অনলাইন ডেস্ক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। গত শুক্রবার মার্কিন সাময়িকী পলিটিকোতে এ খবর প্রকাশের পর থেকে এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে গত সোমবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী পলিটিকোর খবরটি দেখেছি। তবে এ খবরের বাইরে এ বিষয়ে আর কিছু জানা নেই। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফ থেকে কিছু জানানো হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য নেই। তবে সর্বান্তকরণ প্রত্যাশা হচ্ছে, খুনি ফেরত আসুক এবং বিচারের রায় কার্যকর হোক।

এর আগে ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুর অপর খুনি বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে দেয়। পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্যালিফোর্নিয়ার অভিজাত এলাকা হ্যাকলবেরি ড্রাইভে বিপুল সম্পদের মালিক রাশেদ চৌধুরী অভাবনীয় বিলাসী জীবন-যাপন করছেন।

পলিটিকোর খবরে যা আছে : পলিটিকোর খবরে বলা হয়েছে, প্রায় ১৫ বছর আগে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। এতদিন পর গত ১৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপিলসকে (বিআইএ) চিঠি দিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। চিঠিতে একজন গুরুতর অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বোর্ড কোনো ভুল করেছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্নিষ্ট বিষয়ে নথি তলব করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ। পলিটিকোর পর্যালোচনা অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের সুযোগ হারাতে পারেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে বঙ্গবন্ধুর পলাতক এই খুনির।

বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরাতে গত প্রায় এক যুগ ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। খুনি রাশেদ চৌধুরীর প্রত্যর্পণ চেয়ে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলস ঢাকা সফরে এলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চান। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি রাশেদ চৌধুরীর নথিপত্র চান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত নথিপত্র যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পাশাপাশি নিয়মিত তৎপরতা অব্যাহত রাখে। এই তৎপরতার ফসল হিসেবেই রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ পর্যালোচনা করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বিলাসী জীবন রাশেদ চৌধুরীর : যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সূত্র জানায়, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার পর কলোরাডো, ইলিনয় এবং মিসৌরিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বসবাস করেছেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী সেক্রামেন্টো থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরের শহর কনকর্ডের হ্যাকলবেরি ড্রাইভে বসবাস করছেন। ২০১৫ সালে কনকর্ডে প্রায় চার লাখ ষাট হাজার ডলার দিয়ে কেনা বাড়িটির বাংলাদেশি টাকায় বর্তমান মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি দশ লাখ টাকা। কনকর্ডের বাড়ি কেনার সময় অংশীদার হিসেবে রাশেদ চৌধুরীর স্ত্রী মমতাজ চৌধুরী ও বড় ছেলে রূপম চৌধুরীকে দেখানো হয়েছে।

এর আগে ২০১০ সালে সেক্রামেন্টোতে প্রায় এক লাখ আট হাজার ডলার দিয়ে আর একটি বাড়ি কিনেছিলেন রাশেদ চৌধুরী। বাংলাদেশি টাকায় যার বর্তমান মূল্য প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা। এই বাড়ির অংশীদার হিসেবে দেখানো হয়েছে তার অপর ছেলে সুনাম এম চৌধুরীকে। রাশেদ চৌধুরীর বড় ছেলে রূপম চৌধুরী ওয়ালনাট ক্রিকে ২০১৬ সালে প্রায় দশ লাখ ৪০ হাজার ডলারে আর একটি বাড়ি কেনেন, বাংলাদেশি টাকায় যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১১ কোটি চার লাখ টাকা। এই বাড়িতেই রূপম তার স্ত্রী কাজল এন ইসলাম এবং দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন।

ফিরে দেখা খুনিদের পুনর্বাসন ও বিচার : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীদের বিচারের পথ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে রুদ্ধ করেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং উল্টো তাদের চাকরি দিয়ে বিদেশে বিলাসবহুল জীবন-যাপনের সুযোগ করে দেন। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ খোলে। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারের গতি শ্নথ হয়ে যায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দণ্ডিত আরেক খুনি আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে ২০০১ সালের ২ জুন মারা যান। সবশেষে গত ৬ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টায় রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থেকে বঙ্গবন্ধুর আর এক খুনি ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করে সরকার।

এর বাইরে পলাতক পাঁচ খুনি হচ্ছেন- আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং রিসালদার মোসলেম উদ্দিন। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রাশেদ চৌধুরী এবং কানাডায় আছেন নূর চৌধুরী। অপর তিন জন মোসলেম উদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম এবং খন্দকার আবদুর রশিদের অবস্থানের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।