ঋতু মীর : ‘True happiness is found in simple, seemingly unremarkable things’

১।
বাসে উঠতেই অবিশ্বাস্যভাবে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায় সত্যবতীর। যদিও সোমবার সকাল মানেই চিনচিনে স্ট্রেস, গলার কাছে টক টক ঢেঁকুর আর যখন তখন পেট মোচড় দেয়া উত্পাত! রবিবার বিকেল থেকে সোমবার সপ্তাহ শুরুর সকাল পর্যন্ত শরীরটা একপ্রকার জোর করে নিয়ন্ত্রণে রাখলেও মনটা বরাবরই উল্টাপাল্টা এক ভিনদেশী মেজাজে বিষাদমাখা লাগে সত্যবতীর। আজ যথানিয়মে স্কুলের উদ্দেশ্যে সাবওয়ে থেকে সরাসরি কানেকটিং বাসে উঠেছে সে। একদম পিছনে উঁচুর সিট থেকে গোটা বাসের ভিতরটা, যাত্রীদের ওঠানামা সর্বোপরি বসা বা দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার অভিব্যাক্তি নজরে পড়ে বলে ওই জায়গাটা সত্যবতীর খুব পছন্দ। উঁচুর সিট দখলে তড়িঘড়ি এগিয়ে যেতে থমকে দাঁড়ায় সে। আজকের বাস ড্রাইভার যেন একটু অন্যরকম আন্তরিক! কাঁচঘেরা জায়গা থেকে সত্যবতীর চোখে চোখ রেখে বাসে ওঠার জন্য ‘Welcome’ জানায়। কালো চিকচিকে মুখে ঝকঝকে সাদা দাতের হাসিটা মুক্তোদানার মত চিবুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বাহহ! কালোয় কি সুন্দর এক আলো! ভালোলাগা অনুভুতির কোমল এক স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নামে সত্যবতীর। হাসিটা মুহূর্তেই ছোঁয়াচে হয়ে তার মুখেও ছড়িয়ে যায়। বাস ভর্তি যাত্রীর ভিড়ে নিজেকে বিশেষ একজন মনে হয়। খুব ইচ্ছা হয় বাসের মেঝেতে সাদা দাগের নিষেধাজ্ঞা লাইনটা টপকে ড্রাইভারের ঠিক পাশে walk way ধরে দাঁড়াতে। নাই বা পেলো আজ বসার জায়গা! হাতে কাঁধে মৃদু ধাক্কায় তড়িঘড়ি পিছনের উঁচু সিটে উঠে বসে সে। আয়নায় ড্রাইভারের সাথে আরেকদফা চোখাচোখি হয়। মজা পাওয়া হাসি হাসি মুখ করে সে তখন ঘোষণা দিচ্ছে- ‘সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ! Happy Monday! আমরা যাত্রা শুরু করছি। বাসটি এখন কেনেডি স্টেশন ছেড়ে এগ্লিংটন ধরে এগিয়ে যাবে। এটা এক্সপ্রেস বাস। পরবর্তী স্টপ মারখাম। এর আগে স্টপ রিকুয়েস্ট করে নিজে বিব্রত হবে না প্লিস! আবহাওয়া কিন্তু চমত্কার। বাতাসের উষ্ণতাও ফ্যাবুলাস! কাজ শেষে বেড়িয়ে পড়তে পারো। সাথে ‘লেয়ার’ নিতে ভুলো না কিন্তু! আর দুঃখিত! যাত্রা পথে এ সময়ে কোন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে না! যাত্রীদের সাথে সত্যবতীও সমস্বরে হেসে ওঠে কৌতুকে। ড্রাইভারকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তায় নামতেই বসন্তের রৌদ্রজ্জ্বল সকাল জাপটে ধরে তাকে। নানা রঙের ফুলের সাজে প্রকৃতি আজ কি ভীষণ সুন্দর, মনোরম! সূর্যের উদার অকৃপণ সোনালী আলোর ছটা যেন আরেকবার অভিনন্দন জানায় সত্যবতীকে। মনটা যেন পাখীর পালক! হাল্কা হাওয়ায় উড়ে উড়ে চলছে কাজের জায়গায়। বিষাদের নীল চাদরে মোড়া সকালটা কোন যাদুমন্ত্রে আজ এমন মন ভালো করা রংধনু রঙে মাখামাখি! একটা ছোট্ট শব্দ ‘welcome’ কি এতটাই শক্তিধর? নাকি সেই অচেনা মুখের প্রশস্ত চোয়ালে আকর্ণ বিস্তীর্ণ অনাবিল হাসিটা? নাকি ক্ষণিকের ‘মনোযোগে’ তার চোখে চোখ রাখা? চলার পথে সাধারণ জিনিষে এত অসাধারণত্ব, এত গভীরতা নিহিত থাকে? নিচ্ছয়ই থাকে! ভাবে সত্যবতী!

২।
কয়েকঘর মিলে এক আঙ্গিনার এই টাউনহোমে সত্যবতীর বসবাস নতুন। বাস থেকে বাসা পর্যন্ত হাঁটা পথ দূরত্ব। কাজ শেষে ক্লান্তির সময়ে সামান্য দূরত্বের হাঁটাই কখনো একরাশ বিরক্তির জন্ম দেয়। চিন্তায়, বোধে, কাজকর্মে সর্বদাই ‘পজিটিভ’ সত্যবতী স্বামীকে প্রায়শই হেসে বলে- হাঁটার ক্ষমতাটা থাকা কিন্তু সুস্থতার লক্ষণ কি বল! কর্নার প্লটের বদৌলতে খানিকটা বাড়তি জায়গা সত্যবতীর বাড়ির অংশ। নিজ হাতে লাগানো ঘন সবুজ ঝাউ আর কয়েকগুচ্ছ রঙিন ফুলে ছিমছাম এক চিলতে বাগান। তাই দেখে ‘প্রতিবেশীর ঈর্ষা’ যে হতেই পারে! আত্মতৃপ্তি আর নির্বিরোধী এক অনুভূতিতে মনটা ভরে থাকে সত্যবতীর। বাসা লাগোয়া বাড়তি জায়গাটা ‘নিজের একান্ত’ বলে কখনোই ভাবে না সে। চলতি পথে তার বাগান দেখে হঠাত থেমে যাওয়া প্রতিবেশীর মুগ্ধতার ভাবটা তাকে অন্যরকম আনন্দ দেয়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যে উন্মুক্ত অবারিত। দৃষ্টিতে, অনুভবে সেই মহিমা আঁজলা ভরে নিতে বাঁধা কোথায়? পাশের বাড়ির সর্ষে হলুদ, গাড় বেগুনী, অপরাজিতা নীল আর রক্ত লাল ফুলের কম্বিনেশনে চমত্কার বাগানটা দোতলার জানালা দিয়ে কি প্রচণ্ডভাবেই না উপভোগ করে সত্যবতী। আজ আঙ্গিনায় দাঁড়াতেই বালু নিয়ে খেলারত ছেলেটিকে চোখে পড়ে তার। এই কিছুদিন আগেই ওকে দেখেছে বাবা, মায়ের হাত ধরে টলোমলো হাঁটতে অথবা স্ত্রলারে ঘুরে বেড়াতে। শীতকালে বাসার বাইরে তাকে কদাচিত দেখা যায়। টানা লম্বা সময়ের পর বসন্তে যেন ঝপ করেই একধাপ বড় হয়ে যায়। দেখা হতেই গাল টিপে আদর করে সত্যবতী- ‘হাইবারনেসন’ তাহলে শেষ হল তোমার! দৌড়ঝাঁপে দুরন্ত শিশু আঙ্গিনাময় ছুটে বেড়ায়। এক অলিখিত অধিকারে প্রায় প্রত্যেকের আঙ্গিনায় অবাধ নির্ভয় প্রবেশ তার। কখনো সত্যবতীর আঙিনায় সাইকেল, খেলনা ফেলে ছুটে যায় অন্য কোন আকর্ষণে। ছোট ছোট পা ফেলে বাগান টপকে ছেলেটাকে তার দিকে আসতে দেখে সত্যবতী। অযত্নে ফোঁটা dandelion হাতের ছোট মুঠিতে আঁকড়ে ধরা। ঠিক মত ছিঁড়তে না পারায় দলিত মথিত ফুলের পাপড়ি। ওর উচ্চতায় হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে কাছে টানে সত্যবতী। পরম আগ্রহে ফুলটা হাতে নেয়। সত্যবতী কিছু বোঝার আগেই ফুলটা আবার ফেরত নিয়ে নেয় ছেলে। বিস্মিত হয় সত্যবতী। একটু দূরে মাকে দেখে সিন্ধান্ত বদল করেছে। নিজের মাকেই দেবে ফুলটা! মায়ের হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই ফুল বৃন্ত ছেড়ে মাটিতে পড়ে যায়। কচি নিস্পাপ মুখ অসম্ভব ব্যাথিত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের বিব্রত মুখে অপূর্ব হাসির লহর। হাসে সত্যবতীও! বুকের মধ্যে অজানা সুখানুভূতি দ্রিম দ্রিম বেজে চলে। কি ভীষণ স্বর্গীয় এই আনন্দ! There are so many beautiful reasons to be happy! জানতো জোনাকি! “happiness does not depend on what you have or who you are; it’s solely relies on what you think” একটানা বলেই চলে সত্যবতী। ফোনের অন্যপ্রান্তে এতক্ষন নীরব থাকা জোনাকি অন্যরকম আত্মবিশ্বাসে কথা বলে ওঠে- সুখ বা আনন্দের বিষয়গুলো সম্পূর্ণই নির্ভর করে ব্যাক্তির মন, চিন্তার বিন্যাস এবং নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী বা বিশ্লেষণের উপর। আসলে “the mind is everything, what you think you become” তাই না! সত্য! (চলবে)
ritu.mir9@gmail.com