ফরিদ আহমেদ : শীতের আগমনী গান শুরু হয়ে সবে। তার প্রভাবে দিনগুলোও হতে শুরু করেছে ছোট।

মিয়ানওয়ালি। পাঞ্জাবের ছোট এক শহর। এখানে রয়েছে একটা জেলখানা। দিন ছোট হওয়াতে মিয়ানওয়ালি জেলের কয়েদিদেরও তাই মুক্ত সময় গিয়েছে কমে। সন্ধ্যা হতেই সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের।
হেলিকপ্টারটা যখন জেলের ভিতরে নামলো, তাদের কেউ সেটাকে তাই চোখে দেখেনি। কিন্তু, হেলিকপ্টারের বিকট শব্দ কারো কান এড়ায়নি। বিরাট কিছু ঘটেছে জেলের ভিতরে এইটুকু অনুমান করার বাইরে আর কিছু জানার সুযোগ তখনও তাদের হয়নি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন জেলে এসেছে এটা বুঝেছে তারা।

সকালবেলাতেই অবশ্য সবাই জেনে যায়, কে এসেছে জেলে। লালপুর থেকে মিয়ানওয়ালি জেলে আনা হয়েছে শেখ মুজিবকে। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর আদৌ তিনি জীবিত ছিলেন কিনা সেটা কেউ জানতো না। করাচি বিমানবন্দরে তাঁর একটা ছবি পাকিস্তান সরকার প্রকাশ করলে সবাই স্বস্তি পায় এটা ভেবে যে তিনি অন্তত জীবিত আছেন। শুরুতে তাঁকে লালপুর জেলে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে তাঁকে রাখা নিরাপদ হচ্ছিলো না। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্যরা সুড়ং খুঁড়েছিলো শেখ মুজিবকে জেলের বাইরে নিয়ে যাবার জন্য। তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিলো। প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও কর্তৃপক্ষ আর তাঁকে সেখানে রাখার ঝুঁকি নিতে চাননি। এই বিশালদেহী বাঙালিকে বড় ভয় তাদের। ফলে, কপ্টারে করে উড়িয়ে আনা হয়েছে মিয়ানওয়ালি জেলে। মহিলা ওয়ার্ডের কয়েদিদের অন্যান্য ব্যারাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই খালি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে তাঁকে। এর ঠিক পিছনেই ছিলো দশ নাম্বার ব্যারাক। সেখানে ভারতীয় কয়েদিদের রাখা হতো। এখানেই বন্দি ছিলেন মোহনলাল ভাস্কর।

মোহনলাল ভাস্কর ছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর ডীপ আন্ডার কভার এজেন্ট। একটা সময়ে গিয়ে তাঁর সেই গোপন পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাঁকে আটক করে। ১৯৬৭ সাল থকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। সিমলা চুক্তির পরে বন্দি বিনিময় কার্যক্রমের মাধ্যমে মুক্তি পান তিনি। একাত্তরে মিয়ানওয়ালি জেলেই আটক ছিলেন তিনি। ফলে, শেখ মুজিবকে ওখানে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে, তাঁর মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার সময়টা ওখানে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা তিনি তাঁর বই, ‘এ্যান ইন্ডিয়ান স্পাই ইন পাকিস্তান’ এ তুলে ধরেছেন। এখানে একটা চ্যাপ্টার রয়েছে, যেটার শিরোনাম হচ্ছে, ‘শেখ মুজিব ইন মিয়ানওয়ালি জেইল’।

সকালবেলা কারাগারে শেখ মুজিবের আগমনের খবর চাওর হওয়ার সাথে সাথে অশিক্ষিত পাঠান কয়েদিরা জেল ব্যারাকের ছাদে চড়ে বসলো। সেখান থেকে শেখ মুজিবকে গালমন্দ করতে থাকলো তারা। পুরনো জুতো এবং পাথরও ছুড়ে মারতে থাকলো তারা মহিলা ওয়ার্ডের উঠোনে। এটা থামাতে গার্ডরাও ছাদে উঠে শূন্যে ছয় রাউন্ড গুলি ছুড়লো। গুলির শব্দে ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। কিন্তু, তারপরেও তারা তাদের কারাকক্ষ থেকে বিড়ালের ডাক ডাকতে লাগলো এবং গালিগালাজ বর্ষণ করতে থাকলো শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে। জেল সুপার নাসির পুরো ব্যারাক টহল দিলেন এবং কয়েদিদের বললেন যে শেখ মুজিবকে মিয়ানওয়ালি জেলে আনা হয়েছে ফাঁসি দেবার উদ্দেশ্যে। এটা শুনে পাকিস্তানি কয়েদিরা ‘ইয়া আলি’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলো। আনন্দে লাফালাফি করা শুরু করলো তারা।

একদিন ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট ফজলদাদ একজন নাম্বারদারকে সাথে নিয়ে ভারতীয় কয়েদিদের ব্যারাকে এলেন। প্রথম দুটো সেল থেকে তিনি আটজন কয়েদিকে এলোপাথাড়ি বেছে নিলেন। মোহনলাল ভাস্কর ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তাঁদেরকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে মহিলা ওয়ার্ডের সামনে থামানো হলো। ফজলদাদ তাঁদের আট ফুট লম্বা, চার ফুট চওড়া এবং চার ফুট গভীর একটা পরিখা খনন করতে বললেন। সেটা ঠিক কোন জায়গায় খুঁড়তে হবে সেটাও দেখিয়ে দিলেন তিনি। ভারতীয় কয়েদিরা অনুমান করলেন যে শেখ মুজিবকে এই রাতেই ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা তাঁর লাশ দাফনের জন্য কবর খুঁড়ছেন। কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করেই পাকিস্তানি কয়েদিদের এর মাঝে জড়ায়নি। তাদের মাধ্যমে জেলের বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ভয়ে।

নয়টার মধ্যে খবর খোঁড়া শেষ হলো। ভারতীয় কয়েদিরা ব্যারাকে ফিরে এলেন। দুরু দুরু বুকে শেখ মুজিবের ফাঁসির অশুভ সংবাদ শোনার অপেক্ষায় রইলেন তাঁরা। সকালবেলা প্রবল স্বস্তির সাথে তাঁরা জানতে পারলেন যে শেখ মুজিব জীবিত রয়েছে। তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ।

জনশ্রুতি রটেছিলো যে শেখ মুজিবের ফাঁসির রাতে জুলফিকার আলী ভুট্টো রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দিতে। তিনি তাঁকে বুঝিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা অলস বসে থাকবে না। পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার থেকে জোয়ান পর্যন্ত সবাই তাদের প্রতিহিংসার শিকার হবে। এমনকি তাদের বাচ্চাকাচ্চারাও রেহাই পাবে না। ভুট্টোর পরামর্শ মেনে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের ফাঁসি বন্ধ করেন।
পরের দিন আবার ভারতীয় কয়েদিদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো। আগের দিনের খোঁড়া পরিখাটা ভর্তি করতে বলা হলো।

পনেরো দিন পরে তাঁদের আবার ডেকে নেওয়া হলো এবং একই ধরনের কবর খুড়তে বলা হলো। কিন্তু, এবারও শেখ মুজিবের ফাঁসি হলো না। এই ঘটনা তিনবার ঘটলো এবং প্রতিবারই তাঁর ফাঁসির সিদ্ধান্ত স্থগিত হলো।
এর আগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতেও তাঁকে জেলের ভিতরে পোরা হয়েছিলো। সেই সময়ে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টোর পরামর্শে সেটা তিনি করেন নাই।

পাকিস্তানিরা তাঁকে প্রবলভাবে ঘৃণা করতো। ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক ছিলো। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান পুরুষ ছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে জুলুম এবং অবিচার তারা করতো, সেটার প্রতিবাদ বাঙালিদের করতে শিখিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে সামনে রেখেই বাঙালিরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতো। তিনি ছিলেন তাদের রাজনীতির কবি। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত মায়াবী বাঁশি বাজিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছিলেন মানুষকে তিনি। তাঁর কবিতা শোনার জন্য উন্মাতাল মানুষ পাগলের মত ছুটে যেতো মাঠে, ঘাটে এবং প্রান্তরে।

সমস্যা হচ্ছে, স্বাধীনতার পরে এই মানুষটিকেই তারা হত্যা করেছিলো। তিনি দেবতা ছিলেন না। ছিলেন দোষগুণে ভরা একজন মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা হিসাবে তিনি যেখানে অসাধারণ এবং অতুলনীয়, দেশ চালানোর ক্ষেত্রে সেই তিনিই ছিলেন গড়পড়তা একজন মানুষ। মানুষের বিপুল প্রত্যাশাকে তিনি পূরণ করতে পারেন নাই দেশ স্বাধীনের পরে। কিন্তু, সেই অপরাধে তাঁকে হত্যা করা যায় না, হত্যাকাণ্ড জায়েজ হয় না। তাঁকে হত্যা করার কথা যাদের ছিলো, সেই শত্রুপক্ষ একাধিকবার চেষ্টা করেও পিছিয়ে গিয়েছে ভয় পেয়ে। কিন্তু, তাঁর নিজের দেশেরই এক অংশ মানুষ সামান্যতম ভয় পায়নি। রাতের অন্ধকারে তাঁর বাসভবনে গিয়ে তাঁকে হত্যা করেছে, হত্যা করেছে তাঁর পরিবারের সবাইকে। সেই হত্যার কথা তাঁরা বুক ফুলিয়ে প্রচারও করেছে। সংবিধানে সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হবে না, এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ও যুক্ত করেছে তারা।

কী এক আজব জাতি আমরা!