রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবৎ কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিৎ করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
তেইশ.
ষষ্ঠ অধ্যায়
চমকপ্রদ ঘটনার প্রত্যাশায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমরা মাইকেলের কামরা ছেড়ে বিনিয়োগকারীদের সভায় যাচ্ছি, সেখানে আমরা দুটি বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হবো। একটা হচ্ছে রয়, স্ট্যানলি এবং স্টিভের বিপক্ষে প্রচলিত যুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আইএসআই কোম্পানিটি আমাদের দিকে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে সেটা প্রতিহত করা। আমাদের সাধ্যমত নিজেদের রক্ষা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলাম। কিন্তু কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগের বিষয়গুলো অনেক বেশি মানুষের মাঝে প্রচার হয়েছে। আমরা মাথা উঁচু করে সাহসী কণ্ঠস্বরে আমাদের বর্তমান মুনাফার কথা তুলে ধরেছি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি হবে তার ধাপগুলো তাঁদের সাথে আলোচনা করেছি। ঘুরে দাঁড়ানোর এটা একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করেছি। যদিও কোথাও কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছিল না। ক্রমেই চারপাশের প্রভাবকগুলো কঠিনতর হয়ে উঠছিল। একটা কঠিনতম মিটিং আমরা পার করলাম।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কমক্যাস্টের ডিজনি ক্রয়ের দরপত্র ভন্ডুল হয়ে গেল। ব্রয়ান রবার্ট ধরে নিয়েছিলেন, ডিজনি বোর্ড তাঁদের দেয়া প্রথমিক দরপত্র লুফে নেবে। আসলে কিন্তু তা হয়নি। ফলে আরও কতগুলো বিষয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। প্রথমত, আমাদের বর্ধিত আয়ের ঘোষণার ফলে আমাদের স্টকের মূল্য বেড়ে গেল, ফলে ডিজনির প্রকৃত ক্রয়মূল্য আর আগের জায়গায় থাকল না, তৎক্ষণাত আমরা আরও ব্যয় বহুল হয়ে উঠলাম। দ্বিতীয়ত, কমক্যাস্টের শেয়ার হোল্ডাররা ব্রায়ানের ডিজনি ক্রয়ের ঘোষণায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাল। তাঁরা ব্রায়ানের ঘোষণার সমর্থন দিলেন না। কমক্যাস্টের শোয়ারের মূল্য দ্রæত নিচের দিকে নেমে গেল। ডিজনি ক্রয়ের সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেল। ফলে ডিজনি ক্রয়ের প্রস্তাবে আর তেমন কোন জোর থাকল না। সর্বশেষ, মিডিয়াতে প্রকাশিত ডিজনি বিক্রয়ের দরপত্র জনগণ মন থেকে মেনে নিল না। ডিজনি একটি আমেরিকান ব্রান্ড এবং এটি এখনও মানুষে আবেগে অনুরণন সৃষ্টি করে। কমক্যাস্টের মতো একটা কেবল কোম্পানি ডিজনিকে গিলে খাবে এটি জনগণ মেনে নিতে পারেননি। কমক্যাস্ট অবশেষে তাঁদের দরপত্র প্রত্যাহার করে নেয়।
মাইকেলের সমস্যাগুলো কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। পরের মাসে প্রায় তিন হাজার ডিজনি শেয়ারহোল্ডার আমাদের শেয়ারহোল্ডার মিটিং-এ যোগদানের জন্য ফিলাডেলফিয়ায় সমাবেত হয়েছিলেন। মিটিং-এর আগের রাতে ডাউন টাউনের একটা হোটেলে রয় এবং স্ট্যানলির ‘ডিজনি বাঁচাও’ দলটি একটা বড় জনসভা করলো। মিটিংটি অনেক মিডিয়ার কাভারেজ পেয়েছিল। যেখানে রয় আর স্ট্যানলি তীব্রভাবে মাইকেলের সমালোচনা করছিলেন এবং ডিজনির নেতৃত্ব পরিবর্তনের জোর দাবী জানাচ্ছিলেন। জনসভা চলাকালীন সময়ের কোন এক পর্যায়ে জেনিয়া আমার কাছে আসলেন এবং বললেন, ‘আমাদের ঘর থেকে বের হওয়া দরকার এবং মিডিয়ার সামনে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরা জরুরী। প্রচারিত গল্পের বিপক্ষে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করা দরকার।’ মাইকেল কখনও তা করতে যাবেন না। এতে বিরোধীতা আর রেষারেষির মাত্রা আরও বাড়বে। অগত্যা আমাকেই হাল ধরতে হয়েছিল।
জেনিয়া দ্রæত গণমাধ্যমের কয়েক জনকে জানিয়ে দিলেন আমি শেয়ার হোলাডারেরর সম্মেলন কেন্দ্রে যাচ্ছি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার জন্য। আমরা দুজন সম্মেলন স্থলের লবিতে হেঁটে উপস্থিত হলাম। দৈত্য আকারের ভিন্ন ভাবে আকৃতি দেয়া ৭৫টি মিকিমাউস সভা স্থলে ওরল্যান্ড থেকে পরিবহন করে এখানে আনা হয়েছে শেয়ার হোল্ডারদের সভার জন্য। আমি এদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক ঘন্টাব্যাপী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আমার কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না, তেমন কোন নথিপত্রও আমার সাথে ছিল না। তাঁরা কোন প্রশ্নগুলো করেছিলেন এখন তার কোন কিছুই মনে নেই। তবে এটুকু বলতে পারি সব প্রশ্ন ছিল শেয়ার হোল্ডার মিটিং সংক্রান্ত। আমরা কিভাবে রয় এবং স্টেনলির সমালোচনার জবাব দেবো তার পরিকল্পনা সম্পর্কে। আমার বক্তব্য ঝাঁজালো ও বিধ্বংসী ছিল। আমি আমার কোম্পানির সুরক্ষার জন্য কথা বলেছি। মাইকেলকে সমর্থন করে কথা বলেছি। রয় আর স্ট্যানলির কর্ম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি আমার সংশয় প্রকাশ করেছি। এটিই আমার জীবনে প্রথম আমি ঘন্টা ব্যাপী সাংবাদিকদের যাচাই-বাছাই মূলক প্রশ্নের উত্তর দিলাম। জলস্রোতকে বীপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার কোন উপায় ছিল না। তবে আমি নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়েছিলাম, তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। যখন আমি পিছন ফিরে সেই মুহুর্তগুলোর দিকে তাকায়, স্পষ্ট দেখতে পায় এক মুহূর্তের জন্য আমি ভেঙ্গে পড়িনি বা ভয় পায়নি তখন আমি গর্ব বোধ করি।
পরদিন ভোর ৫টায় শেয়ারহোল্ডারদের বড় লাইন চোখে পড়ল। কয়েক ঘন্টা পর যখন দরজা খোলা হলো তখন জলস্রোতের মতো তাঁরা এসে হলরুম ভরিয়ে দিল। অতিরিক্ত অনেক শেয়ারহোল্ডরদের বড় ওভারফ্লো রুমে পাঠান হলো যাতে তাঁরা ক্লোজ-সার্কিট টিভিতে মিটিং এর কার্য বিবরণী দেখতে পান। মাইকেল আর আমি উদ্বোধনী বক্তৃতা দিলাম। তারপর আমাদের প্রত্যেক বিভাগের প্রধান তাঁদের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরলেন।
রায় এবং স্টেনলিকে পনের মিনিট করে সভায় বক্তৃতা করতে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তবে তাঁরা স্টেজে উঠে বক্তৃতা দেবার অনুমতি পাননি। তাঁরা নিজ আসন থেকেই বক্তৃতা দিয়েছেন। যখন তাঁরা বক্তৃতার সময় সীমা অতিক্রম করলেন তখন তাঁদের সম্মানের সাথে বক্তৃতা শেষ করার অনুরোধ করা হল। উভয়েই উত্তপ্ত বত্তৃতা দিলেন। বক্তৃতা শেষে রুমের অনেক মানুষ তাঁদের অভিবাদন জানালেন। শেষে আমরা এক ঘন্টা ব্যাপী শেয়ার হোল্ডারদের প্রশ্নের উত্তর দিলাম। মাইকেল জানতেন মিটিংটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক আর হট্টগোলে পরিপূর্ণ থাকবে। মাইকেল প্রশংসনীয়ভাবে নিজের সম্মান বজায় রেখেছিলেন। অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও যে আমারা আমাদের স্টকের মূল্য বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি তঁর জন্য তিনি আমাদের প্রশংসা করলেন। তিনি কোম্পানির প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা, তাঁর আবেগের কথা তুলে ধরলেন। কিন্তু দিনটি তাঁর ভালো যাবে না সেটা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল তিনি তা স্বীকার করলেন।
যখন শেয়ার হোল্ডারদের প্রতিনিধিত্ব ভোট গণনা করা হচ্ছিল তখন দেখা গেল ৪৩ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার মাইকেলকে ভোট দেন নায়। এটি ছিল অবিশ্বাসের ধ্বংসাত্মক প্রতিফলন। আমরা ভোটের গণনা শতাংশে প্রকাশ করিনি। আমরা সংখ্যায় প্রকাশ করেছি যাতেকরে শুনতে অতটা খারাপ না লাগে। যখন ফলাফল ঘোষণা করছি তখন রুমের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের একটা জটিল শব্দ কর্ণকুহরে পবেশ করছিল।
শেয়ার হোল্ডারদের বৈঠকের পরেই ডিজনি বোর্ড একটা নির্বাহী সভায় মিলিত হলেন। তাঁরা জানতেন ভোটের ফলাফলের প্রেক্ষিতে তাঁদের কিছু একটা করা দরকার। মাইকেলকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হল। কিন্তু তাঁকে প্রধান নির্বাহী হিসাবে থাকার অনুমতি দেয়া হল। জর্জ মিচেল মেইন এলাকা থেকে নির্বাচিত আমেরিকার সংখ্যাগড়িষ্ট দলের প্রাক্তন সিনেট সদস্য ছিলেন। তিনি ডিজনি বোর্ডেরও সদস্য। শেয়ারহোল্ডাররা মাইকেলের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য মিচেলকেই বেশি বেশি ভোট করেছিলেন । মাইকেল তাঁদের অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অনিবার্য কারনেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সেদিন আর একটা চুড়ান্ত অমর্যাদাকর ঘটনা ঘটতে তখনও বাকী ছিল। খবরটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে আমাদের নিজস্ব টিভি প্রগ্রাম নাইটলাইনে সেটা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে দিনের নাইটলাইনে ‘ডিজনি বাঁচাও’ আন্দোলন এবং শেয়ার হোল্ডারদের ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। আমরা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মাইকেল এবং ডিজনির ভালোর জন্যই আমাদের উচিৎ হবে নাইটলাইনের সঞ্চালক টেড কপেলের মুখোমুখি হওয়া। মাইকেলকে তাঁর কর্মের অপ্রীতিকর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। এটি আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে? ডিজনিকেই বা এটি ভবিষ্যতের জন্য কি দিক নির্দেশনা দিচ্ছে? তাঁর নিজের সংবাদ মাধ্যমের লোকজন তাঁকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য তদন্তমূলক প্রশ্ন করবেন। এটি তাঁর কাছে অতিশয় বেদনাদায়ক। কিন্তু তিনি এটি সাহসের সাথেই সম্পন্ন করলেন।
মার্চ মাসের শেয়ারহোল্ডার মিটিং এবং বোর্ড চেয়ারম্যানের পদ হারানোর মধ্যে দিয়ে মাইকেলের শাসন আমলের পরিসমাপ্তির পথ পরিক্রমা শুরু হল। তিনি ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে তিনি বোর্ডের কাছে চিঠি পাঠালেন যে তাঁর প্রধান নির্বাহী পদের চুক্তি শেষ হবে ২০০৬ সালে এবং তিনি সেই সময়েই পদ ছেড়ে দেবেন। দুই সপ্তাহ পরে বোর্ড সভায় মাইকেলের প্রস্তাব গৃহীত হল। পরে একদিন জর্জ মিচেল আমার সাথে দেখা করলেন। তিনি বললেন তাঁরা একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে যাচ্ছেন যে মাইকেলের চুক্তি শেষে তিনি সেটি আর নবায়ন করবেন না। এখনই একটা অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু হবে যাতেকরে ২০০৫ সালের জুন নাগাদ নতুন একজন প্রধান নির্বাহী বাছাই করা সম্ভব হয়। উপযুক্ত কাউকে পাওয়া গেলে ২০০৫ এর শরতে মাইকেলকে সরিয়ে তাঁকে নিয়োগ করা হবে। চুক্তি শেষ হবার এক বছর আগেই তাঁকে অপসারণ করা হবে।
আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন। জর্জ বললেন, ‘আমরা প্রষ্ঠিানের বাইরের প্রার্থী এবং প্রতিষ্ঠানের ভেতরের প্রার্থীদের যঁচাই বাছাই করবো।’
‘আমি ছাড়া কি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে আর কোন প্রার্থী আছে?’
তিনি বললেন, ’কেউ নেই, আপনিই একমাত্র ভেতরের প্রার্থী।’
’তাহলে আপনাদের সেটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে লিখতে হবে। আপনারা মাইকেলকে ক্রমেই দূর্বল করে ফেলছেন, আর এ অবস্থায় এখন পর্যন্ত আমিই প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, আমাকে তো কোম্পানি চলাতে হবে।’ আমি বুঝি আমিই যে মাইকেলের উত্তরসুরী হবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু কোম্পানির ভেতরের মানুষদের জানা দরকার আমিই একমাত্র সম্ভাবনাময় ব্যক্তি যিনি মাইকেলের জায়গায় বসতে পারেন। (চলবে)