ফরিদ আহমেদ : ১৫ অক্টোবর, ১৯১৭ সাল।
সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে তোলা হয়েছিলো তাঁকে। ঘুম ভাঙিয়ে ছিলো জেলের একজন নান। ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পেরেছিলেন কী জন্য জাগানো হয়েছে তাঁকে। অবিন্যস্ত চুলকে আঁচড়ে নেন তিনি। ঘুমনোর পোশাকের উপর কোট পরেন। মাথায় চাপিয়ে নেন হ্যাট। হাতে দস্তানা। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি প্রস্তুত’।

সেইন্ট লাজার জেলখানা থেকে তাঁকে নিয়ে মিছিল করে বের হয় আঠারোজন মানুষ। অপেক্ষারত গাড়িতে চড়ে তাঁরা চলে আসেন ক্যাসার্ন দা ভিনসেন্স ব্যারাকে। এখানে এক সময় দুর্গ ছিলো। সেই প্রাঙ্গণেই বধ্যভূমি তৈরি করা হয়েছে তাঁর জন্য। গুলি করে হত্যা করা হবে তাঁকে।

বারো জন সৈন্য বন্দুক হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গুলি করার আগে একজন সেনা কর্মকর্তা এগিয়ে এলেন সাদা কাপড় হাতে। তাঁর চোখে বেঁধে দেবার জন্য। মৃদু স্বরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কি এটা পরতেই হবে?’

অপূর্ব সুন্দরী নারীটির দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন লেফটেন্যান্ট। তারপরে বললেন, ‘মাদাম যদি চোখ বাঁধতে না চান, সমস্যা নেই। এটা বাধ্যতামূলক নয়।’
তাঁর দিকে তাক করা বারোজন সৈন্যের দিকে তিনি তাকিয়ে থাকলে স্থির, নিষ্কম্প চোখে। মৃত্যুকে এভাবে নিজের চোখে দেখে বরণ করে নেবার ইতিহাস বিরল।

এই কাজটা যিনি করেছিলেন, তিনি কোনো স্বাধীনতাকামী বীর নন, কোনো সশস্ত্র সংগ্রামের বিপ্লবীও নন। বরং যে অপরাধে তিনি শাস্তি পেয়েছিলেন, সেটা একটা ঘৃণ্য অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো তাঁকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ হয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন, এটাই ছিলো তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ।
যাঁর কথা বলছি, তাঁর নাম হচ্ছে মার্গারিটা জেল। প্যারিসে উচ্চবিত্ত সমাজের মক্ষীরানি ছিলেন তিনি। কিন্তু, এই নামে তাঁকে কেউ চেনে না। ইতিহাস তাঁকে জানে মাতা হারি নামে, দুর্ধর্ষ এক স্পাই হিসাবে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম খোঁদাই করে গিয়েছেন তিনি। যদিও এই বিষয়টা নিয়ে এখনো তর্ক-বিতর্ক চলছে। কেউ কেউ দাবি করেন যে, জার্মানি নয়, বরং ফ্রান্সের পক্ষেই গুপ্তচরবৃত্তি করতেন তিনি। তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁসানো হয়েছিলো জার্মানি পক্ষের স্পাই হিসাবে। আবার কারো কারো ধারণা হচ্ছে, তিনি আসলে ছিলেন ডাবল স্পাই। দুই পক্ষের হয়েই কাজ করতেন তিনি। সত্য যেটাই হোক না কেনো, গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে মাতা হারির নাম নেওয়া হয় অতি গুরুত্বের সাথে। এখনো তাঁকে নিয়ে বই লেখা হয়। সেইসব বইতে তুলে আনার চেষ্টা করা হয় সেই সময়কার অনেক অজানা বিষয়। কোয়েলহো পাওলোর মতো সাহিত্যিকও তাঁর জীবনী নিয়ে ‘দ্য স্পাই’ নামের একটা উপন্যাস লিখেছেন। মাতা হারির বর্ণাঢ্য জীবন এবং করুণ পরিণতি নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে। সহজ কথায় বললে, মৃত্যুর একশো বছর পরেও মাতা হারি রয়ে গিয়েছেন রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় চরিত্র হিসাবে।

মাতা হারি নামটা মার্গারিটা জেল নিজেই নিয়েছিলেন। মারা হারি মূলত ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ ভোরের আলো। মাতা হারির সাথে ইন্দোনেশিয়ার একটা সম্পর্ক ছিলো। ইন্দোনেশিয়া তখন ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ নামে পরিচিত, নেদারল্যান্ডের উপনিবেশ। মাতা হারির স্বামী রুডলফ ম্যাকলাউড ছিলেন নেদারল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন। ইন্দোনেশিয়াতে পোস্টেড ছিলেন তিনি।

অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি একবার দীর্ঘ ছুটিতে দেশে ছিলেন। ওই সময়ে পত্রিকাতে তিনি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেন। ক্যাপ্টেন রুডলফ যখন পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেন, তখন তাঁর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। উপনিবেশে ইউরোপিয়ান নারী-পুরুষের অনুপাতে একটা বিশাল পার্থক্য থাকতো। পুরুষদের তুলনায় নারীর সংখ্যা হতো খুবই কম।

ফলে, সক্ষম পুরুষদের স্থানীয় নারীদের মধ্য থেকে পত্নী কিংবা উপপত্নী গ্রহণ করাটা স্বাভাবিক প্রথা ছিলো। ক্যাপ্টেন রুডলফেরও হয়তো সেই অতীত ইতিহাস ছিলো। মাতা হারির জীবনী লেখক প্যাট শিপম্যান এর ভাষ্য অনুযায়ী ক্যাপ্টেনের নারীসঙ্গের ইতিহাস প্রাচুর্যতায় ভরা। যে কারণে তিনি আসলে সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই রোগের কারণেই দীর্ঘকাল থাকে অসুস্থতাজনিত ছুটিতে থাকতে হয়েছিলো।

ক্যাপ্টেন রুডলফের পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের উত্তর বেশিরভাগ প্রার্থীই খবরের কাগজের ঠিকানাতে পাঠিয়েছিলো। ব্যতিক্রম ছিলো মার্গারিটা জেল। তিনি প্রকৃতপক্ষে জন্মসূত্রে ডাচ নাগরিক। মার্গারিটা ক্যাপ্টেনের কাছে সরাসরি চিঠি লেখেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর। তারুণ্যের কৌতূহল এবং এডভেঞ্চারিজম থেকেই হয়তো চিঠিটা লিখেছিলেন। এর বাইরে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার বিলাসী জীবনের সঙ্গী হবার আকাঙ্ক্ষাও কাজ করতে পারে। নইলে, বাবার বয়সী একজনের প্রতি এতো আগ্রহ একজন উঠতি তরুণীর দেখানোর কথা না।

মার্গারিটার সাথে চিঠি চালাচালির পর্যায়ে দু’জনেরই দু’জনের সাথে দেখা করার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। কিন্তু, বাধা হয়ে দাঁড়ায় ক্যাপ্টেনের ভগ্ন স্বাস্থ্য। তারপরেও এক সময়ে দেখা হয় দু’জনের। এবং প্রথম পরিচয়ের মাত্র ছয়দিনের মাথায় তাঁরা বিয়ে করেন।

বিয়ের পরেই ইন্দোনেশিয়া ফিরে যান ক্যাপ্টেন রুডলফ। সাথে করে নিয়ে যান নবপরিণীতা স্ত্রীকে। ওখানে যাবার পরেই ক্যাপ্টেনের আসল রূপ দেখতে পান মার্গারিটা। বিলাসী এক জীবন যাপন করতেন ক্যাপ্টেন। সেটার জন্য টাকা ধার করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না তিনি। এর সঙ্গে ছিলো তাঁর মদ খাবার বদভ্যাস এবং ঘরে বাইরে ভিন্ন নারীর প্রতি আসক্তি। ইন্দোনেশিয়াতে একটা ছেলে আর মেয়ে সন্তান জন্মায় তাঁদের। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্থানীয় একজন নারীকে ন্যানি হিসাবে নিয়োগও দেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেনের মদ্যাসক্তি, নারী-লিপ্সা এবং প্রবল সন্দেহ প্রবণতার কারণে দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। ক্যাপ্টেনের মার্গারিটার প্রতি সন্দেহ একেবারে হাওয়া থেকে আসেনি। মার্গারিটা তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে সচেতন ছিলেন। পুরুষের সৌন্দর্যও তাঁকে আকর্ষিত করতো। ফলে, তরুণ অফিসারদের সাথে নিয়মিতই খুনসুটি করতেন তিনি। তারাও তার রূপের প্রশংসা করতো অকাতরে। ক্যাপ্টেন নিজে অবিশ্বস্ত হলেও, স্ত্রীর এই সামান্য বিচ্যুতি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ফলে, অসুস্থ এবং এবিউসিভ একটা সম্পর্কে পরিণত হয় তাঁদের সম্পর্ক।

এটা চরম খারাপ পর্যায়ে যায় তাঁদের সন্তানের মৃত্যুর পরে। হঠাৎ করেই তাঁদের দুই সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেয়েটা সুস্থ হলেও ছেলেটা মারা যায়। কেউ কেউ লিখেছেন যে এদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ন্যানি বাচ্চা দু’টকে বিষ খাইয়েছিলো। তবে, ন্যানি ঠিক কী কারণে দু’টো অবুঝ বাচ্চাকে বিষ খাওয়ালো, সেটা কেউ বের করতে পারেনি। প্যাট শিপম্যান দাবি করেছেন ছোট বাচ্চাটা সিফিলিসে মারা গিয়েছে। যে রোগ সে পেয়েছে জন্মগতসূত্রে তার বাবার কাছ থেকে।

বাচ্চার মৃত্যুর পরে দু’জনের সম্পর্কছেদ ঘটে। সেটা ১৯০২ সাল। মেয়েটাকে রেখে দেন ক্যাপ্টেন রুডলফ। মার্গারিটা ফিরে আসেন নেদারল্যান্ডে। কিন্তু, এখানে টিকে থাকা তাঁর জন্য অসম্ভব হচ্ছিলো। ফলে, তিনি প্যারিসে চলে আসেন। কী কারণে প্যারিসে এসেছিলেন, এটা নিয়ে অনেক পরে একবার একজন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলো। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি জানি না কী কারণে এখানে এসেছিলেন। আমার ধারণা ছিলো যে সব নারীরা স্বামীদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায় তারা সবাই প্যারিসে আসে।”
প্যারিসে এসে নাচ এবং অভিনয় দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নাই। পরে শিল্পীদের ছবিতে মডেল হওয়া শুরু করেন। এর সাথে টুকটাক দেহ ব্যবসা। কিন্তু, এর কোনোটাতে তিনি সাফল্য পাননি। ফলে, ফিরে যান নেদারল্যান্ডে।

এই প্যারিসেই তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন। সেবার আর ব্যর্থ হন নাই। সাধারণ নাচ, অভিনয় না মডেলিং করে খুব একটা সুবিধা তিনি এখানে করতে পারবেন না, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে, একেবারে নতুন পরিচয়ে, ভিন্ন এক পণ্য নিয়ে প্যারিসে আসেন তিনি। এবার আর মার্গারিটা তিনি নন। হয়ে যান মাতা হারি। পাশ্চাত্য নাচ নয়, বরং প্রাচ্যের রহস্যময় নাচকে তিনি উপস্থাপন করেন পাশ্চাত্যের সামনেই। শুধু কাপড় খুললেই জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় না। সেটাকে উপস্থাপন করা লাগে আকর্ষণীয়ভাবে। তাঁর এই নতুন প্রচেষ্টা কাজে লাগে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আলোড়ন তুলে ফেলেন তিনি। পান অসম্ভব জনপ্রিয়তা।
মাতা হারির প্রতিটা শো হাউজফুল হতে থাকে। উচ্চশ্রেণীর পুরুষেরা তাঁর সঙ্গ লাভের জন্য লালায়িত হয়ে পড়ে। শুধু প্যারিস না, সমস্ত ইউরোপ জুড়ে চষে বেড়াতে থাকেন মাতা হারি।
এর মধ্যে ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ কাল হয়ে আসে মাতা হারির জীবনে। বলা হয়ে যে এই সময়ে জার্মান মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স তাঁকে স্পাই হিসাবে নিয়োগ দেয়। তাঁর কোড নেইম ছিলো এইচ-২১। ফরাসি বাহিনীর মুভমেন্ট এবং মিলিটারি প্লান জার্মানদের কাছে সরবরাহ করাই ছিলো তাঁর কাজ। তাঁর এই গুপ্তচরবৃত্তি ফরাসি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দৃষ্টি এড়ায় না। ১৯১৭ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে তারা তাঁকে আটক করে।

বিচার প্রক্রিয়া চলার সময়ে মাতা হারি সবসময়ই গুপ্তচরবৃত্তির সাথে নিজের সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার করেছেন। তিনি আসলে দোষী ছিলেন, নাকি নির্দোষ ছিলেন, সেই রহস্যের মীমাংসা এখনো হয়নি। কারো কারো ধারণা যুদ্ধে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে এবং অন্য কারও ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য ফরাসি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এই নাটকটা সাজিয়েছিলো। ফলে, মাতা হারির মৃত্যুদণ্ডটা অন্যায় কাজ হয়েছে। আবার কারো কারো মতে, মাতা হারি সত্যি সত্যিই স্পাই ছিলেন। তাঁর কারণে অসংখ্য নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে জার্মান বাহিনীর হাতে। কাজেই, তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াটা ন্যায়সঙ্গত ছিলো।
তাঁর মৃত্যুদণ্ড যৌক্তিক ছিলো, নাকি অযৌক্তিক ছিলো, সেটা এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের ধুলোতে মুছে গিয়েছে তা। মুছেন যাননি শুধু মাতা হারি। অনিন্দ্যসুন্দরী এই নারীটি প্রাচ্যের রহস্যময় নাচকে পরিচিত করিয়েছিলেন পাশ্চাত্যে। সেই পরিচয় করাতে গিয়ে নিজের পরিচয়টাকে তিনি মুছে ফেলে হয়ে উঠেছেন নতুন একজন মানুষ। তিনি শুধু নামই পরিবর্তন করেন নাই, মার্গারিটা জেল থেকে মাতা হারি হন নাই, সম্পূর্ণ একজন নতুন মানুষ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই নতুন মানুষটাকেই মানুষ মনে রেখেছে। মাতা হারির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে মার্গারিটা জেল।

মাতা হারির মর্মান্তিক পরিণতিই মানুষকে এখনো নাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।