রবার্ট ইগার, অনুবাদ: কোরবান আলী : (ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবত কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহত মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিকদা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’-এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)
এক.
প্রথম অধ্যায় : শেকড়ের কথা
এটি কোন আত্মজীবনী নয়। ছেলেবেলায় আমি যে জীবন দক্ষতা অর্জন করেছি তার বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। কিন্তু এগুলো আমার পেশাগত জীবনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলো, আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একটা নির্দিষ্ট নিয়মে আমি প্রতিপালিত হয়েছি, একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আমি আমার দৈনন্দিন কাজগুলো সম্পাদন করেছি। এগুলোর পেছনে প্রকৃতি আর লালন-পালনের ধরন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। (আমার যতদূর মনে পড়ে আমাকে সব সময় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠানো হোত। ফলে পৃথিবীর অন্য সবাই জেগে উঠার আগেই আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নেবার জন্য কয়েক ঘন্টা নিজের যত্নে ব্যয় করতাম।) আরও বেশ কিছু জীবন দক্ষতা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো যা পরবর্তিতে আমার জীবন চলার পথে অনেকগুলো তাত্পর্য পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। অনেকের মতো এ সমস্ত সিদ্ধান্তগুলো আংশিকভাবে আমাদের পিতা-মাতা গ্রহণ করেছিলেন, বিশেষত আমার বাবা, একজন বুদ্ধিদীপ্ত জটিল মানুষ, যিনি আমাকে আমার বর্তমান আমিতে রূপান্তর করেছেন।
তিনি নিশ্চত্ভাবে আমার মধ্যে পৃথিবী সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের ছোট পড়ার ঘরে বই-এ ঠাসা অনেকগুলো বুক শেল্ফ সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছিলো। সমস্ত বই আমার বাবার পড়া। আমি হাই ইস্কুলে যাওয়া পর্যন্ত বই পড়ার তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না। এক সময় বই পড়া একটা নেশায় পরিণত হলো। এটি তার কারণেই সম্ভব হয়েছিলো। আমেরিকান সাহিত্যেরবিশালসাহিত্য বিশারদদের রচনা সমগ্র আমার বাবার বুক শেল্ফে সাজানো ছিলো। ফিডজেরাল্ড, হেমিংওয়ে, ফকনার, স্টেইনবেক আরও অনেক। ‘টেন্ডার ইন দা নাইট’ বা ‘হোম দা বেল টোলস’ আরও অনেক বই এর মধ্যে আমি প্রতিনিয়ত হারিয়ে গেছি। তিনি আমাকে আরও বই পড়ার জন্য উত্সাহ দিয়েছেন। রাতের খাবারের টেবিলে বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হোত। আমার যখন দশ বছর বয়স,তখন থেকে নিউইওর্ক টাইমস আমি হাতে পেতাম খুব সকালে আর সবার জেগে উঠার আগেই রান্না ঘরের টেবিলে বসে পড়ে ফেলতাম।
আমদের বাসা ছিলো লংআইল্যান্ডের ওসেন সাইড এলাকায়, মূলত শ্রমজীবী মানুষের বসবাস এ এলাকায়। আমার বাবা-মার আমিই বড় সন্তান, বোনটি আমার তিন বছরের ছোট। আমার মা বেশ হাসি-খুসি থাকতেন, আমাদের দু’জনেরই খুব প্রিয় মানুষ। আমার হাই ইস্কুলে যাওয়া পর্যন্ত মা বাসাতেই থাকতেন। আমি হাই ইস্কুলে ভর্তি হোলে মা স্থানীয় জুনিয়র হাই ইস্কুলের লাইব্রেরীতে কাজ পান। আমার বাবা যুদ্ধ ফেরত নেভি কর্মকর্তা ছিলেন। বড় আকারের জীর্ণ ব্যান্ডের সাথে শিংগা বাজাতেন। শখে বাজাতেন, কখনও পেশাদার বাদক হবার চেষ্টা করেন নি। তিনি পেন্সিলভেনিয়া বিশ্বদ্যিালয়ের হোয়ার্টন ইস্কুল থেকে মার্কেটিং প্রধান পাঠ্য বিষয় নিয়ে পাস করেন। একটা খাদ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানে তিনি মার্কেটিং ডিপার্মেন্টে প্রথম কাজ পান। পরে বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন। তিনি মেডিসন এভিনিউতে একটা বিজ্ঞাপন সংস্থার হিসাব বিভাগের নির্বাহী নিযুক্ত হন।
বিনোদনমূলক ওল্ডমিল ওয়াকি ও ব্রন্সউইক খেলাধূলার হিসাব দেখা শুনা করতেন। বেশিদিন এ চাকুরী ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি বেশ কয়েক বার সংস্থা পরিবর্তন করেন। প্রায় সবক্ষেত্রেই চাকুরীচ্যুতি। আমার বয়স তখন দশ বা এগারো । আমি বিস্মিত হোতাম আর ভাবতাম আমার বাবার ক্ষেত্রে কেনো এমনটি ঘটছে।
আমার বাবা গভীরভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি উদারনীতির পক্ষে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। একবার ওয়াশিংটনে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মিছিলে যোগ দেয়া এবং তার ভাষণ শুনতে যাওয়ার জন্য চাকুরী হারালেন। তাঁর বস তাকে ছুটি দিলেন না, তবুও তিনি মিছিলে গেলেন। আমি জানিনা তিনি কি চাকুরী ছেড়ে মিছিলে গেলেন নাকি বসের আদেশ অমান্য করার জন্য চাকুরীচ্যুত হোলেন। এরকম বহুবার ঘটেছে তার পেশাগত জীবনে।
তাঁর শক্তিশালী চারিত্রিক বৈশিষ্ট আর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আমি গর্ববোধ করতাম। কোনটি সঠিক, কোনটি সুন্দর সে সম্পর্কে তার তীক্ষ্ণ জ্ঞান ছিলো। প্রতিযোগিতায় যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল কিন্তু জেতার সম্ভাবনা আছে তিনি সবসময় তার পক্ষ নিতেন। কিন্তু তিনি তাঁর মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। মেজাজ আর কথা বলার ধরনের জন্য তাকে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হোত। পরে জানতে পারলাম তিনি এক ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সুস্থ হবার জন্য বৈদ্যুতিক শক সহ নানা ধরনের চিকিত্সা নিয়েছিলেন। তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ অনেক সময় আমারও বোধগম্য হতো না। বড় ছেলে হিসাবে আমাকেই ভুগতে হয়েছে বেশি। আমি তার মেজাজের জন্য কখনও ভয় পাই নি। কিন্তু আমি তাঁর এ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তটস্থ থাকতাম, আমার মধ্যে একটা দুঃখবোধ কাজ করতো।প্রতি রাতে আমার দোতলার ঘরে বসে বাবার ঘরে ফেরার শব্দ শুনতাম। তাঁর দরজা খোলা আর লাগানোর শব্দ, হেঁটে ঘরে ঢুকার শব্দ আর অনুমান করতাম আজকে আমার কেমন বাবা ফিরলেন? হাসি খুশি বাবা না হতাশাগ্রস্থ বাবা? আজ আমার বাবা কেমন আছেন? মেজাজ কেমন।
কোন কোন সময় তিনি আমার দরজায় মৃদু শব্দ করে ঢুকে পড়তেন। নিশ্চিত হোতে চাইতেন আমি কি তার দেখানো সময় বিভাজন ও সময় ব্যবস্থাপনা মেনে চলছি কিনা। নিশ্চিত হোতে চাইতেন আমি কি আমার সময়গুলো ইতিবাচক খাতে ব্যয় করছি কি না। গল্পের বই পড়ছি অথবা ইস্কুলের পড়া করছি অথবা এমন কিছু করছি যা আমার কাজে আসবে। তিনি চাইতেন আমি আমার ছোটবোনকে একটু সময় দেই, তার সাথে খেলা করি। তার চেয়েও বেশি চাইতেন আমরা যেনো আমাদের সময়গুলো বুদ্ধিদীপ্তভাবে কাজে লাগাই। যখন যেটা করি নিষ্ঠার সাথে করি কিনা এটা তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। সময় ব্যবস্থাপনায় আমার যে সর্বোচ্চ সতর্কতা সেটা আমি তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি।
ছোট বেলায় নিজেকে আমার পরিবারের সকল কাজের কাজী ভাবতাম। বাড়ি এবং এমন কি বাড়ির চারপাশের যে কোন সমস্যা সমাধানে আমি হাজির থাকতাম। বাসায় কোন কিছু নষ্ট বা অচল হয়ে পড়লে মা আমাকে ঠিক করার জন্য বলত। এভাবেই আমি অনেক ছোট বয়সেই শিখে ফেলেছি ছোট খাটো মেরামতের কাজ। আমার মনে হয় এখান থেকেই আমার ভেতরে প্রযুক্তির প্রতি ভালোবাসার জন্ম। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে ভালোলাগতো। বাসায় যে সমস্ত ছোট খাটো যন্ত্র ব্যবহার হোত সেগুলো খুলে আলাদা করতাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম কিভাবে সে সব কাজ করে।
আমার মা-বাবা দু’জনই ভীতুর ডিম ছিলেন। তাঁরা দু‘জনই সব সময় চিন্তায় থাকতেন কখন কি বিপদে পড়ি। আমি জানিনা এর কতটুকু বংশগতির প্রভাব আর কতটুকু অভিজ্ঞতালব্ধ। তবে আমি সব সময় নির্বিকার থাকতাম, ভয় পেতাম না। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভবিষ্যত নিয়ে খুব একটা ভয় পেতাম না। কোন কিছু অর্জনের জন্য চেষ্টা করলে, অকৃতকার্য হবার তেমন একটা ভয় মনের মধ্যে কাজ করতো না।
যতই বড় হোতে লাগলাম ততোই বাবার হতাশার কারণ সম্পর্কে বুঝতে শিখলাম। বাবা একটা অতৃপ্ত জীবন যাপন করেছেন। নিজের চোখের সামনে নিজেকে পরাজিত হোতে দেখেছেন। তাই প্রতিনিয়ত আমাদের কঠিন পরিশ্রমের জন্য ধাক্কাধাক্কি করতেন। যাতে আমরা উত্পাদনশীল হই। আমরা যেন এমন কৃতিত্ব অর্জন করি যা তিনি কখনও অর্জন করতে পারেননি। তাঁর চাকুরী নিয়ে সমস্যা লেগেই থাকতো, ফলে আমার খরচের টাকা নিজে রোজগার করার তাগিদ অনেক ছোটবেলা থেকেই অনুভব করতাম। যখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকেই আয়-রোজগারের পথ ধরে ফেলি। বসত ভিটার বরফ সরানোর কাজ করেছি, বাচ্চা দেখা শোনার কাজ করেছি, লোহা লক্করের দোকানেও কাজ করেছি। যখন আমার পনের বছর বয়স, তখন আমি আমারই স্কুলে গ্রীষ্মকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পাই। ইস্কুলের সমস্ত শ্রেণি কক্ষের হিটার পরিষ্কার করতাম, শ্রেণি কক্ষের প্রত্যেকটি ডেস্কের নিচে আঠালো গাম লেগে থাকতো, ওগুলো পরিষ্কার করতাম। কয়েক হাজার ডেস্কের নিচ থেকে গাম পরিষ্কার করা মানুষের চরিত্রে একটা নিশ্চিত প্রভাব ফেলে। কমপক্ষে একঘেঁয়েমী সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
আমিই থাকা কলেজে ভর্তি হই। আর সপ্তাহ শেষে প্রায় প্রতি রাতে স্থানীয় পিজা হাটে পিজা তৈরির কাজ করি। আমার কলেজের নবীন প্রথম বছর আর মার্জিত পরিশিলীত দ্বিতীয় বছর এ ভাবেই কেটে যায়। উচ্চ বিদ্যালয়ের এই দু’বছরে বেশির ভাগ বিষয়েই ‘বি’ পেয়েছি অল্প কিছু বিষয়ে ‘এ’। ইস্কুল শিক্ষায় পাণ্ডিত্য অর্জনের আমার তেমন কোন উচ্চাকাঙ্খা ছিলো না। তবে আমি সংকল্পবদ্ধ ছিলাম যতদূর সম্ভব ভালো ফলাফল করবো এবং কঠোর পরিশ্রম করতাম ইস্কুলে ভালো গ্রেড পাবার জন্য। এ চিন্তা-চেতনাটা ও আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। তিনি প্রায়ই হীনমন্যতায় ভুগতেন, তিনি কিছুই করতে পারলেন না। সেখান থেকেই আমার সংকল্প আমাকে কোথাও ব্যার্থ হওয়া যাবে না। সফলতা সম্পর্কে আমার কোন পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। আবার কখনও এমন কোন উচ্চাকাঙ্খা ছিলো না অনেক সম্পদের মালিক হবো বা অনেক ক্ষমতাবান হবো। তবে আমি সংকল্পবদ্ধ ছিলাম কখনোই হতাশাগ্রস্থ জীবন যাপন করবো না। আমি বিশ্বাস করতাম পরিশ্রমী হোলে অবশ্যই একটা পরিপূর্ণ এবং হতাশামুক্ত জীবন যাপনের সুযোগ আমার জীবনে আসবে।
ছোট বেলা থেকেই আমার মধ্যে কোন দুঃখবোধ কাজ করতো না, শুধু একটাই কষ্ট আমার বাবা সুখী জীবন পেলেন না। যার কারণে আমার মাকেও অনেক ভোগান্তি সহ্য করতে হলো। আমি মনে প্রাণে চাইতাম আমার বাবা যদি তার জীবন নিয়ে গর্ববোধ করতেন। আমার ছোট বোন আর আমি কখনোই আদর স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হইনি। আমাদের মাথার উপর ছাদ আর টেবিলে খাবার ছিলো পর্যাপ্ত। এর বাইরে কোন কিছু করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা পয়সা ছিলো না। ছুটির দিনগুলোতে একই জায়গায় বার বার যাওয়া হোত, একই সমুদ্র সৈকতে বার বার যেতাম। বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের রাস্তা আমাদের গাড়িতে করে যেতাম।
আমাদের পরার জন্য যথেষ্ট জামা-কাপড় ছিলো যা পরলে সুন্দর দেখাতো। কিন্তু অতিরিক্ত সার্ট প্যান্ট ছিলো না। ছোট বেলায় খেলাধূলা, লাফালাফি করতে যেয়ে আমার দুটো প্যান্টই ছিঁড়ে যেতো। আমাকে বলা হতো সেলাই করে পরতে। কয়েক মাস লেগে যেতো আরেক জোড়া নতুন পেতে। আমি কখনও নিজেকে গরীব ভাবতাম না। আবার কেউ আমাকে সেভাবে দেখতোও না। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন, যা আমি বড় হয়ে বুঝেছি। পরে পরিধানের কাপড় সম্পর্কে সচেতন হয়েছি।
জীবনের অনেকটা সময় পার হওয়ার পর, যখন আমি ডিজনির প্রধান নির্বাহী হোলাম, আমি আমার বাবাকে দুপুরের খাবারের জন্য একটা রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলাম। আমরা তার মানসিক স্বাস্থ নিয়ে কথা বললাম। তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে কথা বললাম। আমি তাঁকে বললাম এটা যে কি পরিমাণ প্রশংসাযোগ্য যা কিছু আপনারা দু’জন ছোট বেলায় আমাদের দিয়েছেন। যে নৈতিক শিক্ষা, যে ভালোবাসা আমরা আপনাদের দু’জনের কাছ থেকে পেয়েছি তার কোন বিনিময় মূল্য হয় না। আপনারা দু’জন যা কিছু আমাদের দিয়েছেন তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর প্রতি আমার এই শ্রদ্ধাপূর্ণ কথা বার্তা কিছুটা হোলেও তার হীনমন্যতাকে কমাতে সক্ষম হয়েছে। আমি এটাও নিশ্চিত যে তাঁর কাছ থেকে যে চারিত্রিক বৈশিষ্টসমূহ আমরা পেয়েছি সেগুলো আমার পেশাগত জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, আমাকে এই পর্যন্ত আসতে ভীষণভাবে সহয়তা করেছে। আশা করি তিনি বিষয়গুলো বুঝতে পারবেন।
আমার পেশাগত জীবন শুরু হয় ১৯৭৪ সালের ১লা জুলায় এবিসি টেলিভিশনের চিত্রশালার তত্বাবধায়ক হিসাবে। ইতিপূর্বে নিউইওর্কের একটা ছোট্ট কেবল টিভিই থাকায় এক বছর আবহাওয়া ভাষ্যকার এবং প্রতিবেদক হিসাবে কাজ করেছি। এ কাজ সম্পর্কে আমার অস্পষ্ট ধারণা ছিলো, আমি মাঝারি মানের একজন কর্মী ছিলাম। এ তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাকে ‘বিশিষ্ট নির্ভরযোগ্য সংবাদদাতা’ হবার স্বপ্ন ত্যাগ করার জন্য তাগিদ দেয়। রসিকতা মনে হোলেও সত্য, ইথাকার লোকজন আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা শিখিয়েছে, সেটা হচ্ছে কিভাবে অসুখকর সংবাদ পরিবেশন করতে হয়। আমার জীবনের দীর্ঘ আর বিবর্ণ ছয় মাস অক্টোবর থেকে এপ্রিল, আমি শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষদের কাছ থেকে দূরে ছিলাম।
আমার মামা বব’কে ধন্যবাদ। তাঁর কারণেই আমার এবিসিতে কাজ পাওয়া। আমার মায়ের ভাই, চোখে অস্ত্রপচারের জন্য ম্যানহাটন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চোখে অস্ত্রপাচারের পর তাঁর দেখা শোনার জন্য কয়েক দিন হাসপাতালে ছিলাম। আর তার রুম মেট ছিলেন এবিসি টিভির একজন নিম্নস্তরের নির্বাহী। কিন্তু আমার মামা বলতেন তিনি টিভি নেটওয়ার্কের একজন হোমরা চোমরা মানুষ। আমার জানা হয়নি আমার মামা কেন আমাকে এটি বিশ্বাস করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি হাসপাতালের বেডে বসে মিথ্যা ফোন কল ধরতেন আর আমার মামাকে বোঝাতে চায়তেন একমাত্র তিনিই এবিসি নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেন। আমার মামাও এগুলো বিশ্বাস করতেন। তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেবার আগে একদিন আমার মামা তাকে বিনয়ের সাথে বললেন, আমার ভাগ্নে নিউইওর্কে টেলিভিশনের ছবি নির্মাণ হাউসগুলোতে কাজ খুঁজছে। মানুষটি তখন তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে আমার মামাকে বললেন, ‘আপনার ভাগ্নেকে বলেন আমাকে ফোন করতে’।
যখন আমি তাঁকে অনুসরণ করে চলেছি তখন সে আমাকে নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্ত কিছুটা বিষ্মিতও বটে। মামা যেভাবে বর্ণনা দিয়েছিলেন আমি সে রকমই একজন ক্ষমতাবান নেটওয়ার্ক নির্বাহী প্রত্যাশা করছিলাম যার প্রভাব থাকবে কম্পানীর একে বারে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু তাঁর দৌড় তেমন বিস্তৃত ছিলো না। ছবি নির্মাণ কারখানায় একটা ছোট্ট সেবা শাখার প্রধান ছিলেন। চাকুরীক্ষেত্রে তাঁর সুনামের কারণে ছবি নির্মাণ হাউসে একটা সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিলেন। এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এবিসি চিত্রশালার তত্বাবধায়ক পদে আমার চাকুরী হয়ে গেলো। (চলবে)