ঋতু মীর : “Don’t be a woman that needs a man… Be a woman a man needs!”
১।
অদম্য কৌতূহল সত্যবতীর চোখ জোড়ায়। ফ্রকের ঝুলে অসংখ্য চোরকাটা, খালি পা ধুলায় ধুসর। ঝাঁকড়া চুলে কালো নরম গড়ন কিশোরী মুখটা ঢেকে যাচ্ছে বারবার। বেয়াড়া চুল বাঁধার সময় নেই একদণ্ড। প্রায় ছুটে ছুটে একদমে দৌড়ে এসেছে – নবজাতক দেখবে বলে! উঠানের এক কোণে ছোট মাটির ঘরটা বিশাল বাড়িটার বড়সর ঘরগুলো থেকে একদম আলাদা। ওটা নাকি ‘আঁতুড় ঘর’! সত্যবতীর কাঁচা নবীন মগজে অত কিছু খেলে না। আচার, মোয়া, মিষ্টির লোভে এই বাড়িতে আরও অনেকবার এসেছে সে। এই অদ্ভুত নামের ঘরটা কখনোই নজরে পড়েনি। ছোট্ট জানালার ‘প্রবেশ নিষেধ’ ঘরটাকে কেমন বিচ্ছিন্ন মনে হয়। তার চঞ্চল মন কোলাহল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে চায়। শিশুর কান্না যে ওই ঘর থেকেই আসছে! সাদা চুল বৃদ্ধা আভিজাত্যের গৌরব সর্বাঙ্গে মেখে ঘরের সঙ্কীর্ণ দরোজাটা প্রায় জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুই হাতে পরম যতেœ কাঁথা কাপড়ে জড়াজড়ি একটা পুটুলি। ‘দেখি’ ‘দেখি’ বলে উল্লাসের রব উঠানময় ছড়িয়ে যায়। সত্যবতীর বিস্ময়ের চোখ অস্থির হয়ে ঘোরে। দেখতে চায়, ছুঁতে চায় সেই জ্যান্ত পুতুল! সেই সাথে শিশুর জন্মদাত্রী ‘মা’ কে দেখার জন্য আঁকুপাঁকু করে মন- শিশু কোলে সেকি তাঁর মায়ের মতই কেউ? জন্মদাত্রীকে দেখার ইচ্ছা কেউ জানায় না। আহ্লাদে গলে গলে যাওয়া কিছু মিশ্র কণ্ঠ কানে আসে- নাতি তোমার কালো হয়েছে গো! বৃদ্ধার চোখে মুখে সাম্রাজ্য জয়ের হাসি। জগতের অমোঘ কোন বাণী ঘোষণার স্বরে বলে ওঠে- হোক কালো! ছেলি তো! হীরার আংটি তা আবার বাঁকা! লম্বা লম্বা পা ফেলে দৌড়ে বন বাদাড় ডিঙ্গোয় সত্যবতী। কানে ঝনঝনিয়ে বেজে যায় কাটা কাটা শ্লেষ কণ্ঠ-হোক কালো! ছেলি তো! হীরার আংটি! বংশের বাতি! ওই মুহূর্তে কেউ না বললেও সে বুঝতে পারে তার গায়ের রঙ এইমাত্র দেখা শিশুর মতই কালো। বুঝতে পারে সে ছেলে নয়, একজন মেয়ে। শুধু বুঝতে পারে না সে কেন হীরার আংটি নয় অথবা কেন নয় বংশের বাতি?

২।
দাওয়াতের বাড়িতে অনেকদিন পরে হঠাৎ দেখা তার সাথে। তারুণ্যের বেপরোয়া বাছ বিচারহীন বন্ধুত্বের উচ্ছল সময়েই পরিচয়। পৌরুষের গরিমায় মাসল দেখানো স্কিন টাইট ফিটিংস প্যান্ট শার্টে অরুচিকর অস্বস্তি! পাশে দাঁড়ানো জবুথবু তরুণী স্ত্রী। পড়নে ঝলমলে ভারী শাড়ি, গা ভর্তি উপচে পড়া গয়না। দমন আর নিগ্রহে লাবণ্য ঢল ঢল মুখটায় লেপটে থাকা চাপা কষ্টটা সত্যবতীর গভীরে দেখার দৃষ্টিতে এড়ায় না। তুমি দেখি ঠিক আগের মতই আছো সত্য! পূর্ব আন্তরিকতার সূত্রে মাসল ম্যান দাত কেলিয়ে খুব কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। এত কাছে যে গা থেকে সস্তা কোলনের উগ্র ঝাঁজ মাখা গন্ধটা সত্যবতীর নাকে ঝাপটা মেরে সাই করে মগজে ঢুকে যায়। ইন্দ্রিয়ের সজাগ কোন ইশারায় মনের অজান্তেই দুই কদম সরে দাঁড়ায় সত্যবতী। তার অবিবাহিত সঙ্গীবিহীন অরক্ষণীয় অবস্থানে যারপরনাই খুশী তখন অন্য পক্ষ। ভিতরটা বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে সত্যবতীর। নিজের স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন মনে করছে না কেন? সামন্ত কায়দায় তাকে নিজের পিছনে আড়াল করে পুরুষ ক্ষমতা জাহির করার হাস্যকর প্রচেষ্টায় সত্যবতীর মন বিষিয়ে ওঠে। যেন ঝলমলে শাড়ি কাপড়ে ঢাকা ওই দেহ প্রাণহীন এক জড় পদার্থ! যেন ওই দেহ কেবল ঘরে শোভা বর্ধনের মত জমকালো এক আসবাব! যেন যা ইচ্ছা তাই করা যায় এমন এক নিজস্ব সম্পত্তি! পরিচিত উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে দূর থেকে অপরিচিতা মেয়েটার মায়াবী চোখে চোখ রাখে সত্যবতী। ভাবে কাছে যেয়ে হাত দুটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলবে- আমি সত্যবতী! তুমি? হঠাৎ চাপা গলায় হিশহিশে কণ্ঠ কানে আসে সত্যবতীর- এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো! একদম চুপ করে থাকো! নইলে একটা থাপ্পড় দিয়ে…! শুকনা মড়মড়ে পাতায় বিষাক্ত কোন সাপের শরীর মুচড়িয়ে ফণা তোলা হিশহিশে শব্দের সাথে ওই কণ্ঠের হুবুহু মিল খুঁজে পায় সত্যবতী। ভয়ে, ঘৃণায় দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে পালায় সে।

৩।
বলো মা কবুল! বলো ‘রাজি আছি’! একটু জোরে বলো মা! বিয়ে বাড়ির কোলাহল এই ঘরে পিনপতন নীরবতায় স্তব্ধ। কলমা পরানোর কাজিসহ মুরুব্বী সমান পুরুষ অভিভাবক নিজেদের কান এগিয়ে ঘিরে আছে কনেকে। ‘কবুল’ শব্দটা কানে শুনতে হবে যে! গয়না, শাড়ি, সাজগোজের ঝলমলে আবরণে বিয়ের কনে প্রায় জড়বস্তু। আছোঁয়া কুমারী মন শঙ্কায়, উৎকণ্ঠায় প্রায় নেতিয়ে পড়া। আচমকা একটা কচি কণ্ঠ আধো বোলে বলে বসে- ‘হ্যাঁ রাজি আছি’! বিব্রত বিড়ম্বনায় দুড়দাড় ছুটে আসে শিশুর মা। অবোধ মেয়ের মুখ লম্বা হাত বাড়িয়ে চেপে ধরে। কলমা পড়ানোর এমন গুরুগম্ভীর সময়ে একি কাণ্ড! ঘরের এককোণে সত্যবতী তখন গোটা বিষয়টা অবলোকনের উত্তেজনায় টানটান দাঁড়িয়ে। তাকেও বুঝি এমন একটা বিয়ের পিড়িতেই বসতে হবে একদিন? বুঝি অদেখা, অচেনা কারও হাত ধরে বাপের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতিতে ‘কবুল’ শব্দটা সবাইকে শুনিয়ে এভাবেই বলতে হবে তাকেও? দ্যাখো জোনাকি! বিয়ে পড়ানোর এই অদ্ভুত প্রথার রীতিতে ছেলেদের ক্ষেত্রে একটা ‘সাক্ষর’ কিন্তু যথেষ্ট। কিন্তু লজ্জা, ভয়ে মেয়ের কণ্ঠ যতই তলিয়ে যাক উচ্চারিত ‘কবুল’ শব্দের উচ্চারণ উপস্থিত সকলের কর্ণ কুহরে পৌঁছানো চাই-ই চাই! আর কেবল পুরুষকেই কেন মুরুব্বি সেজে নিজ কানে ‘রাজি আছি’ কথাটা শুনতেই হবে? কেন বলতো? এই বিয়েতে মেয়েটির সম্মতি ছিল কিনা, চিরজীবন যার সাথে থাকতে হবে তাকে একনজর দেখা বা নিভৃতে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলো কি না, বিয়ের সঠিক সময় বা বয়স হয়েছিল কিনা- সে বিষয় নিয়ে ভাবনাটা যেন আদিখ্যেতা। বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে তো বটেই। না সত্য! শান্ত মুখে তাকায় জোনাকি। এখন প্রগতিশীল সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে অবশ্যই নারীর অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে ঘরে বাইরে। আজকের নারী শিক্ষিত, অর্থ উপার্জনকারী। সংসারে, সমাজে সিদ্ধান্ত নেয়া অবস্থানে নারী আজ অধিষ্ঠিত। নারীর গতিবিবিধির প্রসারতাও বেড়েছে অনেক। সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে ক্ষমতার শীর্ষে, উচ্চ পর্বত শৃঙ্গ কোথায় নেই আজকের নারী বলো? আছে! জোনাকির মুখের কথা কেড়ে নেয় সত্যবতী। তারপরও নারীর ক্ষমতায়নের শর্ত পূরণে অদৃশ্য এক বাঁধার দেয়াল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েই আছে। সেই দেয়াল দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। নারী-পুরুষ বৈষম্যের সামাজিক কাঠামোটা আজ আদলে অনেক বদলেছে সত্যি কিন্তু জানো তো জোনাকি! পরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ঘুণ পোকা এখনও অনেক গভীরে কেটে কেটে চলেছে। এখনও সুযোগ পেলেই নারীর উপর চলছে নিয়ন্ত্রণ, চলছে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। শোন জোনাকি! নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টা রাতারাতি কোন বিপ্লবিক পরিবর্তন নয়, বিবর্তন মাত্র। শিক্ষা, অর্থ উপার্জনের সাথে নারী যখন নিজের জীবন চলার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে, বা নিজের জীবনের উপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে ‘ক্ষমতায়ন’ বিষয়টা কিন্তু তখনি ঘটে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে থামে সত্যবতী।

৪।
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে থাকে সত্যবতী। মোহাচ্ছন্ন নির্জন দুপুরে নিজেকে আবিষ্কারের সেই ঘোর লাগা নেশাটা ঠিক আগের মত অদ্ভুত ভালো লাগায় রোমাঞ্চকর নয়। কোঁকড়া চুলে ঢাকা লাবণ্য ভরা মুখ, ডাগর চোখের ভীরু চাউনি, সরল হাসিতে জলপাই সবুজ সজীবতা- সবই আজ পলাতক এক ফেরারী। কথায় কথায় অভিমানে আহত চোখ আগের মত এখন আর টইটুম্বুর দীঘি নয়। সমাজে, পরিবারে নারীর প্রতি যাবতীয় অনিয়ম, অবিচারে তার মাথায় ভর করে গিজগিজে অসন্তোষ। অক্ষম, অসহায় প্রতিবাদে অঙ্গার হয়ে জ্বলে এই চোখ। এই দৃষ্টি এখন তলদেশ দেখা যাওয়া স্থিত, স্বচ্ছ গভীর এক সরোবর যেন! এই অবয়বে এখন সময়ের ক্ষত। স্পষ্ট, অস্পষ্ট বলিরেখায় ঘাট আঘাটার নানা অভিজ্ঞতার ছাপ। বদলে গেছে সত্যবতী। প্রতিনিয়ত বদলায় সে! বদলাতে হয় তাকে, নিজের জন্য! অন্য কোন নারীর জন্য! রক্ষণশীল সামাজিক কাঠামোর প্রথাগত বলয়ে কিশোরী-তরুণী-রমণী থেকে নারী হয়ে ওঠার উত্তরোত্তর রুপান্তরে আজ সে শাশ্বত এক নারী! এক মানবী! এক সত্যবতী! (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto. (ritu.mir9@gmail.com)