ঋতু মীর : ‘Faith is the light that guides you through the darkness’

১।
স্কুল শেষ হলে আমার সাথে আজ এক জায়গায় যাবে প্লিস? অনুরোধের কণ্ঠটা চাপা কষ্টে ভারাক্রান্ত, অবয়ব জুড়ে বিষন্নতা, চোখের কোণে জলের সুক্ষ আভাস। কোথায়, কেন যাবে জানতে চায়না সত্যবতী। ঘাড় নেড়ে নীরব সম্মতিতে আশ্বস্ত করে। কাজ শেষে সচরাচর বাসায় ফিরতেই সত্যবতী অধিক স্বস্তি বোধ করে। বাইরে সারাদিনের কাজের শেষে নিজের ঘরটাকেই একমাত্র নির্ভরযোগ্য আরামদায়ক জায়গা বলে মনে হয়। ক্লান্ত শরীর আলস্যে ছেড়ে দিয়ে নিজের একান্ত সময়টা ভীষণ উপভোগ করে সে। আজ তার ব্যাতিক্রম। স্ট্রিটকারে পাশাপাশি বসেও কথা বাড়ায় না সত্যবতী। নীরবতা কখনো শব্দ বা কথার চেয়েও বেশি ভ‚মিকা রাখে- জানে সত্যবতী! দৃষ্টি বাইরে কিন্তু মনে মনে পাশের সঙ্গীর কথাই ভাবছে সে। স্ট্রিটকারের অটোমেটেড ঘোষণায় বুঝে নেয় জায়গাটা স্প্যাডাইনা। আড়চোখে তাকায়-সাথের মানুষটি যেন এক উদাসী বাউল! বেশভূষা, সাজগোজ, জুয়েলারী সবকিছু- আয়োজনে কেমন নিস্প্রভ ভাব। নিজের প্রতি অযত্নের ছাপটা বেশ স্পষ্ট।

কোলের মধ্যে স্খলিত হাত দুটি ঢলঢলে চুরিতে কেমন অসহায় দেখায়। একটা ‘পাথর’ বিক্রির দোকানে যাচ্ছি আমরা! দম দেয়া কলের পুতুলের যান্ত্রিকতা ওর কণ্ঠে। ‘পাথর’ শব্দটায় অসম্ভব এক পুলক অনুভব করে সত্যবতী। পাথরে বিশ্বাস এবং শরীরে ধারণের নানা উপকারের কথা শুনেছে সে। কিন্তু তার আগ্রহের উত্স সেই বিশ্বাসবোধে নয়। পৃথিবীতে নানা বর্ণের, নানা আকৃতির বিচিত্র সব পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর বেশিরভাগই দুস্প্রাপ্য, মহামুল্যবান! কেনার সামর্থ্য নেই তবুও পাথর ছুঁয়ে দেখায় এক চরম সার্থকতা অনুভব করে সত্যবতী। প্রস্তর যুগ, পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইতিহাসে মানুষের জীবন যাত্রার চিত্র, পাথুরে পাহাড়, অন্ধকার খনির অজানা পাথরের গল্প তাকে শিহরিত করে বারবার। পাথরের জমাট কঠিন অস্তিত্বে বুঝি কোমল এক প্রাণ আছে! বুঝি এক নীরব ভাষা আছে! বুঝি কষ্ট সহ্য করার অসীম এক ক্ষমতা আছে! এলোমেলো ভাবনাটা বেশ জাঁকিয়ে ধরে সত্যবতীকে।

২।
দোকানে ঢুকে একঝলকে চারপাশ দেখে নেয় সত্যবতী। ছিমছাম, ছোট দোকান। কাঁচের সেলফে তালা বন্ধ বিভিন্ন ধরনের পাথর, পাথরের তৈরি জুয়েলারী এবং অন্যান্য সামগ্রী সাজিয়ে রাখা। সাথে দাম এবং জন্মমাস, রাশির সাথে পাথরের সংযোগ, গুনাগুন সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত। খুব ইচ্ছা হয় পাথরগুলো স্বাধীনভাবে ছুঁয়ে দেখার, অনুভব করার। প্রকৃতির অমুল্য ধন মানুষের জিম্মায়, উচ্চ মুল্য ট্যাগে মুনাফা লোভীর নিয়ন্ত্রণে-ভাবে সত্যবতী। পাথরের তৈরি কিছু জুয়েলারী এদিক ওদিক উন্মুক্ত রাখা আছে। নকল পাথরের মেশিন কাটের অলঙ্কারগুলি নিখুঁত সুন্দর হলেও সত্যবতীকে তা মোটেই টানে না। সঙ্গীর দিকে চোখ পড়তে ভাবনা অন্যখাতে বয়- আজ ও এখানে এলো কেন? যতদুর জানে বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ, মাসিক বিলের হিসাব করা টানাটানির সময় ওর। দায়িত্ব উপেক্ষা করা বিবেকহীন স্বামীর সাথে দমবন্ধ সাংসারিক জীবন। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় অবহ কষ্ট উপায়হীনভাবে বয়ে চলছে বহুদিন। এই মুহূর্তে নিজের জন্য পাথরের মত মুল্যবান কিছু কেনার বিলাসিতা আছে বলে মনে হয় না। এভাবে ছুটে আসার তাগিদটা যে অন্তঃস্থলে লুকানো গোপন অদম্য কোন ইচ্ছা- সেটা অনুভব করে সত্যবতী। মানুষের নিজস্ব ‘স্পেস’টা কখনো কখনো ভীষণ জরুরি বলে মানে সে। এবারেও তাই কিছু না বলে ওকে একাই পাথর বাছাইয়ের সুযোগ দেয়। পছন্দের প্রশ্নে তাকে ডাকলে তবেই মতামত দেবে সত্যবতী।
কাউন্টারে ঝুঁকে পড়ে বিক্রেতার সাথে একনাগাড়ে কি যেন বলে যায় সঙ্গী। প্রায় ৭০ ডলার মূল্যের এবড়ো থেবড়ো সাইজে গাড় খয়েরী রঙ পাথরটা হাতে নিয়ে সত্যবতীকে দেখায়। বাড়ির পালা অসুস্থ কুকুরের জন্য নির্দিষ্ট এই পাথরটাই নাকি খুঁজছিল সে! প্রাণী এবং পরিবেশ নিরাপত্তা আইনে চিকিত্সার ঊর্ধ্বে অসুস্থ প্রাণীকে মেরে ফেলাই নাকি নিয়ম। কুকুরটি মেরে ফেলা বিষয়ে স্বামীর নেয়া সিদ্ধান্তে ভিতরটা ভেঙ্গে চুড়ে যাচ্ছে সেই থেকে। একটু চিকিত্সা দেয়া গেলে কুকুরটা হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে, হয়তো বেঁচে যাবে আরও কয়েকদিন! বিস্ময়াভিভূত সত্যবতী গভীর দৃষ্টি রাখে ওর চোখে। সংবেদনশীল সাবধানতায় বলে- পাথরতো ঔষধ নয়!

তাছাড়া আসলেই আসল কিনা! বিশ্বাসের পবিত্র আশার এক আলো খেলে যায় ওই চোখে। অদ্ভুত শান্ত দেখায় মুখটা। পরম যত্নে হাতের তালু ছুঁয়ে থাকা পাথরটা আরেকবার দেখায় সত্যবতীকে। বলে-মঙ্গলসুত্রে গেঁথে পড়িয়ে দেব গলায়, কুকুরটা নিচ্ছয়ই সুস্থ হয়ে উঠবে!
কুকুরটা কিছুটা ভাল হয়ে আরও কিছুদিন বেঁচে ছিল- কিছুদিন পর এমন একটা খবরে ভীষণ চমত্কৃত হয় সত্যবতী। জানো জোনাকি- দুঃসময়ের অন্ধকারে বিশ্বাসবোধই হয়ত মানুষকে দেখায় মুক্তির অবাধ আলো! বিশ্বাসবোধ থেকে যে আশার জন্ম তা কিন্তু ভয় বা হতাশাকে হটিয়ে রাখে-কথার পিঠে কথা বলে জোনাকি। গভীর নিঃশ্বাসে, স্বগতোক্তিতে নিজেকেই যেন বলে সত্যবতী- “stand in faith even when youÕre having the hardest time of your life” (চলবে)।
ritu.mir9@gmail.com