ঋতু মীর: “People that know they are important, think about others. People that think they are important, think about themselves”
১।
বইটা অবহেলায় পাশে ফেলে রাখে সত্যবতী। প্রচ্ছদে অনাবশ্যক উজ্জ্বল রঙের আলগা চটক, শিরোনামের সাথে সঙ্গতিহীন আঙ্গিক দেখে একরাশ বিরক্তি এসে ভর করে মনে। যে কোন বই পড়ে দেখার আগে তার মুদ্রণ, পরিছন্নতা, বিন্যাস, শিরোনামসহ প্রচ্ছদে অবয়বে চোখ ছুঁইয়ে কিছুটা সময় নেয়ার অভ্যাস সত্যবতীর মজ্জাগত। যেন বইটা না খুলে শুরুতেই এর সমগ্রতাকে (whole) একান্ত অনুভব করার প্রয়াস। বরাবর একনিষ্ঠ পাঠক সত্যবতী। বইয়ের সাথে তার চিরসবুজ অটুট বন্ধুত্ব। বই তার কাছে প্রাণহীন জড়বস্তু নয়, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা নির্ভরতার এক বিশ্বস্ত সঙ্গী। বইয়ের গল্পে বর্ণিত চরিত্রের সাথে, প্রবাহমান ঘটনার সাথে, এমনকি লেখকের সাথেও নিজের তৈরি সংলাপের কাল্পনিক কথোপকথনে অবসরের সময় তরতরিয়ে বয়ে যায় সত্যবতীর। বই পড়া ব্যাপারটা তার দৈনন্দিন যাপিত জীবনের বড় অংশ জুড়ে থাকে। রাতের সুনসান নীরবতায় একাগ্র নিবিষ্টতায় বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে রাত জাগা সত্যবতীর বহুদিনের পুরানো অভ্যাস। পড়ালেখার প্রথম পাঠ ধারাপাত আর বাল্যশিক্ষার বয়সে মাটিতে পড়ে থাকা ছেড়া ময়লা কাগজ, ঠোঙ্গা তুলে নিয়ে সবার সামনে শব্দ করে কসরতে বানান করে পড়তে দেখে আশেপাশে বড়দের কৌতুকে হেসে লুটোপুটিতে গড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা মনে করে এখনও নিজের মনেই হাসে সত্যবতী। পাঠের সেই আনন্দ, সেই প্রাপ্তি এখনও টাটকা, তাজা এবং নির্ভেজাল! স্বভাবগত কারণে বই পেলেই কিছুটা বাছবিচারহীনভাবেই তা হাতে নিয়ে দেখে সত্যবতী। ‘পাইলেও পাইতে পারো মানিক রতন’-ভিতরে এমন অদম্য এক আকাক্সক্ষা তাড়িত করে সত্যবতীকে। আসলে মন্দের অবস্থানেই হয়তো ভালোকে সঠিকভাবে আবিস্কার করা যায়। ঠিক যেমন অন্ধকারের আড়ালেই থাকে আলোর স্পষ্টতা! আর সচেতন পাঠক মনই আগাম ইশারা দেয় কোথায় থামতে হবে অথবা কোনটা হবে বর্জন। জানে সত্যবতী! আজ তাই অদেখা, অজানা লেখকের ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমিত্ব’ ঠাসা বইটা এক মালিকানাহীন জড়বস্তুর মত সত্যবতীর সামনে পড়ে থাকে।

২।
নার্সিসাস! গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর অনিন্দ্য সুন্দর সেই যুবরাজ! নিজ সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় অহঙ্কারের শীর্ষ মাত্রা ছুঁয়ে জলের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে থাকে অবিচল নিমগ্নতায়। বিস্মরণের স্বার্থপর সময় বয়ে যায়। জলে আপন প্রতিচ্ছবি ছোঁয়ার খেলায় মগ্ন স্বত্বা স্ব-প্রশংসায়, নিজের প্রতি কেন্দ্রীভুত ভালোবাসায়, অহঙ্কারে বুঝতে পারে না জলের আয়নায় এ শুধুই এক নশ্বর দেহের প্রতিবিম্ব! বুঝতে পারে না এই সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী এক কুহেলিকা। এই মুহূর্তে কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই Narcissism, Narcissist শব্দগুলোর অবিরাম এক ঘূর্ণন চলে সত্যবতীর মগজে। Narcissism শব্দের ব্যুৎপত্তিগত দার্শনিক অর্থটা অনুধাবন করতে গিয়ে প্রবন্ধের এক জায়গায় চোখ স্থির হয়ে যায় সত্যবতীর। লেখকরাই নাকি সবচেয়ে বড় Narcissist! কি ভয়ঙ্কর লজ্জার এই উক্তি! নিয়মিত নয়, তবুও সেও তো লেখে। লেখে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। লেখে তখনই যখন জীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, প্রেম, স্মৃতি তোলপাড় করে ভাসিয়ে নেয় মনের গহীন অঞ্চল, প্রকাশের আবেগ থরোথরো কাঁপিয়ে দেয় ভিতর, বাহির। জলের আয়নায় আপন প্রতিবিম্বে চেয়ে থাকা সেই গ্রীক যবকের ‘নার্সিসাস’ নিমগ্নতায় সত্যবতীও বুঝি একমনে লিখে চলে তখনই। সেই লেখায় নিজের সাতকাহন, ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমিত্ব’ও থাকে বৈকি। আচ্ছা জোনাকি! হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনে, মনের মাধুরীতে, কল্পনায় শব্দের মালা গেঁথে গেঁথে লেখক তার অনুভবের ভাবটা প্রকাশ করবে সেই স্বাধীনতায় দোষ কোথায় বলতো? শোন সত্য! জোনাকির চোখে দার্শনিক চিন্তার ঝিলিক খেলে যায়। বলে- নিজেকে ভালোবাসার সহজাত প্রবৃত্তিতেই কিন্তু মানুষ। আপনার চেয়ে আপন জনকে মানুষ নিজের মধ্যেই খুঁজে নেয়। কিন্তু ‘আমি’ ‘আমার’ এবং ‘আমিত্ব’ এর লাগামহীন ভাবনায় আছন্ন ব্যক্তি নিজের অজান্তেই হয়ে ওঠে Narcissist। বলা চলে-self-love, self-admiration, self-obsession, self-absorption বিষয়গুলো যখন অতিমাত্রায় ব্যক্তির বোধকে আছন্ন করে রাখে ধরে নিও সেই ব্যক্তি তখন Narcissistic Personality Disorder (NPD) সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত। দেখো সত্য! বিজ্ঞান আর তথ্য প্রযুক্তির বিকাশে মানব কল্যাণের সব শাখায় আজ উন্নয়নের জোয়ার বইছে। পাশাপাশি ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক, সেলফি, টুইটারের অভিনব দাপটে মানুষ যেন ক্রমেই প্রযুক্তির দাসত্বের শৃঙ্খলে আঁটকে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গী, হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ, শৈল্পিক সুকুমার কিছু মনোবৃত্তি। ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশ, বিকশিত করার অভব্য বাসনা আজ উত্তাল তুঙ্গে। নিজেকে জাহির করার রাস্তাটাও আজ খুব সহজলভ্য, হাতের মুঠোয়। বিশেষ করে লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখকের ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমিত্ব’ ভাবনায় নৈব্যক্তিকতার নির্বাসন এবং সাহিত্য সুধারস বঞ্চিত লেখায় পাঠকের অত্যাচারের নিরানন্দ উপত্যকায় বসবাস – সাহিত্য অঙ্গনে আজ সত্যি এক অপ্রতিরোধ্য সমস্যা।

৩।
তোমার কথায় আমি একমত জোনাকি! যুক্তি খণ্ডনের বলিষ্ঠ স্বর সত্যবতীর কণ্ঠে – বুঝলাম স্মৃতি অমুল্যধন এবং ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা অবিনশ্বর সঞ্চয়। তাছাড়া এও বুঝলাম যে- নিজের জীবনের গল্পই নাকি মানুষের শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম গল্প। কিন্তু নৈব্যক্তিকতার মানদণ্ডে এই ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমিত্ব’ সম্বলিত লেখার সাহিত্যমান কতটুকু? ব্যক্তি অভিজ্ঞতা, স্মৃতি জাগানিয়া, আত্মকাহিনী নির্ভর গল্প সাহিত্যামোদী, বিদগ্ধ পাঠকের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য? স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা বা অর্থপূর্ণতার মানদণ্ডে তা কতটা মূল্যবান? নাকি তা কেবলই পাঠক মনোযোগ আকর্ষণে একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু কাহিনীর রোজনামচা? কিছু বলতে বা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে বলেই লেখা না পাঠককে ‘সুনির্দিষ্ট কিছু বলার আছে’ এমন ভাবনায় কলম ধরা? সার্বজনীন, শাশ্বত কোন বার্তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে লেখাটা কি আদৌ সমর্থ? লেখক কি একবারও নিজেকে ‘পাঠকের’ স্থানে নিয়ে নিজের মধ্যে স্ব-মুল্যায়নের ((self-evaluation)) প্রতিফলন ঘটায়? শোন! জোনাকির স্বচ্ছ জলের চোখের আয়নায় চোখ রাখে সত্যবতী। ‘আমি’ ‘আমার’ ‘আমিত্ব’ ব্যাপারটা বিসর্জনের তো নয়। মানুষের এই বোধ অন্তর্জাত, স্বতঃস্ফূর্ত, সুন্দর! শুধু মনে রাখা প্রয়োজন- পৃথিবীর এই বিশালতায় ব্যক্তি আসলে মহাকালের অতি এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আর অংশের পূর্ণতা কিন্তু সমগ্রেই! ‘The whole is more than the sum of its parts’। আমার ‘আমিকে’ বিশ্বের সমগ্রতায় মিশিয়ে নেয়ার ঐশ্বরিক ক্ষমতার মধ্যেই আছে শ্বাশত সৌন্দর্য, সার্বজনীনতার সার্থকতা। দুই হাতে জোনাকির কাঁধ জড়িয়ে ধরে সত্যবতী। সারা মুখে রোদ ঝলাকানো সূর্য হাসি চিকচিক করে সত্যবতীর। কফির আগে তাহলে একটা সেলফি হয়ে যাক জোনাকি! এক্ষুনি! (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com