মনজুর মাহমুদ : স্বপ্নের দেশ কানাডা! যে দেশে আসার জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ বছরের পর বছর অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে। কঠোর পরিশ্রম, বিপুল বিনিয়োগ কিংবা কখনও কখনো সৌভাগ্যবশত এদের কেউ কেউ আবার এসেও পড়ে। কিন্তু তারপর?
স্বপ্ন দেখা যদি হয় মুদ্রার এক পিঠ তবে স্বপ্নভগ্ন যে মুদ্রার অন্য পিঠ! আবাসন সংকট, জীবন যাপনে অতিরিক্ত ব্যয়, অভিবাসীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন না হওয়া, দক্ষতা আছে এমন পেশায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাকুরীর সুযোগ না পাওয়াসহ মুদ্রার অন্য পিঠের তালিকা আরো দীর্ঘ।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্থপতি কমাল মাক্কার ২০১৬ সাল থেকে দুবাইয়ে কাজ করছিলেন। ভারত ছাড়াও কাতার, সৌদি আরব ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের হাসপাতালের নকশা করে বেশ নাম করেছিলেন। দুবাইয়ে স্থায়ী অভিবাসনের সুযোগ না থাকার কারণে অন্যান্য দেশের বিষয়ে খোঁজ খবর করতে থাকেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের অভিজ্ঞতার কারণে কানাডাতে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান – যে দেশকে অসংখ্য মানুষের স্বপ্নের দেশ বলে শুনে আসছেন সেই ছোটবেলা থেকে। কোন দ্বিধা না করে ২০২১ এর জানুয়ারিতে চলে আসেন টরেন্টো। বরফে আচ্ছাদিত প্রকৃতি, বিশুদ্ধ বাতাস, মানুষের আন্তরিকতা — প্রথম পর্বের এসব কিছুই মনোমুগ্ধকর!
একটি নতুন দেশে আসার পর মানিয়ে নিতে সময় লাগবে এবং প্রথম দিকে কিছুটা সংগ্রাম থাকবে – এ ধরণের পরিস্থিতির জন্য মক্কার দম্পতি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজের সন্ধান দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।
কাজ পাওয়া যেন সহজ হয় সেজন্য বড় প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কমিয়ে দেখাতে পরামর্শ দেয় নিয়োগদাতা এজেন্সিগুলো। এতদিনের অর্জন এভাবে ছেঁটে ফেলেও কাজ মেলে না, নিয়োগদাতাদের চায় কানাডাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা। এদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এক পর্যায়ে তাঁকে বিনা মজুরিতে শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়। আর বিকল্প হিসাবে নূন্যতম মজুরিতে অন্য একটি কাজের প্রস্তাব দেয়া হয়।
মক্কার বলেন, “আমি উচ্চ পর্যায়ে কাজ করছিলাম – অনেক বড় বড় প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এদেশে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আবারো শূন্য থেকে শুরু করা সেটা আমাদের জন্য একটু বেশিই হয়ে যায়। শেষমেশ মক্কার দম্পতি দুবাইয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন।”
ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল হ্যান বলেন, ঐতিহাসিকভাবে কানাডা নতুন অভিবাসী তথা সংখ্যার দিকেই মনোযোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু যে ধরণের দক্ষ অভিবাসী দরকার বা যেসব অভিবাসীর এদেশে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা আছে — এ রকম জনবল চিহ্নিত ও তাঁদেরকে আকৃষ্ট করা, সর্বোপরি তাঁদের আবেদন সফলভাবে যাচাই বাছাই করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।
“এতো কিছুর পরও কেউ স্থায়ী হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। এ কারণেই হয়তো এ ব্যয়বহুল বিনিয়োগ করা হয় না। আসলে নতুন অভিবাসীদের এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ওপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা বা সরকারের নীতি নির্ধারণে এগুলো গুরুত্ব দেয়ার বিষয়গুলো বরাবরই উপেক্ষা করা হয়েছে।”
জরিপ বলছে, প্রায় ৩০ শতাংশ নতুন এবং কম বয়সী অভিবাসীরা আগামী দুই বছরের মধ্যে এদেশ ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। ইনস্টিটিউট ফর কানাডিয়ান সিটিজেনশিপ (আইসিসি) এর পক্ষে লেজার পরিচালিত এ জরিপে জীবন যাপনে উচ্চ ব্যয় অভিবাসীদের প্রধান সমস্যা বলে উঠে এসেছে। জীবন যাপন ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতনে কাজ না পাওয়াকে তাঁদের এ সিদ্ধান্তের কারণ বলে উল্লেখ করেছে। এদেশে আসতে আগ্রহীদের কাছে কানাডা বসবাসের জন্য ভালো — এমন ধারণা না দেয়ার কথা বলেছেন এসব অভিবাসীরা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে ১৩,১০০ মানুষ কানাডা ত্যাগ করেছে যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি। এদের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ অন্টারিও প্রদেশের বাসিন্দা। এছাড়া ২০ শতাংশ ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং ১৪ শতাংশ আলবার্টার বাসিন্দা। অন্য এক হিসাবে, প্রতি ২০ মিনিটে একজন অধিবাসী কানাডা ত্যাগ করছে। এদের কেউ স্থায়ী অভিবাসী, কেউ অস্থায়ী, আবার কেউ কেউ কানাডার নাগরিক যারা খরচ কম এমন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চলে যাচ্ছেন।
সিমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটি প্রোগ্রামের পরিচালক এন্ডি ইয়াং বলেন, মানুষের প্রকৃত আয়ের সাথে বাড়ির মূল্যের পার্থক্য রীতিমতো ভয়ঙ্কর। অত্যন্ত দায়সারাভাবে আবাসন খাতের ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। আসলে আবাসন সংকটের গহŸরে মানুষের ‘কানাডা স্বপ্ন’ অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে।
ব?্তমান পরিস্থিতিতে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটছে না এবং কঠোর পরিশ্রম করেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাওয়ার কারণে এটা হচ্ছে। “সরকার যে পরিমাণ অভিবাসী আনছে বা আনার উদ্যোগ নিয়েছে, তাঁদের জন্য কি পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা আছে? অভিবাসীদের দক্ষতা কি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি?”
চলে যাওয়ার সংখ্যা যাই হোক না কেন, সামগ্রিকভাবে কানাডার জনসংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যান কানাডার হিসাবে, শুধুমাত্র ২০২২ সালে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১০ লাখের বেশি এবং এর মধ্যে ৯৬ শতাংশই এসেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন থেকে। গত বছর স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে এসেছে ৪ লক্ষ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ আর অস্থায়ী বাসিন্দা এসেছে প্রায় ৬ লক্ষ ৮ হাজার।
শ্রমজীবি জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দ্রুত অবসরগ্রহণে চলে যাওয়ার কারণে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অভিবাসীদের স্বাগত না জানিয়ে উপায় নেই উত্তর আমেরিকার এ দেশটির। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি, নির্মাণ ছাড়াও বিভিন্ন সেবাখাতে জনবলের চাহিদা মেটানো হয় মূলত: অভিবাসন থেকে। আর তাই, এসব গল্পের শেষ নেই। অনেক ক্ষেত্রে গল্প আবার একই রকম। শুধু স্থান-কাল-পাত্র আলাদা।