খুরশীদ শাম্মী : এক
বিচার বসেছে মেম্বার বাড়িতে। একটি নয়, দু’টি নয়, তিন তিনটি গৃহস্থ বাড়ি থেকে চুরির অভিযোগ তোলা হয়েছে। তালুকদার বাড়ির প্রতিনিধি ঘাড়ের রগ উঁচিয়ে বলে, ‘গ্রামে চোরের উপদ্রব বেড়েছে। চোর বাইরের কেউ নয়। চোর আমাদের গ্রামেরই। আপনারা সবাই তারে চেনেন। সে আমাদের গাছের আম পেড়ে খায়। গাছের ডাল ভাঙে’।
বিচার মজলিশ জুড়ে ‘চোর.. চোর’ এমনভাবে ধ্বনিত হয় যেন চোর ধরতে বেরিয়েছে সকলে দলবেঁধে।

মেম্বার চিৎকার করে, ‘থামেন আপনারা। এখানে চোর ধরতে বসি নাই। চোরের বিচার করতে বসছি। কথা শুনতে দেন।’
চৌধুরী বাড়ির প্রতিনিধি চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘মানুষের কাজই প্রমাণ করে তার জাত। চুরি করেই স্বপন প্রমাণ করে যে সে ছোট জাতের মানুষ’।
মিঞা বাড়ির প্রতিনিধি সাপের মতো ফোঁস-ফোঁস করে বলে, ‘আমি আর কী বলব? স্বপনের চোখ পড়ছে আমাদের আভিজাত্যে। আম চুরি করে খেলে তো হতো। ছেঁড়ে তো কড়া আম। আবার ডালও ভাঙে’।
‘স্বপন তুমি তো সবার অভিযোগ শুনলা। এইবার তুমি বলো, কেন তুমি গাছের কড়া আম ছেঁড়ো? আমার বিশ্বাস চৈত্র মাসের আম এতই কচি থাকে যে কোনো স্বাদও পাও না। তোমার সাফাই শুনি।’- একজন নিরপেক্ষ বিচারকের সুরেই বলে মেম্বার।
স্বপন কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজের সাফাই গাইতে শুরু করে, ‘মেম্বার সাব, এনাদের আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা। এনাদের গাছের আম খাওয়া তো দূরের কথা, আমি এই তিন বাড়ির ত্রি-সীমানা দিয়া চলাচল করি না’।

মেম্বারের চোখ ছানাবড়া। ‘এইডা কি শুনাইলা, স্বপন? তুমি এই তিন বাড়ির ত্রি-সীমানা দিয়া হাঁটো না। তয় গ্রামে চলাচল করো কেমনে?’
শুকনার দিনে রাস্তা, ক্ষেতের আইল দিয়া। বর্ষার সময় কোষা নৌকায়।
হা..হা..হা.. সম্মিলিত হাসি ধ্বনিত হয় মেম্বার বাড়ির উঠোনে।
হইল তো। হাসি থামান এইবার। এমন কিছু বলি নাই যে এমন দলে দলে হাসবেন।
‘আচ্ছা! গ্রামের একমাত্র হাঁটার রাস্তা তো মিঞা বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়া, তালুকদার বাড়ির পূর্ব দিক দিয়া গেছে। আর চৌধুরীর বাড়ির উত্তর দিক দিয়া গেছে পাকা রাস্তা। এইবার তুমি আমারে কও, রাস্তা দিয়া হাঁটার সময় এই তিন বাড়ি কাছাইয়া আসলে কি তুমি ক্ষ্যাতের আইল ধইরা হাঁটতে শুরু করো?’- প্রশ্ন জাল ছুড়ে দেয় মেম্বার।
না, মেম্বার সাব। কথায় কথায় তেনারা আমারে তেনাগো বাড়ির ত্রি-সীমান দিয়া হাঁটতে মানা করে। চতুর্থ সীমানায় তো মানা নাই।
‘মেম্বার সাব, দেখলেন তো কত্ত বড় বাটপাড়!’- হাঁপ ছেড়ে বলে তালুকদার বাড়ির প্রতিনিধি।
আমি বাটপাড় না। আপনারা চতুর লোক। আমার বিরুদ্ধে মতলব কষছেন যৌথভাবে। আমারে ফাঁসাইয়া নিজেদের মতলব হাসিল করতে চান।
‘এমন ডাহা মিথ্যা বলতে জিহ্বা আটকাইলো না, গলাও কাঁপল না তোমার?- চৌধুরী বাড়ির প্রতিনিধি প্রশ্ন করে।

‘মিথ্যা বইল না। শুকুন পড়বে’। -মিঞা বাড়ির প্রতিনিধি হুঁশিয়ারি হাঁক পাড়ে।
শকুন পড়ার আর বাকি আছে কিছু? জনগণও জানে, গ্রামের অভিজাত তিন শকুন-ই তো আমার পিছনে।
‘স্বপন, মুখে লাগাম লাগাও। কথাবার্তা একটু সংযত করো। বনিয়াদি বংশের মানী মানুষ, সম্মান দিয়া কথা বলো। আমি নিরপেক্ষ বিচার করতে পছন্দ করি। – মেম্বার শান্ত কণ্ঠে আওড়ায়।

মেম্বার সাব, তালুকদার বাড়ির বড় তালুকদার, মাঝর তালুকদার অভিযোগ তুলল না; চৌধুরীর বাড়ির বড় চৌধুরী সকালেও আমারে চা-শিঙাড়া খাওয়াইল, মাঝর চৌধুরী আসলো না; মিঞা বাড়ির বড় চাইরজন আসে নাই। কেবল ছোট তালুকদার, ছোট চৌধুরী, ছোট মিঞা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল, আর আপনে আমারে নিয়া বিচার বসাইলেন। একবার বিষয়টা ভাবলেনও না। আমি কারো বাড়ির কড়া আম কেন? কোনো কিছুই চুরি করি নাই কোনোদিন। আমি চোর না। গ্রামের আরও পাঁচ-সাত বাড়ি আছে, তাগো কাছে জিজ্ঞাসা করেন। আমি কোনোদিন কিছু চুরি করছি কি না?
তারা তো অন্যকিছু চুরির কথা বলছে না। এক আমের কথাই বলছে। আম বাগান তাদের আয়ের উৎস। কড়া আম হয়তো তুমি চুরির উদ্দেশ্যে না, নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ছেঁড়ো।
মেম্বার সাব, আপনে যে বিচার করবেন তা’ আমি মেনে নেবো। তবে বিচারের আগে প্রমাণ নিয়ে আসতে বলেন। স্মার্টফোনের যুগে প্রমাণ রাখতে আলাদা অর্থ ব্যয় করতে হয় না। একজন সাক্ষীও তো নাই তাদের।

হুম! প্রকৃত প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে স্বপনের বিরুদ্ধ্বে উত্তোলিত চুরির অভিযোগের সঠিক বিচার করা সম্ভব হলো না। আমি স্বপনকে সাবধান করে দিলাম। এরপরও যদি তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসে, তখন বিচার আরও কঠিন হবে। এবং যারা অভিযোগ আনবেন, তাদের কাছে অনুরোধ প্রমাণ ও সাক্ষীসহ অভিযোগ আনবেন।

দুই
বাংলা সনের শেষ দিন। বাড়িতে বাড়িতে চলছে উত্তমভাবে ঝুল ঝাড়া-পোঁছার কাজ। বাজারের দোকানগুলো জল ঢেলে ধুয়ে পরিষ্কার করছে মালিকেরা। চৈত্র সংক্রান্তির হিসেব নিয়ে মহাব্যস্ত খাজাঞ্চিবাবুরা। ময়রা বিরামহীন মিষ্টি তৈরি করে হাঁড়ি ভরে। টগবগ ফুটন্ত চিনির শিরার গন্ধে টইটম্বুর হাওয়া। ভিন গাঁয়ের বণিক দল নৌকা ভিড়িয়েছে খেয়াঘাটে। চৈতালি হাওয়ায় চামড়া পুড়ে পাঠাশালার মাঠে বাঁশ বেঁধে প্যান্ডেল টানানো হয়েছে পুরোদিন। বহু বছরের রেওয়াজ সাতদিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। গাঁয়ের যুবকেরাই আয়োজন করেছে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব। তবে নেপথ্যে দত্ত পরিবারের ভূমিকা বিরাট। তিন প্রজন্ম ধরে দত্ত পরিবার স্বেচ্ছায় যুক্ত থাকে বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনে। তাদের বাড়িতেই মহড়া হয়। আজও সন্ধ্যা নামতেই দত্ত বাড়ির আঙিনায় হ্যারিকেনের আলোয় পুঁথি পাঠের মহড়া বসে। বাতাসে ভেসে আসে খাদেম ফকিরের একতারার টুনটুন ধ্বনি, আসে তার গলায় তোলা গানও। পুঁথি পাঠ বন্ধ করে সকলে কান পেতে শুনে খাদেম ফকিরের গান,
‘হে ঈশ্বর তোমারে শুধাই
অন্তর গুপ্ত বেদনা আমার
থাকো তুমি যদি মানুষের
মাঝে তবে আলো কেন
না বিলাও অন্ধজনে।।’

গানের সুর ভেদ করে কানে ভেসে আসে হইচই। যুবক দল তেড়ে ওঠে, ‘স্বপনদা’ কন তো এখনই শুরু করি’।
না।
– কেউ উত্তেজিত হবে না। গ্রামের মানুষদের ডর দেখাইয়া লাভ নাই। আগে চলো পাঠশালা পর্যন্ত তো যাই।
রন্ধনশালা থেকে দৌড়ে আসে স্বপনের মা। ‘বাপজান, মারামারি করিস না আবার। মাথা ঠাণ্ডা রাখিস’।
ডরাইও না, মা। বাংলা সংস্কৃতি চর্চা করি আমরা। মারামারি করার ইচ্ছা নাই এক বিন্দুও। কী করতে পারবে ওরা? মিথ্যা চুরির অভিযোগ টিকাইতে তো পারে নাই। দেখলা না, মেম্বার সাব কেমনে বিষয়টা কাটাইয়া গেলো। তয় বেশি তেড়িবেড়ি করলে আমরাও শিক্ষা দিমু। বহুত বাড় বাড়ছে ওই তিন খানদানওয়ালা। গ্রামের মানুষের মাথা নষ্ট করতেছে ধর্মের নামে। নতুন হালে ওঠা গরুর মতন নতুন ধার্মিকেরও সোজা পথ রাইখ্যা ব্যাঁকা পথে চলতে ভালো লাগে। তাগোর মাত্রারিক্ত বাড়াবাড়ি দেখলে মনে হয় যে আমাগো পূর্ব-পুরুষেরা ধর্ম-ই জানতো না।
‘স্বপনদা’, তালুকদার আর মিঞার ছোট ব্যাটা খেওয়াঘাটে শোরগোল শুরু করছে।’- খবর নিয়ে আসে গ্রামের এক যুবক।

তড়িঘড়ি ছুটে তারা খেয়াঘাটের উদ্দেশ্যে। খাদেম ফকির পথ আগলে দাঁড়ায়। ‘এ ধরা জ্বলে পুড়ে ছাই হবে, ওই এক ঈশ্বরের নামে। যাস নে বেটা, যাস নে। অন্ধজনে বিলিয়ে আলো লাভ নেই, কোনো লাভ নেই। মায়ের বুক খালি করে যাসনে বেটা, যাসনে’।
‘ফকির তুমিও চলো। গান ধরো। গাইতে গাইতে- ই চলো। দেখি কে কী করতে পারে’। প্রস্তাব দেয় অন্য এক যুবক।
গান আসে না গলায় এমন বিরোধ দেখলে। চলো, যাই তোমাদের সাথে।
খেয়াঘাটে পৌঁছাতেই চিৎকার করে বলে প্রবীণ মাঝি, ‘বড় দেরি কইরা ফেলছ তোমরা। মিঞার ব্যাটা ভিনদেশী সব নৌকার বান্ধন খুইলা দিছে। বাধ্য হইছে তারা চইলা যাইতে’।
‘বেশি দূরে তো যায় নাই। নৌকার হ্যারিকেনের আলো এখনো চোখের নাগালে। ডাক দেই সবাই মিলে’।- প্রস্তাব করে স্বপন।
‘মাঝি ভাই, মাঝি ভাইৃফিইরা আসো। ভয় নাই আর কোনো। আমরা আছি তোমাদের সাথে। বাঁদরমুখোরা সব পালিয়াছে।’- সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তোলে।

তিন
নব প্রভাতে নববর্ষের আনন্দ হিল্লোল সকলের হৃদয়ে। বাড়িতে বাড়িতে পিঠা, পায়েস। দোকানে দোকানে হালখাতার মিষ্টি। বালক বালিকার রঙিন সাজ, ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতাও জমেছে বেশ। মেলা বসেছে পাঠশালার মাঠে। তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে মঞ্চে নাচ, গান, কবিতা, অভিনয় করে। শিশুরা ঘুরে ঘুরে বাঁশের বাঁশি, রঙিন ঘুড়ি, পুতুল, আলতা, বালা, ফিতে কেনে। মুখে আঁকে নববর্ষের নকশা। তরুণ-তরুণীরা আহ্লাদে মাতে, কেনে কাঠ-বাঁশ-মাটির গহনা, সখের জিনিসপত্র। গৃহিণীরা কেনে তালপাতার পাখা, বাঁশের ডাবর, পিঠার সাজ, কুলা, ডালা, শিকা, মাটির হাঁড়িপাতিল। বায়োস্কোপ নিয়ে হাজির সবার প্রিয় যতিন ব্যাপারী গ্রামে উৎসব নিয়ে মাতামাতি’র এক পুরানো পাপী।

সপরিবারে মেম্বার, চেয়ারম্যান, শিক্ষক সকলে এসেছে; আসেনি কেবল ওইদল, যারা ভুলে যেতে চায় বাংলা সংস্কৃতি, পালাপার্বণ। তাদের অনুপস্থিতি ব্যথিত করে না কারো অন্তর। তবে, তাদের উপঢৌকন বড়ই তিক্ত। লাঠিয়াল বাহিনী ওত পেতে আছে, উদ্দেশ্য তাদের একটাই পণ্ড করতে হবে বৈশাখ উৎসব। প্রথমে বায়োস্কোপ দেখে তোলে হুংকার, ‘বুড়া হনূমান, শিশুদের দেখাও প্রেম-কাহিনী?’ হিংসার আগুন জ্বালায় না তেমন। অমনি ওদের কষ্টটা বেড়ে হয়ে যায় দ্বিগুণ। মঞ্চানুষ্ঠান দেখে শুরু করে চিৎকার, চেঁচামেচি, ‘বৈশাখ নামে অপসংস্কৃতি, বন্ধ করো এসব এক্ষুনি।’

মাইকে ভেসে আসে স্বপনের কণ্ঠ, জাগ্রত গ্রামবাসী নববর্ষের শুভেচ্ছা। আপনারা ভয় পাবেন না অন্ধত্বের হুংকারে। বৈশাখী মেলা, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর্ষবরণ উৎসব বাংলা সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনা, ফেস্টুন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আলপনা আঁকা অপসংস্কৃতি হতে পারে না। বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম দিন। প্রত্যেক বাঙালি সাদরে বরণ করবে নতুন বছর, এটাই স্বাভাবিক। এই বাংলায় বাস করে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ বহু সংখ্যক উপজাতি। সকল ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষের প্রচলিত সংস্কার মিলেই বাংলা সংস্কৃতি। সুতরাং বৈশাখ উৎসব কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়। বৈশাখী উৎসব পুরোটাই বাংলা সংস্কৃতি। এই উৎসব সকল বাঙালির। আপনারা যারা এসেছেন আনন্দ করুন, যারা এখনো এসে পৌঁছাতে পারেননি, নির্ভয়ে আসুন। অন্ধত্বের ছোঁয়ায় মনে ভয় জাগলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘হিংসা-প্রতিহিংসা ছড়ানোর চেয়ে আনন্দ কতটা নির্মল? অন্যকে ভয় দেখিয়ে ভাবনার জগত সঙ্কুচিত করার থেকে অভয় দিয়ে ভাবনার জগৎ প্রসারিত করা কতটা কল্যাণকর? আঘাতের চেয়ে দয়া করা কতটা ঈশ্বর প্রশংসনীয়?’ প্রশ্নের উত্তর-ই বলে দেবে আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ। শুভ নববর্ষ।
খুরশীদ শাম্মী, kjshammi@yahoo.com