মিলিত হয়েছি অ্যাপ দুটির বিভিন্ন পুনরাবৃত্তি পরীক্ষা করার জন্য। আমরা টাইলগুলির আকার এবং রঙ এবং বসানোর ধরণ বিশ্লেষণ করেছি; অ্যাপটিকে আরও সহজাত এবং সহজ ব্যবহারযোগ্য করার জন্য অ্যাপটির শুরু থেকে শেষ প্রান্তে বার বার প্রদক্ষিণ করেছি; অ্যালগরিদম এবং তথ্য সংগ্রহের কাজ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদদের সাথে কাজ করেছি, পাশাপাশি আমাদের পণ্যসামগ্রী এবং ব্র্যান্ডগুলি কীভাবে উপস্থাপন করা হবে তা তদারক করেছি।
একই সময়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে আমরা আর একটা দল পরিচালনা করছিলাম যাদের কাজ ছিল কন্টেন্ট প্রস্তুত ও কন্টেন্টের বিকাশ সাধন করা যেগুলো ডিজনি+ এ স¤প্রচারিত হবে। আমাদের চলচ্চিত্র এবং টিভি শোগুলোর একটা বিশাল লাইব্রেরি ছিল (যদিও বছরের পর বছর ধরে এ সমস্ত চলচ্চিত্র এবং টিভি শোগুলোর জন্য তৃতীয় পক্ষের কাছে লাইসেন্সকৃত তথাপি আমাদের কিছু কিছু অধিকার পুণরায় ক্রয় করতে হয়েছিল)। কিন্তু বড় প্রশ্ন ছিল: এই নতুন প্লাটফর্মে প্রদর্শণের জন্য আমরা কোন মূল কন্টেন্ট সৃষ্টি করব? আমাদের সিনেমা আর টেলিভিশন অপারেশন প্রধানদের সঙ্গে মিটিং করলাম। আমাদের পাইপলাইনে নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলি কী কী এবং কোনটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে কোনটি টিভি চ্যানেলে স¤প্রচার করা হবে এবং কোনটি অ্যাপে আপলোড করা হবে তা নির্ধারণ করলাম। স্টার ওয়ার এবং মার্ভেল এবং পিক্সারে আমরা কোন কোন নতুন প্রকল্প হাতে নেবো যেগুলো শুধুমাত্র অ্যাপে আপলোড করা হবে? এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। এটি নির্ধারণ করার জন্য আমাদের সমস্ত স্টুডিওর সিনিয়র লোকদের একত্রিত করলাম এবং তাদের বললাম, ‘ডিজনি+ এর জন্য আমি কোন নতুন স্টুডিও নির্মাণ করতে চাই না। আমি চাই আপনারাই এটার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন।’
এখানে সমাবেত সকল নির্বাহী নিজেদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বছরের পর বছর ধরে প্রশিক্ষিত হয়েছেন এবং তাদের ইউনিটের লাভের উপর ভিত্তি করে তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে । হঠাৎ আমি তাদের যা বললাম তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, ‘আমি চাই আপনাদের নিজস্ব কর্মদক্ষতা, যে কাজে আপনারা অনেক সফল হয়েছেন সে সকল কাজে কম মনোযোগ দিয়ে বর্তমান নতুন কাজে বেশি করে মনোনিবেশ করুন। এবং মনে রাখবেন আপনারা অন্য দলের ভিন্ন দক্ষতা সম্পন্ন মানুষের সাথে কাজ করবেন। তাদের স্বার্থ আর আপনার স্বার্থ এক হবে না। এখানে আরও একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে কিছু সময়ের জন্য অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন হবে না।’
তাদের সমাবেত করার মূল উদ্দেশ্য শুধু বর্তমানে চলমান পরিবর্তনগুলির সাথে তাদের খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধিই নয় বরং তাদের কাজের সফলতার জন্য তাদের পুরস্কৃত করার একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রণোদনা কাঠামো তৈরি করা আর একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবসার ক্ষয়ক্ষতি করে বা ব্যাবসায় সমস্যার সৃষ্টি করে তাদের জরিমানা করার কোন নিয়ম নীতি ছিল না। ইতিপূর্বে নতুন ব্যাবসার সফলতা মূল্যায়ন করার জন্য কোন প্রাথমিক বটম-লাইন মেট্রিক্স ছিল না। আমরা তাদের অতিরিক্ত কাজ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করছি এ ক্ষেত্রে আমরা যদি পুরনো প্রণোদনা পদ্ধতি অনুসরণ করি তবে তাদের আয় কমে যাবে। ফলে কোম্পানির উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। (চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।